×

জাতীয়

অপকর্মে ‘বাধা’ হওয়াতেই হামলার শিকার ইউএনও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:২৮ পিএম

অপকর্মে ‘বাধা’ হওয়াতেই হামলার শিকার ইউএনও

ইনসেটে: বাম থেকে শাহেনশাহ, আসাদুল ও জাহাঙ্গীর

ভোরের কাগজের অনুসন্ধান

হামলাকারীদের অপকর্ম আর অবৈধ কর্মকাণ্ডে বাধা হওয়ার কারণেই নির্মম হামলার শিকার হতে হয়েছে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজলা নির্বাহী র্কমর্কতা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমকে। মাদকব্যবসা, বালুমহাল, খাসজমি, পুকুর দখল, হাটের ইজারার টাকা মওকুফের পাশাপাশি চাঁদাবাজিতে বাধা হওয়া ছাড়াও নানা সময়ে মতের অমিল হওয়াতে ক্ষুব্ধি ছিলেন হামলাকারীরা।

তবে ডাকাতির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। ধরা পড়ার পর ঘটনার দিক ঘুরিয়ে দিতেই ডাকাতির বিষয়টা সামনে আনার চেষ্টা করা হয়। ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে এসব তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সরকারি বাসভবনে ইউএনওর ওপর চালানো নির্মম নিষ্ঠুর হামলাকে পরিকল্পিত হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই ঘোড়াঘাট উপজেলায় খাসজমি দখলের কর্মযজ্ঞ চলে আসছে। যিনি যত বেশি ক্ষমতা ও পেশিশক্তি প্রয়োগ করতে পারেন তিনি তত বেশি জমি দখলে নিতে পারেন। অভিযোগ রয়েছে, খোদাদাতপুর কলোনিপাড়ায় বিশাল অংশের খাস জমি দখলের পাঁয়তারা করছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ঘটনার পেছনে ছিলেন ঘোড়াঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাফে খোন্দকার শাহনেশাহ। তবে এতে নিয়ম-কাণুন দেখিয়ে ইউএনও ওয়াহিদা খানম আপত্তি তুলেছিলেন। যা ভালোভাবে নিতে পারেননি শাহেনশাহ।

আরো অভিযোগ আছে, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে অনেক কাজেই ইউএনওর সঙ্গে শাহেনশাহর মতের অমিল ঘটেছিল। এসব ঘটনার জের ধরেই শাহেনশাহের পরিকল্পনায় তার ক্যাডার যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম ও আসাদুল ইসলাম ইউএনওকে শায়েস্তা করতে সরকারি বাসভবনে হানা দিয়েছিল বলে ধারণা করছেন এলাকাবাসী। তবে ধরা পড়ার পর আসল দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতেই ডাকাতির বিষয়টা সামনে আনার চেষ্টা করে তারা।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীর আলম যুবলীগের ঘোড়াঘাট উপজেলার আহ্বায়ক নির্বাচিত হলেও এর মাস কয়েক আগেই ওই থানার সম্মেলন করে কমিটি দেয়া হয়েছিল। রাতারাতি শাহনেশাহ এক হয়ে যুবলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে হাত করে সুপারিশের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরকে আহ্বায়ক করেন।

অভিযোগ আছে, ওমর ফারুক চৌধুরীকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হাত করেন শাহেনশাহ। এরপর থেকেই তার পক্ষ হয়ে সব কাজ করে জাহাঙ্গীর গ্রুপ ও স্থানীয় যুবলীগ। শাহেনশাহর সঙ্গে আছেন স্থানীয় কৃষকদলের সাবেক সভাপতি বর্তমানে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউনুস আলীও। ২০১৯ শাহেনশাহর তদবিরেই তিনি ঘোড়াঘাট পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। আর জাহাঙ্গীর গ্রুপকে দিয়ে বালুমহাল, খাসজমি, পুকুর দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম ঘটানো হয়।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহেনশাহ এক সময়ে দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক ও দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের শিষ্য ছিলেন। তবে জবরদখল করে উপজলো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর শিবলী সাদিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। অন্যদিকে জেলা সভাপতি ফিজারের সঙ্গে এখন সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন তিনি।

তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুর রাফে খোন্দকার শাহনেশাহ ভোরের কাগজকে বলেন, আমি রাজনীতিবিদ, রাজনীতি করি। সবাই আমার কাছে আসে। তবে কোনো অপরাধীকে আমি প্রশ্রয় দিই না। রাজনতৈকি কারণে আমার অবস্থান নষ্ট করতে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। শাহনেশাহ আরো বলেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে করা কমিটি ভেঙে দিয়ে কে জাহাঙ্গীরকে ঢাকা থেকে নেতা বানিয়ে এনেছেন খোঁজ নেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক বলেন, এসব চাঁদাবাজ, ভূমি দখলকারী দলে না থাকাই ভালো। এরা দলে থেকে ক্ষতি করছে।

এদিকে, র‌্যাবের তদন্তকারী দলের হেফাজতে থাকা জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ঘটনা ভিন্ন খাতে চলে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে বিকেল অবধি চার জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম, যুবলীগের সদস্য আসাদুল ইসলাম, ৩নং সিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মাসুদ রানা ও নৈশপ্রহরী নাহিদ হাসান পলাশ।

