×

বিনোদন

কাদা ছোড়াছুড়ির শেষ কোথায়?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৫৩ পিএম

কাদা ছোড়াছুড়ির শেষ কোথায়?

ফাইল ছবি

গ্রামের এক চাষির একটি হাঁস ছিল। হাঁসটি রোজ একটি করে সোনার ডিম দিতো। এতে চাষির লোভ বেড়ে যায় এবং সে একসঙ্গে অনেক ডিম পাওয়ার আশায় হাঁসটিকে মেরে ফেলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই, হাঁসটির থেকে সে একটি ডিমও পেলো না। এই গল্প ছোটবেলায় সবারই পড়া।

আমাদের দেশের বর্তমান সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মৃত হাঁসটির মতো। একদল অসাধু লোক লাভের আশায় যাচ্ছেতাইভাবে সিনেমা নির্মাণ করে সিনেমা ও ইন্ডাস্ট্রির বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। সে সময়টাকে আমরা অশ্লীল বা সিনেমার জন্য কালো অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। শুধু সিনেমায় অশ্লীলতা নয়। সব সিনেমার জন্য দর্শক হয়েছে হলবিমুখ। ফলে একে একে দেশের হলসমূহ বন্ধ হতে শুরু করে। বর্তমানে এসে দেশের হল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে হাতেগোনা।

একটি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙ্গা রাখতে প্রতি বছর কম পক্ষে ১০০ সিনেমা মুক্তি দেয়া উচিত। কিন্তু গত দুই দশকে দেশে অর্ধশত কিংবা তার চেয়ে কিছু সংখ্যক বেশি সিনেমা মুক্তি পায়। যার মধ্যে বিদেশি আমদানি সিনেমাকেও রাখা হয়। সুতরাং এক কথায় বলতে গেলে একদিকে কালো অধ্যায়ে ডুবে থাকা আমাদের সিনেমা, কালের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া সিনেমা ও রুগ্ন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে আমরা কোনো রকমে বেঁচে আছি আশায়, হয়তো ফিরবে সোনালি দিন।

অবশ্য কয়েক বছর ধরে সে দিনের আগমনী পথ রচিতও হচ্ছে। মূলধারার বাইরের কিছু সিনেমা নির্মাতা কনটেন্টধর্মী সিনেমা নির্মাণ করতে শুরু করেছেন। তাছাড়াও কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিল যে সিনেমা হল তাকে বাঁচিয়ে রেখে আধুনিকায়ন করতে দেশে আগমন ঘটে আন্তর্জাতিক মানের মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল। সব মিলিয়ে আমাদের সিনেমা, সিনেমা হল ও ইন্ডাস্ট্রিকে একটি মানসম্মত জায়গা করে দিতে আমরা যখনই কাজ করতে শুরু করেছি ঠিক তখন সিনেমা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংগঠনের নেতৃস্থানীয় নেতাগণ নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করেন। সাংগঠনিক নীতিমালা না মানায় অভিনয়শিল্পী সমিতির বর্তমান সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে অভিযুক্ত করা হয়।

এছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, অবৈধভাবে সংগঠনের সদস্যদের সদস্যপদ অবৈধভাবে বাতিল করে তারা ক্ষমতা দখল করেছেন, সাংগঠনিক ক্ষমতা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছেন। এসব অভিযোগে দুজনকে অভিযুক্ত করে সিনেমা সংশ্লিষ্ট ১৮ সংগঠন তাদের বয়কট করার আহ্বান জানায়। কোনো নির্মাতা, প্রযোজক তাদের দুজনকে নিয়ে কাজ করতে চাইলে বা করলে সে নির্মাতা ও প্রযোজকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে হুঁশিয়ারি জানানো হয় ১৮ সংগঠন থেকে।

এই বয়কটের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পী সমিতি এক সংবাদ সম্মেলন করে তাদের পক্ষ থেকে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে জানান, তাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত বয়কট প্রত্যাহার না করা হলে তারা কর্মবিরতিতে যাবে। এছাড়াও সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে চিত্রাভিনেতা ডিপজল মিশা-জায়েদের পক্ষ নিয়ে বলেন, ‘মিশা-জায়েদ তো কোনো দলাদলি করেনি, ওরা তো না জাতীয় পার্টি, না বিএনপি, না প্রযোজক সমিতি, না শিল্পী সমিতি। ওরা তো কাজ করছে শিল্পীদের নিয়া। শিল্পীরা কী খাচ্ছে, না খাচ্ছে তা দেখা ওদের দায়িত্ব। ওরা সে দায়িত্ব পূরণ করছে আমার মনে হয়। আগামীতেও করবে। এই যে সামনে একটা ঈদ। এই ঈদে লড়াচড়া কইরা সরায়ে দিলো যাতে আপনাদের পাশে থাকতে না পারে। সরকারের থেকে শিল্পীদের জন্য টাকা আসবে। মোটামুটি ৯৮ পার্সেন্ট কমপ্লিট। এইটারে একটু খোঁচাখুঁচি কইরা বন্ধ কইরা দেয়ার চেষ্টা করল আর কি!’

