×

সারাদেশ

রূপকথার বাঙালি নায়ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৩২ পিএম

বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদে বসা এই বাঙালি যেন ছিলেন রূপকথার এক নায়ক। ভারতের জনজীবনে প্রণব মুখার্জি ছিলেন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। কিন্তু এতকিছুর পরও শিকড়কে ভুলেননি তিনি কখনো।

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। প্রয়াত হলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ভারতীয় এবং উপমহাদেশের রাজনীতির কৌটিল্য ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জি ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ভারতের সর্বোচ্চ পদে তিনিই প্রথম বাঙালি। তার মৃত্যুতে ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়েই পত্নীবিয়োগ হয় প্রণব বাবুর। স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি চলে যান ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট। প্রণব বাবু রেখে গেলেন এক ছেলে ও এক মেয়েকে। ছেলে অভিজিৎ কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ, মেয়ে শর্মিষ্ঠা দিল্লি কংগ্রেসের মুখপাত্র।

অনেকেই তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছেন, তার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা উচিত ছিল। সেখানে না পৌঁছলেও তিনি বসেছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ সিংহাসনে, রাইসিনা হিলসে রাষ্ট্রপতি ভবনে। তার পরামর্শ নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, নরসিংহ রাও, মনমোহন সিং। মোট সাতবার তিনি ভারতের বাজেট পেশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি থাকার সময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও রাজনৈতিক পরামর্শ আদান-প্রদান থেকে তিনি নিজেকে একেবারেই সরিয়ে রাখতে পারেননি। প্রায়ই তার কাছে ছুটে যেতেন শাসক থেকে বিরোধী শিবিরের বড় বড় নেতা। এতটাই আন্তরিকভাবে তিনি সবাইকে পরামর্শ দিতেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাকে পিতৃপ্রতিম মানুষ বলে উল্লেখ করেছিলেন। একবার দিল্লির তিনমূর্তি ভবনের নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরিতে প্রণব মুখার্জির ‘কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২’ শীর্ষক আত্মজীবনী প্রকাশ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে আমার চেয়েও যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন প্রণব দা।’

পশ্চিম বাংলার রাজনীতির ক্ষুদ্র পরিসর ছাপিয়ে সর্বভারতীয় আঙ্গিনায় অতি সহজেই বিচরণ করেছেন প্রণব বাবু। তার জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। ‘রাজনীতি’ প্রণবের উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। অথচ সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়াও মাড়াননি তিনি। বরং ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পর মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি লাভে। তবে আইনজীবীর পোশাককে বেছে নেননি কখনোই। ডাক ও তার বিভাগে করনিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পর ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার অদূরে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি।

১৯৫৭ সালে শুভ্রাদেবীকে বিয়ের সময় প্রণব মুখার্জির আত্মীয়-পরিজনদের একাংশের আপত্তি উঠেছিল। কেননা শুভ্রাদেবী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে নন। কিন্তু প্রণব তাতে কান দেননি। বাংলাদেশের নড়াইল থেকে শুভ্রার পরিবার ভারতে গিয়েছিল। সেই সূত্রে বাংলাদেশের মাটিতে তার শ্বশুর বংশের একটা স্মৃতি জড়ানো ছিল। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে রাজনীতির মাঠে আগমন ঘটে প্রণবের। ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হরেন্দ্রনাথ প্রার্থী হন। প্রণব তার প্রচারে মাঠে নামেন। ১৯৬৯ সালের বিধানসভায় মেলে রাজ্যসভার সাংসদ পদ। সংসদীয় রাজনীতির শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়ে যান প্রণব। তারপর থেকে প্রণবকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৭১ সালে প্যারিসে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাওয়াল করার ভারতীয় প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ৩৬ বছরের প্রণব মুখার্জি। ১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের টিকেটে দ্বিতীয়বার রাজ্যসভায় সদস্য হন প্রণব। তারও আগে ১৯৭৩ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার হিসেবে প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রবেশ হয় তার। ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের মালদহে হেরেছিলেন প্রণব। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভায় পেয়ে যান বাণিজ্যমন্ত্রীর পদ। পাশাপাশি রাজ্যসভায় কংগ্রেসের দলনেতার দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি পেয়ে যান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব- হয়ে উঠেন ইন্দিরা কেবিনেটের ‘নাম্বার টু’ ব্যক্তি।

প্রণবের সময়ই ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। ইন্দিরা নিহত হওয়ার পর দ্রুত কংগ্রেসের অন্দরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন প্রণব। রাজীবের জমানায় মন্ত্রিত্ব হারান তিনি। হাই কমান্ডের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির এক পর্যায়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন প্রণব। প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ পর্বে এসে রাজীব গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন প্রণব মুখার্জির গুরুত্ব। দলে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাকে।

