×

মুক্তচিন্তা

একে একে নিভেছে দেউটি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৬ পিএম

তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলনে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। তার মৃত্যুতে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুহারা হলাম। সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে হাতেগোনা কজন আর অবশিষ্ট আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও নিম্নমুখী। একে একে নিভেছে দেউটি।

মাত্র কিছুদিন আগে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্ত। সপ্তাহ না ঘুরতে চলে গেলেন অপর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী। দুজনই আমার কাছে অতি আপনজন। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও তারা দুজনই ঘাতক নির্মূল আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আবু ওসমান চৌধুরী অবশ্য ২৪ জন রাষ্ট্রদ্রোহীর অন্যতম। স্মরণ থাকতে পারে ১৯৯২ সালে বিএনপি সরকার যে ২৪ জন বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল, এসব রাষ্ট্রদ্রোহীর অধিকাংশ ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন। ওসমান ভাইকে ভিন্ন আরো একটি কারণে চিনি। তিনি বৃহত্তর কুমিল্লার সন্তান অর্থাৎ চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সন্তান আর বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লা শহরের মৌলভীপাড়ায়। মৌলভীপাড়া আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে। তার শ্বশুরবাড়ির অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল যুদ্ধের প্রথম দিকে। তাকে আরো গভীরভাবে হৃদয়ে আঁকড়ে ধরি। সেনাসদস্যদের মধ্যে বিবিসি আবু ওসমান চৌধুরীর নাম ধরে গৃহযুদ্ধের খবর প্রকাশ করেছিল। তিনি তখন কুষ্টিয়ায় ইপিআরের মেজর ছিলেন। বৈদ্যনাথতলায় সঙ্গত কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অন্যতম আনজামদাতা হলেও তিনি বিশেষ অসুবিধায় পড়েন। সময়মতো শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেননি। তবে নারী সমাজের পক্ষ থেকে তার স্ত্রী নাজিয়া ওসমান বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। দুঃখের বিষয় তিনি অপঘাতে সেই ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবে নিহত হন। স্ত্রী বিয়োগের পর আবু ওসমান চৌধুরী দুই কন্যা সন্তান নিয়ে প্রথমে এবং মেয়েদের বিয়ের পরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান।

আমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কারণ মুক্তিযুদ্ধ ও ঘাতক যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলন। আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তখনই সম্যকভাবে জানতে পারি যে তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যার কোনো খেতাব মেলেনি। তার খেতাব না মেলার কারণটি তিনি নিজে নন। সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু বিশিষ্টজন যাদের একজন প্রথম থেকে নেহাতই ব্যক্তিগত কারণে ওসমান ভাইকে অপছন্দ করতেন। অপছন্দের তালিকায় ছিলেন বলেই প্রতিরোধ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের পরও তিনি কোনো বীরত্ব সূচক উপাধি পাননি; যদিও প্রতিটি খেতাবই বীরত্বনির্ভর ছিল; অসামান্য ব্যক্তিগত বীরত্ব প্রদর্শন করার জন্য। তার অধীনে জেনারেল মোস্তাফিজও ছিল। একদিন দেখলাম জেনারেল একজন কর্নেল পদের ব্যক্তিকে শ্রদ্ধাভরে স্যালুট দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে মোস্তাফিজ ক্যাপ্টেন থাকাবস্থায় তার অধীনে যুদ্ধ করেছেন। সফিকউল্লাহও তার সঙ্গে ছিলেন। তবে এই সফিকউল্লাহ জেনারেল শফিউল্লাহ নয়, যদিও জেনারেল শফিউল্লাহও মৌলভীপাড়ার জামাই। আমার খুব দুঃখ হতো যে ওসমান ভাই এতসব কিছু করেও কোনো খেতাব পেলেন না। আমরা ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিকদের জন্য পদক প্রবর্তন করে তাকে প্রথম সম্মানিত করেছি। তবে ওসমান ভাই একজন ভাষাসৈনিকও বটে।

১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা কলেজে পড়াবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তিনি ভাষাসৈনিক হিসাবেও পদক পেতে পারতেন কিংবা একজন লেখক হিসাবে ভাষাসৈনিক পুরস্কার পেতে পারতেন। তার রচিত এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম গ্রন্থও তাকে এনে দিতে পারত দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। তার ভাগ্যে তাও জুটল না কিন্তু শেষমেশ তিনি বেসরকারি সর্বোচ্চ পদক স্বাধীনতা পদক পেলেন। এই পদক প্রাপ্তির পরে তার মনে কী প্রশান্তি হয়েছিল জানি না। তবে আমি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলাম। আরো দুয়েকটি সরকারি দায়িত্বের ভার তিনি বহন করেছেন। ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ছাড়াও তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আন্দোলনে যোগ দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি অতি অনুরক্ত-ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে জীবনের শেষ সময়টা পর্যন্ত তিনি নিয়োজিত ছিলেন। সেক্টর কমান্ডার ফোরামের অন্যতম নেতা হিসেবেও তিনি অগ্রণী ব্যক্তি ছিলেন। সময়ের ডাকে তিনি তার শ্রদ্ধার পাত্র এ কে খন্দকারকেও ছেড়ে কথা বলেননি। আমাদের সঙ্গে আমরণ তিনি ছিলেন পরিশোধিত কুলীন, কিন্তু প্রয়োজনে দুর্বিনীত আপসহীন। বেশ কিছুদিন তিনি অসুস্থ ও নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। মাঝেমধ্যে স্মৃতিচারণ করতেন; তবে এই স্মৃতিচারণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ছিল এক ধরনের নবোদ্দীপনা ও উদ্যমের আধার। আমি ব্যক্তিগত জীবনে যখন তার সঙ্গে কথা বলতাম তিনি আমাকে নবচেতনা সঞ্চারিত করতেন। ৮৫ বছর বয়সে তিনি ছিলেন তেজোদীপ্ত যুবক, নিষ্ঠাবান ও নির্লোভ।

তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আন্দোলনে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। তার মৃত্যুতে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুহারা হলাম। সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে হাতেগোনা কজন আর অবশিষ্ট আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও নিম্নমুখী। একে একে নিভেছে দেউটি। কখন নিজের ডাক আসে তার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছি। আল্লাহর কাছে ওসমান ভাইয়ের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তিনি বেশ ধর্মপ্রাণ মানুষও ছিলেন।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা; ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App