×

মুক্তচিন্তা

গর্ভপাতের মামলা ও আদালতের সিদ্ধান্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:১২ পিএম

অনেক দেশই আদালতের দিকনির্দেশনা অনাকাক্সিক্ষত ভ্রুণের নিষ্পত্তির বিষয়টি সহজতর করেছে, মানবাধিকারের মৌল বিষয় যে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি তাও স্পষ্ট করেছে। এই রচনাটিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালতে গর্ভপাতের কয়েকটি মামলার নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতকে বিবেচনা করার একটিই কারণ- আমাদের পেনাল কোড এবং ভারতীয় পেনাল কোডে গর্ভপাতবিষয়ক ধারাগুলো অভিন্ন। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিই উভয় দেশ গ্রহণ করেছে।

একজন ইংরেজ স্ত্রী প্রথাগত দাম্পত্য সম্পর্কে আবদ্ধ থেকে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তিনি গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নেন। এতে তার স্বামী সম্মত ছিলেন না। স্ত্রীর গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখতে তিনি তাকে সম্মত করাতে ব্যর্থ হন। তারপর তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কোনো ধরনের ডাক্তারি পদ্ধতি অবলম্বন করে গর্ভনাশ করা থেকে স্ত্রীকে বিরত রাখতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডের হাইকোর্ট অব জাস্টিসে ইনজাঙ্কশন প্রার্থনা করেন- স্ত্রী যেন তার ‘প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট’ করতে না পারেন। হাইকোর্ট স্বামীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ভ্রুণ সন্তান হিসেবে ভ‚মিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তা পৃথক কোনো আইনি সত্তা (লিগাল এনটিটি) বলে বিবেচিত হতে পারে না। ভ্রুণ মায়েরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদালত আরো বলে, ভ্রুণধারী নারীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকুক বা না-ই থাকুক, বাবার কোনো আইনি অধিকার নেই যার ক্ষমতাবলে এই নারীকে গর্ভপাত করা থেকে প্রতিহত করতে পারেন। আদেশে আরো উল্লেখ করা হয়, উক্ত নারী তার গৃহীত অনুরূপ সিদ্ধান্ত এবং তার বাস্তবায়ন নিয়ে স্বামী বা পার্টনারের সঙ্গে আলোচনা করতে কিংবা জানাতে বাধ্য নন।

ইউরোপিয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটসের ২ নম্বর ধারাটি ব্যক্তির জীবনের ওপর অধিকার। আদালত প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অপরাধ, আইনের মাধ্যমে এই অধিকার সংরক্ষিত রাখতে হবে, এই নির্দেশ কনভেনশনভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর প্রযোজ্য। ইভান্স বনাম ইউনাইটেড কিংডম (২০০৫) মামলা ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসে উত্থাপিত হলে জে ক্যাসাডেভালের সভাপতিত্বে জজ স্যার নিকোলাস ব্রাটজা, এম পেলোনপা, আর মারুসতে, কে ট্রাজা, এল মিয়োভিক এবং জে সিকুতার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা করে। আদালত রায় দেয় ভ্রুণের ‘রাইট টু লাইফ’- জীবনের অধিকার নেই। সুতরাং নারীর গৃহীত গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত ব্যক্তির ‘রাইট টু লাইফ’ লঙ্ঘন করে না (বিস্তারিত : দ্য টাইমস ১৭ মার্ট ২০০৬)।

আগে অপর একটি মামলায় সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে ভ্রুণের জীবন মায়ের জীবন থেকে পৃথক করে দেখার উপায় নেই। একই সঙ্গে অজাত সন্তানকে জীবিত মায়ের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে জীবন বিপন্ন করারও যুক্তি নেই। গর্ভপাত বিতর্কের সঙ্গে আরো একটি বিষয় জড়িত। ভ্রুণ কখন থেকে ব্যথা পেতে শুরু করে? বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট ডার্বিশায়ার ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত তার রচনায় যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন ২৬তম সপ্তাহে পড়ার আগে ভ্রুণ ব্যথা অনুভব করে না (বিস্তারিত দ্য টাইমস ১৪ এপ্রিল ২০০৬)। তিনি বলেন, স্নায়ুর প্রান্তভাগ যা সেনসর হিসেবে কাজ করে তার পূর্ণ গঠন ২৩ থেকে ২৫ সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে এবং ২৬ সপ্তাহের মধ্যে থ্যালামাস ও কর্টেক্সের সঙ্গে সংযোগ সম্পন্ন হয়।