১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর কংগ্রেসে এবং সরকারে নরসিংহ রাওয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নরসিংহ রাওয়ের শুরুতেই প্রণব মুখার্জির পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায়। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ১৯৬৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে ছিল কংগ্রেস। ফলে প্রণবও ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। মনমোহন সিংহের সেই মন্ত্রিসভাতেও প্রণব বাবু ছিলেন নাম্বার টু।

প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, পরে হন অর্থমন্ত্রী। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন প্রণব। দেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে শুধু নিয়মতান্ত্রিক শীর্ষ পদাধিকারী হয়ে থেকে যাননি প্রণব বাবু। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বসে প্রকৃত অর্থেই দেশের এবং রাজনীতির অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন।

বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পদে বসা এই বাঙালি যেন ছিলেন রূপকথার এক নায়ক। ভারতের জনজীবনে প্রণব মুখার্জি ছিলেন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। কিন্তু এতকিছুর পরও শিকড়কে ভুলেননি তিনি কখনো। দিল্লির ক্ষমতায় এত বছর বিচরণ করেও খাঁটি বাঙালিই থেকে গিয়েছিলেন শেষদিন পর্যন্ত। সেই ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল তার প্রিয় পোশাক। তিনি ছিলেন এক নিপাট বাঙালি। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো ছোটখাটো চেহারা। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলার টান।

দিল্লিতে ৫০ বছর রাজনীতি করেও হিন্দি বলা বিশেষ রপ্ত হয়নি। প্রণব বাবু ছিলেন বাংলার সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত প্রাণ। ইংরেজির চেয়ে বাংলায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন অনেক বেশি। কিন্তু তার কাজের ক্ষেত্রে তার এই ব্যক্তিগত পরিচিতি প্রাধান্য পায়নি। তিনি তাই বাংলার নেতা না হয়ে সারা ভারতের নেতা হতে পেরেছিলেন। তিনি গোটা দেশের জন্য ভাবতেন। সেখানে ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেয়ার কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। বস্তুত এটা ধর্মের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য।

প্রণব বাবু নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন, নিজে পূজা করতেন। কিন্তু সেটা ছিল তার ব্যক্তিগত ব্যাপার- তার কাজের জগতে সেই পরিচিতির গুরুত্ব ছিল না। ধর্ম, জাতি, ভাষা, কোনো পরিচিতিই তার রাজনৈতিক বা পেশাদারি জীবনে প্রভাব ফেলেনি। বৃহত্তর অর্থে সেক্যুলার বলতে যা বুঝায় প্রণব মুখার্জি তাই ছিলেন। প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময়ে বীরভূমে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে পারিবারিক দুর্গোৎসবে পুরোহিত্য করাই ছিল তার জীবনের নিয়ম। প্রতি বছরই পূজার চার দিন তিনি কাটাতেন পৈতৃক ভিটাতে। এসব কিছু ইতিহাসের হেফাজতে রেখে চলে গেলেন প্রণব মুখার্জি। ভারতরতে্নর স্বীকৃতি পাওয়া মানুষটি ছিলেন আদ্যোপান্ত আস্তিক। বাড়ির পূজার যাবতীয় কাজ তার নির্দেশে হতো। কিন্তু দেশ চালাতে গিয়ে কখনোই ধর্মকে সামনে আনেননি তিনি। তার বিশ্বাসের ওপর ভর করে তিনি বলতেন, সহনশীলতা ভারতবর্ষের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। এটা বাদ দিয়ে ভারতবর্ষ হয় না।

আমরা তর্ক করব, ঝগড়া করব- কিন্তু সহনশীলতার সঙ্গে। তাই তিনি সর্বজনমান্যতা আদায় করে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বও সুপ্রশংস কুর্নিশ জানিয়েছে তার বোধ-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে। তার প্রয়াণে শুধু ইতিহাসের অবসান ঘটল তা-ই নয়, বাঙালির গর্বের ভাণ্ডারেও গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হলো। জাতীয় জীবনের সব জায়গাতেই পাতা ছিল তার আসন। রাজনীতি থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি, কূটনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ সবটাতেই তার বিচরণ ছিল স্বচ্ছন্দ। বহু জটিল রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তিনি ছিলেন মুশকিল আসান। আবার ক‚টনৈতিক দক্ষতার নিরিখে তিনি বিশেষিত হতেন চাণক্য অভিধায়। তিনি সেই বাঙালি, যার প্রতি সব বাঙালিরই শ্রদ্ধা জাগ্রত ছিল সবসময়।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App