×

মুক্তচিন্তা

মানবিক সম্পর্ক ক্রমাগত ভেঙে পড়ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:২৮ পিএম

আগামীতে নতুন কোনো করোনা ভাইরাসের আক্রমণ নাও ঘটতে পারে, কিন্তু সামাজিক ভ‚মিকম্প হয়তো ঘটবে, তাতে এবার যা ঘটল সে ঘটনাকে হয়তো নিতান্ত সামান্য ধ্বংসকার্য বলেই মনে হবে। তেমনটা যাতে না ঘটে তার জন্য বিশ্বব্যাপী আন্দোলন প্রয়োজন; প্রয়োজন তেমন একটি আন্দোলন যা নৈরাজ্যিক ভ‚মিকম্পকে রুখে দিয়ে সামাজিক বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলবে। ব্যাপারটা দাঁড়াবে এই রকমের : হয় সামাজিক বিপ্লব, নয় নৈরাজ্য; মাঝামাঝি কিছু নেই।
একশ বছর আগে ১৯১৯ সালে কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস একটি কবিতা লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘দি সেকেন্ড কামিং’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে, যুদ্ধ যে কেবল ধ্বংসকার্য চালিয়েছে তা-ই নয়, মানবিক মূল্যবোধগুলোকেও দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত কবি তখন চারদিকে অন্ধকার ও নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। ইতিহাসের অগ্রগতিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন না; ভাবতেন ইতিহাস বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ, বৃত্তের প্রসারণ আছে কিন্তু বৃত্তের বন্ধন থেকে ইতিহাসের মুক্তি নেই। বাইবেলের শেষ খণ্ডে একটা আশার বাণী উচ্চারিত আছে। সেটি হলো, মানব জাতির প্রাণকর্তা হিসেবে একদা যেমন যিশু খ্রিস্ট এসেছিলেন, তেমনি আরো একজনের আবির্ভাব ঘটবে, অশুভকে যিনি দমন করবেন। চারপাশে ধ্বংসের উৎসব দেখে কবি ইয়েটস কিন্তু শুভ কোনো শক্তির আবির্ভাবের আশা করতে পারেননি। তার আশঙ্কা আসবে ভয়ঙ্কর এক প্রাণী, দেহটা যার সিংহের মতো, মাথাটা মানুষের। ভয়ঙ্কর সেই জন্তু ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্য গতিতে এগিয়ে যাবে এবং মানুষের সভ্যতাকে গিলে খাবে। ইয়েটসের অনুরাগী পাঠকরা বলেন যে কবির ভবিষ্যদ্বাণী যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। কবিতাটি লেখার ২০ বছরের মধ্যেই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে। ইয়েটস অবশ্য বিবেচনার মধ্যে নেননি মস্ত এই ঘটনাকে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেই ১৯১৭ সালেই রুশ দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে গেছে। খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন, কিন্তু ওই বিপ্লবকে মানুষের মুক্তির জন্য কোনো সুসংবাদ বলে বিবেচনা করেননি। হয়তো মনে করেছেন যে নৈরাজ্যকে তিনি চতুর্দিকে দেখতে পাচ্ছিলেন এটি তারই অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিনি দেখে যাননি, তার মৃত্যু ১৯৩৯ সালে, আর কয়েক বছর জীবিত থাকলে ভয়াবহ আরেকটি যুদ্ধই শুধু নয় চীনের বিপ্লবও দেখতে পেতেন, যদিও বিপ্লব দেখে মোটেই তিনি খুশি হতেন না। সভ্যতাগ্রাসী যে প্রাণীটিকে তিনি অগ্রসর হতে দেখেছিলেন সামাজিক বিপ্লবকে সেটির তৎপরতার অংশ হিসেবেই হয়তো গণ্য করতেন এবং কাতর হবেন। কিন্তু হতাশাবাদী এই কবি-সাহিত্যকরা যাই বলুন মানব জাতির ইতিহাস কিন্তু এগিয়েছে এবং বিশেষভাবে এগিয়েছে সামাজিক বিপ্লবের কারণেই। যে বিপ্লব শুধু রাশিয়া ও চীনেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘটেছিল। সামাজিক বিপ্লবের দুটি বস্তুগত শর্ত থাকে। একটি হলো বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে ঘর সামলাতে অপারগতা; অন্যটি ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক-বিপুলসংখ্যক মানুষের অনাস্থা ও বিক্ষোভ। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে উভয় শর্তই পূরণের পথে আরো এগিয়ে যাবে। ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ার দশা হবে। কিন্তু ভাঙার পরে গড়ার যদি কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকে তাহলে অবস্থাটা দাঁড়াবে চরম নৈরাজ্যের, যার আশঙ্কা ইয়েটস প্রকাশ করেছেন তার ওই কবিতায়। নৈরাজ্যের পরিবর্তে পৃথিবীব্যাপী নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় তার জন্য বিপ্লবের বস্তুগত শর্ত পূরণের পাশাপাশি দরকার পড়বে সুসংগঠিত আন্দোলনের এবং নেতৃত্বের। আন্দোলনের ভেতর থেকেই নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। কিন্তু আন্দোলনের জন্য ব্যাপক ও গভীর সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিও চাই। করোনার সময়ে যেমন নিপীড়ন বেড়েছে তেমনি আবার বিক্ষোভও দেখা দিয়েছে। বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা যে নিজেকে সামলাতে পারছে না সেটা খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। করোনা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার আচ্ছাদনটি খুলে ফেলে তার দুর্বলতাকে পুরোপুরি উন্মোচিত করে দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ করোনা সংক্রমণের ভীতি উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমে এসেছে। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে খোদ আমেরিকাতে। জর্জ ফ্লয়েড নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক ব্যক্তিকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ বুট দিয়ে গলা চেপে ধরে হত্যা করেছে। এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। আগেও অনেক ঘটেছে এবং প্রতিবাদও হয়েছে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আন্দোলন ধারার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং। সে ধারা স্মরণীয় হয়ে আছে, কিন্তু তার নেতা কিং নিহত হয়েছেন আততায়ীর গুলিতে। এবারের আন্দোলনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দুটি। একটি হলো এটিতে কেবল যে কৃষ্ণাঙ্গরাই যোগ দিয়েছেন তা নয়, এসেছেন শ্বেতাঙ্গরাও। দ্বিতীয়ত, এটি কেবল যে আমেরিকার কয়েকটি শহরেই সীমিত তাও নয়, গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে তো বটেই, ইউরোপেরও অনেক শহরে বর্ণবাদবিরোধী মানুষকে রাস্তায় বের হয়ে আসতে দেখা গেছে, করোনার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্তে¡ও। এবং এর ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নীরবে মানোন্নয়ন ঘটে গেছে। ইতিহাস সম্পর্কে বলা হয় যে তার সম্পাদনা সম্ভব নয়। সেটা ঠিক; কিন্তু ইতিহাস যে পুনর্লিখিত হয় সেটাও তো ঠিক। ওই পুনর্লিখনের সময় মনে হয় এসে গেছে। কারণ নিপীড়িত মানুষ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে; বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি তাদের আর কোনো আস্থা নেই। নতুন যুগের ইতিহাসে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আর বীর থাকছেন না, ভিলেনে পরিণত হয়েছেন। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতারা যে দাস ব্যবস্থার সঙ্গে কেবল আপসই করেননি কেউ কেউ যে দাস-মালিকও ছিলেন চেপে রাখা সেই সত্যও আচ্ছাদন ভেদ করে বের হয়ে আসছে। এমনকি জর্জ ওয়াশিংটনকেও নতুনভাবে দেখা হচ্ছে। উড্রু উইলসন ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, রবীন্দ্রনাথ তাকে তার ন্যাশনালিজম নামের বক্তৃতা-সংকলনটি উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। উইলসনের সম্মতি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। উইলসন ছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টও; সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবির মুখে তার নামে প্রতিষ্ঠিত একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। সবই সাম্প্রতিক বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের ফল। তার ঢেউ এসে লেগেছে ব্রিটেনেও। রবার্ট ক্লাইভের, এমনকি ‘জাতীয় বীর’ ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইনস্টন চার্চিলের মূর্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনেও আপত্তি উঠেছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বদান্যতার জন্য সিসিল রোডস নন্দিত ছিলেন; রোডস স্কলারশিপ গবেষকদের কাছে কাক্সিক্ষত ধন ছিল; কিন্তু তিনি যে দক্ষিণ আফ্রিকাতে উপনিবেশ বিস্তারের নায়ক ছিলেন ওই সত্যটা এখন