তার আগে এমনকি ভ্রুণ ২০ সপ্তাহেও বাইরের মৌখিক প্রণোদক উত্তেজনা যেমন সংগীত, কথোপকথন ইত্যাদিতে সাড়া দেয়; অধ্যাপক স্টুয়ার্ট ক্যাম্পবেল ৪-ডি আলট্রা সাউন্ড টেকনিক ব্যবহার করে দেখিয়েছেন শারীরিক প্রণোদনায়ও ২০ সপ্তাহের ভ্রুণ সাড়া দিয়ে থাকে। ভ্রুণের ব্যথা পাওয়ার বিষয়টি এর আগে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। অধ্যাপক স্টুয়ার্ট ডার্বিশায়ার যুক্তি দেখাচ্ছেন ২৬ সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ভ্রুণের অপসারণের প্রশ্নে তার ব্যথা পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে, সে ক্ষেত্রের ভ্রুণের জন্যও ব্যথানাশক নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি, অনেক দেশই আদালতের দিকনির্দেশনা অনাকাক্সিক্ষত ভ্রুণের নিষ্পত্তির বিষয়টি সহজতর করেছে, মানবাধিকারের মৌল বিষয় যে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি তাও স্পষ্ট করেছে। এই রচনাটিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালতে গর্ভপাতের কয়েকটি মামলার নিষ্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতকে বিবেচনা করার একটিই কারণ- আমাদের পেনাল কোড এবং ভারতীয় পেনাল কোডে গর্ভপাতবিষয়ক ধারাগুলো অভিন্ন। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিই উভয় দেশ গ্রহণ করেছে।

কয়েকটি গর্ভপাত মামলা : বোম্বে হাইকোর্ট

ক) ২০১৭-এর ডিসেম্বরে ধর্ষিত ১৩ বছর বয়সী এক বালিকার বাবা জানতে পারেন তার মেয়ে গর্ভবতী হয়ে গেছে। তিনি আরো জানতে পারেন তারই ভাস্তের হাতে মেয়েটি বারবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মেয়ের গর্ভপাতের অনুমতি লাভের জন্য তিনি যখন বোম্বে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলেন তখন বালিকাটির গর্ভাবস্থার ২৬ সপ্তাহ চলছে। আইনি বাধার কারণে অনুমতি না পাওয়ারই কথা ছিল, তবে একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে পরীক্ষা করে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে যে গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখলে বালিকার জীবন সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে মেয়েটি সন্তান প্রসবে শারীরিকভাবে অক্ষম। এ অবস্থায় গর্ভপাতের (টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি) অনুমতি দেয়া হলো।

খ) একই সময়ে একই হাইকোর্টে একজন নারী গর্ভপাতের মাধ্যমে তার ২৫ সপ্তাহ বয়সী ভ্রুণ নিষ্ক্রমণের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ড বলেছে এই বাচ্চার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে, জন্ম হলে তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী অবস্থায় জীবনযাপন করতে হবে। বোর্ড আরো বলেছে গর্ভপাতকালে গর্ভধারিণীর জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। এই নারী আদালতকে জানান তিনি জীবিত সন্তানের দুরবস্থা সহ্য করতে পারবেন না, বরং গর্ভপাতের ঝুঁকি গ্রহণ করতে তিনি প্রস্তুত। আদালত তাকে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। (যদিও বোম্বে সর্বত্রই মুম্বাই হয়ে গেছে, কিন্তু উচ্চ আদালতের নাম বোম্বে হাইকোর্টই রয়ে গেছে, পরিবর্তনে কোর্ট সায় দেয়নি।)

গ) ২৪ বছর বয়স্ক পুনার এক নারীর ভ্রুণের হৃদপিণ্ডে অস্বাভাবিকতা চিকিৎসকরা লক্ষ্য করেন। ভ্রুণের তখন ২৪ সপ্তাহ চলছে। চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন তার গর্ভপাত করাই শ্রেয়, কারণ জন্মগ্রহণ করলে শিশুটিকে বহুসংখ্যক অপারেশনের মোকাবিলা করতে হবে। আদালতও একটি মেডিকেল বোর্ডকে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে বললে তারাও একই কথা বলেন যে অপারেশনে শিশুটির জীবনাশঙ্কা থেকে যাবে। আদালত তাকে গর্ভপাত করার অনুমতি দেয়।

ঘ) ২০০৮ সালের হৃদপিণ্ডের সমস্যাযুক্ত ২৬ সপ্তাহ বয়সী একটি ভ্রুণের কারণে একজন নারী গর্ভপাতের অনুমতি গ্রহণের জন্য বোম্বে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। আদালত সব শুনে এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে আবেদন খারিজ করে বলে দেয় যে ‘যদি জন্মগ্রহণ করে, শিশুটির তেমন জটিল কোনো সমস্যায় ভুগবে না’।

