×

জাতীয়

মানব-বন্ধু সৈয়দ আহমদুল হক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৩৪ পিএম

মানব-বন্ধু সৈয়দ আহমদুল হক

সৈয়দ আহমদুল হক

সৈয়দ আহমদুল হকের আজ নবম মৃত্যুবার্ষিকী
সৈয়দ আহমদুল হক ছিলেন একজন বিশিষ্ট ইসলামবিদ, প্রখ্যাত সুফী-সাধক, উদার মানবতাবাদী ও মহান বিশ্ব-প্রেমিক। তিনি ছিলেন আধুনিক ধর্মীয় অনুশীলনের একজন সুদক্ষ প্রবক্তা এবং ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাকার। যুক্তি ও ভক্তির সত্যমিলনে সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করা যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। আইনষ্টাইনের মতো তিনিও উপলব্ধি করেছেন, ‘Science without religion is lame, religion without science is blind.” সেজন্য সমস্ত প্রকার কুসংস্কার ও অনাচারকে অগ্রাহ্য করে আধুনিক প্রগতিশীল মন নিয়ে মানবিক ধর্মচর্চার পক্ষে জোর সওয়াল করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও ‘মানুষের ধর্ম’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। আর এজন্য তিনি অনন্য ও কৃতিত্বের অধিকারী। চট্টগ্রামের এক অভিজাত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে ১৯১৮ খৃষ্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর তিনি জন্ম গ্রহণ করেন এবং ২০১১ খৃষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর বুদ্ধি ও বোধির চেতনা বৃদ্ধি পায় পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে। জীবন শুরু করেন ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। অনতিকাল পরে সরকারি আমলা হিসেবে যোগ দেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন। সরকারি পদে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাই শুধু চাকরিজীবী হয়েই জীবন কাটাতে চাননি, লেখক হিসেবেও তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। লেখনির মূল রসদ গ্রহণ করেন পবিত্র কোরান, হাদিস, ইসলামী ধর্মশাস্ত্র, সুফী-পীরদের জীবন-দর্শন এবং ইউরোপীয় কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা থেকে। তিনি ১৬টি গ্রন্থ ও অসংখ্য গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন। আল্লামা রুমী সোসাইটি বাংলাদেশ তিন খণ্ডে ‘সৈয়দ আহমদুল হক রচনাবলী’- প্রকাশ করে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটিয়েছে। তাঁর লেখনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের চিন্তা ও চেতনা বৃদ্ধি করে তাঁদের আল্লাহমুখী করা । সেজন্য ইংরাজি সাহিত্যে সুপণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাঙালি পাঠকের কথা মনে রেখে বাংলা ভাষায় লেখনী ধারণ করেন। তিনি নানা বিষয়ে লিখেছেন, -যথা ধর্ম, ইতিহাস, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য, ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রভৃতি। তবে তিনি বিশ্ববরেণ্য সুফীদের জীবন, কর্ম ও দর্শনের ওপর বেশি লিখেছেন। একথা সত্য যে, কোনো ঐতিহাসিক ও দার্শনিক তাঁর আগে বাংলা ভাষায় বিশ্বসুফীদের নিয়ে কোনো গুরুগম্ভীর আলোচনা করেননি, যদিও অনেকেই বঙ্গসুফী ও ভারতীয় সুফীদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেজন্য স্বাভাবিক কারণে তিনি কৃতিত্বের দাবিদার।
মৌলানা জালালউদ্দিন রুমী ছিলেন সৈয়দ আহমদুল হকের আদর্শ- যার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ মসনভীকে ‘ফার্সী ভাষায় কোরান’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রুমীর মত ও পথকে তিনি সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। রুমীর প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ ও অসীম শ্রদ্ধা। তাই এই মহামানবের উদার, মানবিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে বিচার ও বিশ্লেষণ করে পাঠকের অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন। সেজন্য গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকও তাঁকে ‘বাংলার রুমী’ - অভিধায় ভূষিত করেছেন।
সৈয়দ আহমদুল হক ছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ। বাংলা, ইংরাজি, আরবি, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। সেজন্য তাঁর লেখায় যেমন ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্য এবং সুফী অতীন্দ্রয়বাদ জায়গা পেয়েছে, তেমনভাবে আধুনিক বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্যও জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর রচনায় রুমী, জামী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ, সামসের তাবরেজ, ইবনুল আরাবী, ঈমাম গাজাল্লী প্রভৃতি সুফী-সাধকদের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন যেমন দেখা যায়, ঠিক তেমন ভাবেই দেখা যায় ইংরাজ কবি ও সাহিত্যিক শেক্সপীয়ার, টেনিশন, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, উইলিয়ম ব্লেক, লংফেলো প্রভৃতির চিন্তা-চেতনার আভাস। এছাড়া বাংলার সুফী সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও যোগ সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকদের, যথা চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, লালন ফকির, হাছন রাজা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে এসকল কবি কতটা সুফী ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্ত কতখানি রুমী ও হাফিজের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন সে বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে সুফী দর্শন ও ভারতীয় দর্শন একে অন্যকে কেমনভাবে প্রভাবিত করেছে এবং প্রাণবন্ত হয়েছে। সৈয়দ আহমদুল হক ছিলেন মানব-বন্ধু। ইসলামের পয়গম্বর কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মানুষের বুদ্ধির মুক্তি কামনা করেছেন। মানুষকে একতাবদ্ধ হতে আবেদন জানিয়েছেন। তাদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছেন। সর্বোপরি তাদের মানবিক করে তুলতে আমরণ চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে নৈতিকতা হল ধর্মের মর্মবাণী। সঙ্গত কারণেই নিজের মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিদ্যালয় তৈরি করেছেন। তাঁর অমর কীর্তি হ’ল জীবদ্দশায় ১৯৯২ সালে রুমী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বে শান্তি, সম্প্রীতি, সমন্বয় ও অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সুফীদের উদার মানবতাবাদী বাণী ও দর্শনের প্রচার ও প্রসার। বিশেষ করে মৌলানা রুমী চর্চার একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। তাঁর স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। রুমী সোসাইটি আজ বিশ্ব মানবের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ মাহমুদুল হকের অকৃত্রিম ও নিরলস প্রচেষ্টায়। এ প্রতিষ্ঠানের মূল স্লোগান হয়ে ওঠেছে ভালোবাসা ও মানবতা। কাব্য করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘ভালোবাসি নারী-নরে, ভালোবাসি চরাচরে’- এই মন্ত্র উচ্চারিত হোক রুমী সোসাইটি থেকে। দুঃখের ও বেদনার কথা হলো এই যে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মহাপ্রাণ সৈয়দ আহমদুল হক আজ থেকে ন’বছর আগে আজকের দিনে এ ধরাধাম থেকে চির বিদায় নিয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। পরিশেষে বলি, বাংলার রুমী সৈয়দ আহমদুল হক মানুষকে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সুন্দর পথের সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের তীব্র সংকট চলছে। চোখ খুলে দেখলে সারা বিশ্বে এই সংকটের ভয়াবহ রূপ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবতেও কষ্ট হয় এর ভয়াবহ পরিণতির কথা। তাই বলি, সুখে-দুঃখে, উৎসবে-আনন্দে, সংগ্রামে-রাষ্ট্র বিপ্লবে, ধর্ম সাধনায় এবং মানবতার সেবায় সৈয়দ আহমদুল হকের সেই আদর্শের ধ্রুবতারা আমাদের পাথেয় হয়ে থাকুক, পথ দেখাক প্রীতি ও মিলনের, জয়গান করুক মানবতার! লেখক: অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভারসিটি, শিলং, ভারত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App