মিশা সওদাগরের আল্টিমেটামের পাল্টা জবাব দেন পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। তিনি জানান, মিশা-জায়েদ কর্মবিরতিতে যেতে চাইলে যেতে পারে। কিন্তু মিশা-জায়েদের বিরুদ্ধে বয়কটের ফলে তাদের নিয়ে কেউ কাজ করতে আগ্রহী নয়।

এমন বক্তব্য পাল্টা বক্তব্যের মাঝে শিল্পী সমিতি থেকে সদস্যপদ হারানো ১৮৪ জন শিল্পী মানববন্ধন করে এফডিসির প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায়। তারা মানববন্ধনস্থল থেকে মিশা-জায়েদের পদত্যাগ এবং ১৮৪ জন শিল্পীর সদস্যপদ ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান। বঞ্চিত শিল্পীরা গঠন করেন ফের আরো একটি সংগঠন; নাম দেন ‘চলচ্চিত্র শিল্পী অধিকার রক্ষা ফোরাম’।

মিশা-জায়েদকে ১৮ সংগঠনের বয়কটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চিত্রনায়ক ও সাংসদ ফারুক বলেন, ‘শিল্পীকে বয়কট বা অবাঞ্ছিত করার অধিকার পৃথিবীর কারো নেই।’ অথচ এক সময় চলচ্চিত্রে ১৮ সংগঠনের পক্ষ থেকে শাকিব খানকে বয়কট করা হয়েছিল। সে বিষয়টি টেনে চিত্রনায়ক ওমর সানী বলেন, ‘একটু ভেবে দেখেন বড় ভাই, শাকিব যখন অবাঞ্ছিত হন তখন কি তিনি শিল্পী ছিলেন না? আপনি বলেছেন, চলচ্চিত্রের জন্য সময় নষ্ট করেছেন।

বড় ভাই, এই চলচ্চিত্রের জন্যই আপনাকে সবাই চিনেন এবং আজকে আপনি এমপি হয়েছেন। আপনি বলেছেন, রাজনীতির জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য আপনার সময় নষ্ট হয়েছে। অসমাপ্ত কথা- জাতির পিতার দেশে আজকে আপনি আওয়ামী লীগের এমপি। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বিশ্বাস করে এমপি বানিয়েছেন। একটু ভেবে দেখেন, কাদের জন্য চরম অগোছালো কথা বললেন। আমার ব্যর্থতা, আমার চরম পিক টাইমে আপনাকে চলচ্চিত্রে খুব একটা পাইনি।’

এমন উত্তপ্ত সময়ে গত ১৫ আগস্ট এফডিসিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে শোকসভার আয়োজন করে চলচ্চিত্র সংগঠন। সে অনুষ্ঠানে বিনা আমন্ত্রণে হঠাৎ করেই উপস্থিত হন মিশা সওদাগর। বিষয়টি নিয়ে সে সময় কোনো বাক-বিতণ্ডায় যাননি উপস্থিত নেতাকর্মীরা। কেননা এমন একটি মুহূর্তকে কোনোভাবেই কলঙ্কিত করতে চাননি তারা। এ বিষয় নিয়ে প্রযোজক-প্রদর্শক সমিতির সভাপতি খোরশেদুল আলম খসরু বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সে নিজেই এসেছে। তাছাড়া ইতোমধ্যেই মিশা সওদাগর আমাদের সব নীতিমালা মেনে নিবে এই মর্মে চিঠি দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে ওমর সানী বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে মিশার কাছে অনুরোধ করেন তিনি যেনো জায়েদ খানকে সমিতি থেকে বহিষ্কার করেন এবং সিনেমার স্বার্থে সব নিয়ম-নীতি মেনে চলেন। অন্যদিকে এসব কাদা ছোড়াছুড়িতে বিরক্ত হয়ে চিত্রনায়ক শাকিব খান বলেন, একটি গোষ্ঠী এফডিসিকে দেশের আপামর মানুষের কাছে বিতর্কিত করে চলছে, প্রকৃত শিল্পীদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করেছে। কর্মপরিবেশ নষ্ট করে চলছে; যখনই সিনেমায় সুদিন দেখতে পাই, তখনই গুটিকয়েক মানুষ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইন্ডাস্ট্রিকে পিছিয়ে দেয়।

এই যে এত এত অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তার মধ্যে কোথাও সিনেমা নিয়ে ভাবনার বিন্দুমাত্র আঁচ নেই। সিনেমার উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব, কীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হল পুনরায় খোলা যেতে পারে- সেসব বিষয়ে কার্যক্রমের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত সংঘর্ষ দেখা যাচ্ছে। সিনেমার উন্নয়নে তাদের কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলেই জবাব পাওয়া গেছে, প্রক্রিয়াধীন! কিন্তু এই প্রক্রিয়ার শেষ গত দুই দশকেও হয়নি। যা আমরা সিনেমার বর্তমান পরিস্থিতি দেখলেই বুঝতে পারি। সিনেমার স্বার্থের চেয়ে ঠিক কোনো বিষয়ে তারা সাংগঠনিকভাবে তৎপর? এমন একটি প্রশ্ন জাগে। তবে অজান্তেই মনে উঁকি দেয় তারা কি ওই চাষির মতো অনেক ডিমের আশায় হাঁসটির মতো সিনেমা, সিনেমা হল ও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে বলি দিচ্ছে? তবে এখানে লোভী চাষি কারা?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App