গুজরাট হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের ভিকটিম ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং গর্ভস্থ সন্তানের কারণে সামাজিক লজ্জা ও নিজের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে এসিড পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে মানসিকভাবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তার গর্ভাবস্থা অব্যাহত রাখলে তার মানসিক স্বাস্থ্য ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে মা এবং গর্ভস্থ শিশু উভয়েই ঝুঁকিতে পড়বে। গুজরাট হাইকোর্টে গর্ভপাতের আবেদন করা হলে আদালত অনুমতি প্রদান করে। কর্নাটক হাইকোর্ট

১৭ বছর বয়স্ক ধর্ষণের ভিকটিম গর্ভবতী হয়ে পড়লে গর্ভপাত ঘটানোর জন্য কর্নাটক হাইকোর্টের অনুমতি প্রার্থনা করে। ভ্রুণের বয়স তখন ২০ সপ্তাহ। এর পক্ষে যুক্তি দেয়া হয় এত কম বয়সে সন্তান জন্মদান করলে সে মানসিক ভারসাম্য হারাবে। তাকে একটি মেডিকেল বোর্ডে পাঠানো হয়। বোর্ড জানায় এ সময় গর্ভপাত ঘটালে তা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হবে। হাইকোর্ট তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। দিল্লি হাইকোর্ট

১৫ বছর বয়সী একটি বালিকা অপহৃত হয়ে কথিত বন্ধুর উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়। উদ্ধার পাওয়ার পর তার গর্ভাবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য দিল্লি হাইকোর্টের অনুমতি প্রার্থনা করে। কোর্ট তাকে মেডিকেল বোর্ডে পাঠায়। বোর্ড তাকে পরীক্ষা করে জানায় গর্ভপাত ঘটাতে গেলে তারও জীবনে ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে। আদালত আবেদন নাকচ করে দেয়। মধ্যপ্রদেশ ইন্দোর বেঞ্চ অব হাইকোর্ট

১৬ বছর বয়সী ধর্ষণের ভিকটিম ও গর্ভবতী কিশোরী মায়ের গর্ভপাতের অনুমোদন প্রদানের জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে আদালত গর্ভাবস্থার সময়কাল বিবেচনায় আনে, তখন তার ৩৩তম সপ্তাহ চলছিল। আদালত আবেদন নাকচ করে দিয়ে মন্তব্য করেছে ভ্রুণের বয়স বেশি হয়ে গেছে, এ অবস্থায় গর্ভপাত অসমীচীন হবে। হরিয়ানা সিটি কোর্ট

সৎ বাবার ধর্ষণের শিকার গর্ভবতী একটি বালিকার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড গর্ভপাত অনুমোদনের জন্য আদালতে সুপারিশ করে, বোর্ড তার গর্ভকাল নিশ্চিত করতে পারেনি; বলেছে ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহ। আদালত বোর্ডকে দুটি বিকল্প নির্দেশনা দেয় : ভ্রুণের বয়স ১৮ সপ্তাহের কম বিবেচনা করে গর্ভপাত ঘটাতে পারে অথবা গর্ভপাতের আইনি সীমা অতিক্রম করেছে মনে করলে গর্ভবস্থা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতে পারে। আদেশটি যথেষ্ট নমনীয় হওয়ায় বোর্ড গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট

ধর্ষণের ভিকটিম এবং এইচআইভি পজিটিভ এক গর্ভবতী নারীর গর্ভাবস্থার অবসান ঘটাতে পাটনা হাইকোর্টের সম্মতি লাভের জন্য শরণাপন্ন হলে হাইকোর্ট আবেদন নাকচ করে দিয়ে আদেশ দেয়, এই অজাত সন্তানকে জীবিত রক্ষা করার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব সরকারের। ভ্রুণের বয়স তখন ২৬ সপ্তাহ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় চাওয়া হলে সর্বোচ্চ আদালত (১) অনুমতি প্রদান করে (২) অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সকে দায়িত্ব প্রদান করে (৩) সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ প্রদান করে যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে এবং দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে যে নারী এমনিতেই বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে তার ভোগান্তি আর বাড়ানো অনুচিত। জীবনের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের মর্যাদা রক্ষা করা এবং তা রক্ষা করার জন্যই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। ২০১৭ সালের মে মাসে এই আদেশ হয়।