আবরণের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে। ঝড়ো হাওয়ায় এটাও লুকানো থাকছে না যে বয়-স্কাউট আন্দোলনের ভুবনবিখ্যাত নায়ক রবার্ট বেডন-পাওয়েলেরও যোগ ছিল ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে। আমাদের দেশে ব্রতচারী নৃত্যের প্রবর্তক ও প্রচারক আইসিএস গুরুসদয় দত্তের ভ‚মিকার নবমূল্যায়নও মনে হয় বাকি থাকবে না। অপরদিকে আমেরিকায় বার্নি স্যান্ডার্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য এমনকি দলীয় মনোনয়ন পেতেও ব্যর্থ হয়েছেন বটে, তবু সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যে আমেরিকায় ধনীদের জন্য ত্রাসের কারণ এবং বিক্ষুব্ধ যুবকদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তা তো মিথ্যা নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ‘র‌্যাডিকাল লেফট’-এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বসে আছেন সেটা এমনি এমনি ঘটেনি। আগামীতে আমেরিকার পক্ষে আর আগের মতো পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অবস্থানে থাকা সম্ভব হবে না। র‌্যাডিকাল লেফটই থাকতে দেবে না। এসব ঘটনা ইতিহাসের অগ্রগতির লক্ষণ বৈকি। বাংলাদেশে যত্রতত্র ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’র বিজ্ঞাপন শোভা পেত। ওই পণ্যটি গায়ে মাখলে গায়ের রং ফর্সা হবে, এটাই ছিল বার্তা। ওই বিজ্ঞাপন থেকে ফেয়ার শব্দটি এখন মুছে ফেলা হয়েছে। নতুন বার্তাটা এই যে লাভলি হওয়াই যথেষ্ট, ফর্সা না হলেও চলবে। আগামীতে বিউটি কনটেস্টও আর থাকবে না বলে আশা করার কারণ আছে। কিছুদিন আগেও এসব ছিল অকল্পনীয়, কিন্তু এখন ঘটছে, কারণ বিশ্বে এখন একটি নবজাগরণের প্রস্তুতি চলছে। এই জাগরণ যদি সর্বত্রব্যাপ্ত ও গভীর হয় তবেই বিপন্ন বিশ্ব রক্ষা পাবে। নইলে মহাঅরাজকতা যে দেখা দেবে তা নিশ্চিত। আগামীতে নতুন কোনো করোনা ভাইরাসের আক্রমণ নাও ঘটতে পারে, কিন্তু সামাজিক ভ‚মিকম্প হয়তো ঘটবে, তাতে এবার যা ঘটল সে ঘটনাকে হয়তো নিতান্ত সামান্য ধ্বংসকার্য বলেই মনে হবে। তেমনটা যাতে না ঘটে তার জন্য বিশ্বব্যাপী আন্দোলন প্রয়োজন; প্রয়োজন তেমন একটি আন্দোলন যা নৈরাজ্যিক ভ‚মিকম্পকে রুখে দিয়ে সামাজিক বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলবে। ব্যাপারটা দাঁড়াবে এই রকমের : হয় সামাজিক বিপ্লব, নয় নৈরাজ্য; মাঝামাঝি কিছু নেই। নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির লক্ষণ তো এখন বিশ্বের সর্বত্র। এই প্রবন্ধ লিখতে লিখতেই আমাদের নিজেদের দেশের একদিনের খবরগুলো চোখে পড়ল। ১৬ জুলাইয়ের একটি দৈনিকের প্রথম ও শেষ পাতার কয়েকটি খবর : ‘টাঙ্গাইলে একই পরিবারের ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা’; ‘খুলনায় ভাইদের নিয়ে গুলি চালিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা, নিহত ৩, পিটিয়ে হত্যা আরেকজনকে’; ‘মা-বোনকে এসআইয়ের মারধর, অপমানে কিশোরের আত্মহত্যা’। একটি হেডিং বলছে করোনাকালেও থেমে নেই পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, ভেতরের খবর : ‘৬ মাসে বিচারবহিভর্‚ত হত্যা ১৫৮, পুলিশি নির্যাতনে ১১ জনের মৃত্যু’। আরো কিছু খবর : ‘আসামির ছুরির আঘাতে প্রাণ গেল পুলিশ কর্মকর্তার’; ‘চট্টগ্রামে সংগীত-ভবনে হামলা-ভাঙচুর, অধ্যক্ষা লাঞ্ছিত’; ‘ঢাকার নব্য জেএমবির নারী শাখার ভারতীয় সংগঠক গ্রেপ্তার’; ‘সোনারগাঁওয়ে সাধারণ মানুষের জমি দখল করেছে মডার্ন গ্রুপ’। করোনা সার্টিফিকেট নিয়ে জোচ্চুরির আসামিদের সম্বন্ধে দুটি খবর তো আছেই, আছে স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদার চক্রের তৎপরতার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। একটি বড় শিরোনামÑ ‘কোভিড হাসপাতাল গোটানোর চিন্তা’। দৈনিকটির প্রথম পাতায় আছে বন্যায় ভাসমান মানুষের ছবি। রয়েছে এই খবর, ‘বন্যায় ঘরের চালে অনেকের বসবাস’। যা বলছিলাম; খবরগুলো একটি দৈনিকের একদিনের প্রথম ও শেষ পাতার। সব মিলিয়ে তথ্য এই যে মানুষ নিরাপদে নেই এবং সামাজিক সম্পর্ক তো অবশ্যই, মানবিক সম্পর্কগুলোও ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App