×

মুক্তচিন্তা

জেগে উঠুন, ওয়াহিদা খানম!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:০০ পিএম

জেগে উঠুন, ওয়াহিদা খানম!

ফাইল ছবি।

গভীর রাতে সরকারি বাসায় রক্তাক্ত হলেন দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম। কন্যার আর্তচিৎকারে বাবাও আহত হলেন। কী লোমহর্ষক ঘটনা। যিনি ঘোড়াঘাট উপজেলাবাসীর দেখভাল, নিরাপত্তা আর উন্নয়নের কাজ করছেন, কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, তিনি নিজেই আদতে ছিলেন অরক্ষিত, নিরাপদহীন। নিজেও সম্ভবত তা জানতেন না এভাবে তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে একদিন। তার ওপর দুর্বৃত্তদের পাশবিক হামলা সেই সত্যকে বেশ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিল, তিনি বা তারা আদতে কেউই নিরাপদ নন। ছোটবেলায় ফুলবাগান দেখতাম কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। কারণ গরু, ছাগল যেন গাছ না খেয়ে ফেলে এবং মানুষপ্রাণী যেন ফুল চুরি করতে না পারে। কিন্তু তারপরও বাগান থেকে ফুল চুরি হতে দেখেছি। গরু-ছাগলকে গাছ, ঘাস খেতে দেখেছি। সম্প্রতি মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম কোথায় যেন চোরের হাত থেকে পুকুরের মাছ রক্ষা করার জন্য বিদ্যুতের তারের বেড়া দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় চোর নয়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর একটা ঘটনা সম্প্রতি বেশ আলোড়ন তুলেছে সেটা হলো মেজর সিনহা হত্যা। পুলিশের ক্রসফায়ারে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তদন্তে এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেটা করেছে স্বয়ং পুলিশ কর্মকর্তা। ঘটনাগুলো উল্লেখ করতে হলো এ কারণে যে, দেশে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও পাশবিকতা কমছে না। আবার যার বা যাদের দায়িত্ব থাকছে নিরাপত্তার বেড়া শক্ত করে দেয়ার, তাদের কারোর কারোর দ্বারাই বেড়া ভেঙে পড়ছে এবং অপরাধ ঘটছে। ফলে ফুলের বাগানের মতো জীবনের বাগান সুরক্ষিত হচ্ছে না।

একজন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের সুনাম কানে পৌঁছাল। তার এলাকাবাসী, কর্মস্থলের জনগণ সেই কথা বললেন। অবয়বও তার সাদামাটা। তার সহজ, সরল বাবা-মায়ের চেহারা বলে দেয় বাংলার মাটিতে মোড়ানো দুই সত্তা যেন। চোখজুড়ে স্বপ্ন তাদের কন্যাকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে নারীরা কতটা এগিয়ে গেছে তা দেখলে একজন নারী হিসেবে গর্বে বুক ভরে যায়। উপজেলা, জেলায় কাজের সুবাদে গিয়ে দেখেছি অল্প বয়সের নারী ও পুরুষ কীভাবে তার এলাকা সামাল দিচ্ছেন। উন্নয়নের কাজ করছেন। তারুণ্যে টগবগ করছে তার কর্মএলাকা। কত সহজে তাদের কাছে পৌঁছানো যায়। কথা বলা যায়। সমাধানের পথ পাওয়া যায়। এর বিপরীত চিত্রও আছে। তবে আমার অভিজ্ঞতায় আছে স্থানীয় প্রশাসনে নারীরা অনেক সততা, আস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। স্থানীয় মস্তান, রাজনৈতিক মস্তান, ঠিকাদার, চাঁদাবাজ বহু ধরনের অপরাধীর সঙ্গে তাদের লড়াই করে কাজ করতে হয়। কিছুদিন আগেও পত্রিকায় এসেছে রাজনৈতিক নেতার পছন্দমতো কাজ না করায় একজন নারী কর্মকর্তাকে হেনস্থা করা হয়েছে। ওয়াহিদা খানম জানিয়েছেন যে, মুখোশ পরার কারণে তিনি অপরাধীদের চিনতে পারেননি। কেউ তাদের মেয়েকে হত্যা করতে পারে এমন কল্পনাও নেই বাবা-মায়ের মনে। কিন্তু তাহলে কে এমন নৃশংস অপরাধ করতে সাহস পেল। সাধারণ মানুষ তো বোকা হয়ে বসে নেই। থাকে না। তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে হাজারো গল্প সঞ্চিত আছে। তাই তারা ভেবে নেন, নিশ্চয়ই তাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা পোষণ করার একটা কারণ ছিল। অনেক পরিচিত একটা কারণ খোলস থেকে অবশেষে বেরিয়ে এলো।