নিকেতা মেহতা মামলা নিকেতা মেহতা ভারতের মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত নারী। সন্তান ধারণ কিংবা গর্ভাবস্থা ব্যাহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া এবং লভ্য মেডিকেল সহযোগিতা গ্রহণে তার কোনো বাধা নেই। তার স্বামীও স্ত্রীকে সমর্থন ও সার্বিক সহায়তা প্রদান করে থাকেন। শিক্ষায়, আর্থিক সামর্থ্যে পারিবারিক সমর্থনে এবং নিজস্ব স্বাধীনতা উপভোগে নিকেতা ভারতের অন্য যে কোনো নারীর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন। তিনি তার ভ্রুণের স্বাস্থ্য এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন। এটা তার বহুল প্রত্যাশিত প্রথম গর্ভাবস্থা। তিনি জেনেছেন ভ্রুণের হৃৎপিণ্ডে ভয়ঙ্কর সমস্যা আছে যা স্বয়ংক্রিয় গর্ভপাত ঘটিয়ে দিতে পারে অথবা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তা হবে হৃদপিণ্ডে সমস্যাযুক্ত, নিরন্তর ভোগান্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে শিশুটিকে থাকতে হবে। ভ্রুণের বয়স ভারতে ২০ সপ্তাহ হওয়া পর্যন্ত গর্ভপাতে আইনি সমস্যা নেই। কিন্তু বেআইনি গর্ভপাত তো হামেশাই হচ্ছে।

নিকেতা বেআইনি কিছু করতে চাইলেন না। তিনি এবং তার স্বামী ভ্রুণের জন্মগত সমস্যা শনাক্তকারী ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বোম্বে হাইকোর্টে হাজির হয়ে ২৩তম সপ্তাহে গর্ভপাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। যুক্তিতে বলা হলো জন্মগত স্বাস্থ্য সংকটের বেলায় ব্রিটেনে ভ্রুণের বয়সের কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। নিকেতা মেহতার দিক থেকে বলা হয় তিনি গর্ভপাত চাচ্ছেন কারণ প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দিয়ে তার যাতনার নিত্যদিনের সাক্ষী হয়ে থাকা তার ও তার পরিবারের জন্য অসহ্য কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার হবে। তিনি গর্ভপাতের অনুমতি পেলেন। কিন্তু একই সঙ্গে একটি নৈতিক প্রশ্নও সামনে চলে এলো- এটা কি প্রতিবন্ধীর বেঁচে থাকার অধিকারকে হরণ করে নিচ্ছে না?

ভারতে গর্ভপাতের প্রশ্নে একটি ‘নারী ভ্রুণ’ সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন। এ ক্ষেত্রে বিবেচনাটি আর্থিক ও সামাজিক। চীনের ওয়ান জি শাও- এক সন্তান নীতিমালা আইনকানুনের মানবাধিকারের তোয়াক্কা না করে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণকারিণীকে গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়েছে। ভারতের দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে ঘরে ঘরে অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়েছে : এখন খরচ পাঁচশ, পরে খরচ পাঁচ লাখ- কোনটা করবেন সিদ্ধান্ত নিন। পাঁচশ টাকায় কন্যাশিশুর ভ্রুণ অপসারণ করবেন না পরে পাঁচ লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেবেন? এই ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ কন্যাশিশু পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পায়নি। বাংলাদেশের অবস্থা সৌভাগ্যবশত ভারত ও চীন থেকে ভালো- কিন্তু খুব ভালো বলা সমীচীন হবে না।

ভারতের দ্য মেডিকেল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট (এমটিপি) ১৯৭১ গর্ভপাতে ভিত্তি অনেকটা সম্প্রসারিত করেছে। এমটিপির আওতায় কে গর্ভাবস্থা রহিতকরণের কাজটি করতে পারবেন তা নির্দিষ্ট করা হয়েছে : (১) মেডিকেল কাউন্সিল অ্যাক্ট অনুযায়ী যার নির্ধারিত স্বীকৃত যোগ্যতা রয়েছে। (২) যার নাম স্টেট মেডিকেল রেজিস্ট্রারভুক্ত হয়েছে। (৩) যার স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। এই আইনে গর্ভপাতের প্রশ্নে ভ্রুণের সর্বোচ্চ বয়স ২০ সপ্তাহ নির্দেশ হয়েছে।

চিকিৎসাগত সমস্যা ছাড়াও যে বিষয়গুলো রয়েছে- যেমন ধর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট গর্ভাবস্থা, প্রতারিত হওয়ার কারণে সৃষ্ট গর্ভাবস্থা দুস্থাবস্থার কারণে সন্তান পালনে অক্ষমতা, কন্ট্রাসেপটিভস ফেইলিওর-এর কারণে গর্ভাবস্থা- এ বিষয়গুলোকে বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করার সুযোগ ও আইনি সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ নিয়ে আরো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আমরাও আদালতের দিকনির্দেশনা দেখার অপেক্ষায় আছি।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App