তবে আটকদের মধ্যে নৈশপ্রহরী নাহিদ হাসান পলাশ বাদে সবার নামেই আছে একাধিক মামলা। রয়েছে মাদকের ব্যবসা, মাদক সেবন, জমি দখল করার অভিযোগ। চাঁদাবাজি, ত্রাণ চুর, মেয়র, এমপিসহ সাধারণ মানুষকে নির্যাতনের অভিযোগ। এছাড়া গেল কয়েকদিন আগে বালুমহাল নিয়ে ইউএনওর সঙ্গে আটককৃতদের ঝামেলা হয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানান।

অনুসন্ধানে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়কসহ অন্যান্য নেতার বিভিন্ন অপর্কমের কথা বেরিয়ে আসে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, জাহাঙ্গীর-আসাদুল ও মাসুদ বাহিনীর কাছে জিম্মি ঘোড়াঘাট উপজেলার অনেকেই। এদের কাছে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, হামলা-মামলা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের এসব অপর্কম দূর করতেই ইউএনও ওয়াহিদা খানম জাহাঙ্গীর-আসাদুল ও মাসুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। স্থানীয়দের ধারণা, এসব কারণেই ইউএনওর ওপর চড়াও হন তারা।

অনুসন্ধানকালে যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিওবার্তা ভোরের কাগজের হাতে আসে। তাতে দেখা যায়, ওই যুবলীগ নেতা হাকিমপুরের হিলি এলাকায় গিয়ে মাদক সেবন করছেন। এ সময় হাতেনাতে পুলিশের কাছে আটক হলেও নিজেকে আওয়ামী লীগরে নেতা বলে পরিচয় দিয়ে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান। এছাড়াও গেল ১৩ মে ঘোড়াঘাট পৌরসভার মেয়রের ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি বানচাল করার জন্য মেয়রকে মারধর করে জাহাঙ্গীর-আসাদুল বাহিনী। ওই সময় মেয়রের মামলায় জাহাঙ্গীর আলমসহ তার বাহিনীর চার সদস্যকে আটক করেছিল পুলিশ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ বাজার এলাকায় নুনদহ ঘাটে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন সিংড়া ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি মাসুদ রানা। ইউএনও ওয়াহিদা খানম বেশ কিছুদিন আগে বালু উত্তোলনের সেসব সরঞ্জাম পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতে ইউএনওর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন মাসুদ রানা। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, গেল ১৪ মে জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানার বিরুদ্ধে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের কাছে জমি দখল ও চাঁদা দাবির অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধা সায়েদ আলীর জামাতা আবিদুর রহমান।

অভিযোগে আবদুর রহমান উল্লেখ করেন, দুই বছর ধরে জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানা ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। মৃত্যু ভয়ে তিনি ২ লাখ টাকা জাহাঙ্গীর ও মাসুদকে দেন। পরে বাকি ৩ লাখ টাকা দিতে না পারায় উপজলোর কলোনপাড়া এলাকায় এক একর জমি দখল করে নেয় জাহাঙ্গীর বাহিনী। বিষয়টি ইউএনও ওয়াহিদা খানম গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। একই সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের বিষয়ে তৎপরতা চালান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহাঙ্গীর আলম মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। গোটা উপজেলায় মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। তার নেতৃত্বে নান্নু, মাসুদ রানা, ইয়াদ আলী, নাহিদ, আবদুর রব, নবীউল ইসলামসহ কয়েকজন যুবক বাহিনী গড়ে তোলেন।

শুধু মেয়রই নয়, সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের এাণ বিতরণের সময় রাস্তা আটকে মারার পরিকল্পনা করেছিল জাহাঙ্গীর-আসাদুল ও মাসুদ বাহিনী। এ ব্যাপারে শিবলী সাদিক বলেন, ‘আটক জাহাঙ্গীর আলম একাধিক মাদক মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে গত তিন মাস আগে দল থেকে বহিষ্কার করার জন্য কেন্দ্রে চিঠি পাঠিয়েছি।’

শিবলী সাদিক আরো বলেন, করোনাকালীন নিজ তহবিল থেকে চার উপজেলায় ৬০ হাজার মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি। এরই অংশ হিসেবে ঘোড়াঘাট পৌর সভায় রাখা ত্রাণ ছিনতাইয়ের জন্য জাহাঙ্গীর আলম মেয়রকে হুমকি দিয়েছিল। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় জানতে পারি আমার ওপর হামলার জন্য রাস্তায় তারা আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। পরে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়।

এ ব্যাপারে দিনাজপুর জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর যুবলীগের আহ্বায়ক হলেও সেই কমিটি হয়েছিল তিন বছর আগের। সাধারণ নিয়মে তিন মাসের বেশি সময় হলেই কমিটির কার্যকারিতা আর থাকে না। এরপরও তাকে বহিষ্কারের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও নিয়ে সুপারিশসহ কেন্দ্র চিঠি দেয়া হয়েছিল। কারণ তাদের বহিষ্কার করার ক্ষমতা জেলা কমিটির নেই।

তবে শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জেলা যুবলীগের সভাপতি রাশেদ পারভেজ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদ রানাকে কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল নিশ্চিত করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App