যখন লেখাটা লিখছি তখন টিভির খবরে জানলাম যে, ওয়াহিদা খানমকে হত্যার চেষ্টার অভিযোগে যুবলীগ নেতাসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেই যুবলীগ! ক্যাসিনো থেকে সরকারি কর্মকর্তা হত্যার চেষ্টায় উন্মাদ! জানা গেল যুবলীগ থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। এও বলা হচ্ছে, যেই অপরাধী হোক না কেন তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। যেটা সবসময় করা হয়, বলা হয় ওয়াহিদা খানমের ওপর নৃশংসভাবে হত্যার প্রচেষ্টার বেলায়ও তাই বলা হলো। বহিষ্কার ও বিচার করে কী লাভ হয়? এমন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় থেকে কি আর কেউ অপরাধ করে না কিংবা করছে না? করেছে, করছে এবং করে। তাছাড়া বড় বড় নেতা যদি ভেবে থাকেন বহিষ্কার ও বিচার করাটাই বড় শাস্তি এবং এটা নিশ্চিত করাই তাদের দায়িত্ব তাহলে বোধহয় কোথাও একটা বড় ভুল হয়ে থাকে। যে ভুলটা পরবর্তীতে আর একটা অপরাধের পথ সুগম করে দেয়। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা জরুরি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নামতা পড়ার মতো মুখস্থ করতে হবে রাজনৈতিক জীবন গড়তে। যেন রাজনীতি করে কেউ অপরাধ করতে ভুলেও উদ্বুদ্ধ না হয়।

আর দলনেত্রীর হুঁশিয়ার যে কর্ণপাত করবে না, সে দলে থাকে কী করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কী করে বুঝা যাবে দলের ভেতর কে অপরাধী, কে অপরাধী না। উত্তর হলো, আচরণই তো বলে দেয়। প্রতি বছর রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাদের ধনসম্পদ, জীবনাচরণের পরিবর্তনই তো অনেক অজানা কথা বলে দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি বছর চারিত্রিক সনদ সত্যায়িত করার একটা সিস্টেম চালু হতে পারে। সত্যায়িত করবে একাধারে স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ জনগণ, অবশ্যই দলের কেউ নন। সেই সঙ্গে সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হতে হবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববহিভর্‚ত এবং প্রভাবমুক্ত। সৎ, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তি কাজ করার সুযোগ পাবেন এটা নিশ্চিত করা গেলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সিসি ক্যামেরা বা সঙ্গে আনসারের পাহারার চেয়ে দলের অঙ্গসংগঠনের ভেতর শুদ্ধাচার চর্চার সংস্কৃতি চালু করা এবং সরকারের সব ধরনের কাজ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হলে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে মনে করি।

পরিশেষে বলি, ওয়াহিদা খানম শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি বাংলাদেশের একটা উপজেলা। এই আঘাত ব্যক্তির ওপরই কেবল পড়েনি, উপজেলার ওপর পড়েছে। দেশটাকে সুরক্ষিত রাখতে হলে প্রতিটি গ্রাম, উপজেলা, জেলা ও বিভাগকে নিরাপদ রাখতে হবে। বাইরের শত্রুর চেয়ে অভ্যন্তরীণ শত্রু ভয়ঙ্কর ও বিষাক্ত। নিরাপত্তার প্রশ্নে বিষয়গুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর রক্ষক যেন ভক্ষক না হন, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ওয়াহিদা খানম দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App