×

স্বাস্থ্য

হুমকি বাড়ছে মেডিকেল বর্জ্যে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৫ এএম

হুমকি বাড়ছে মেডিকেল বর্জ্যে

ছবি: সংগৃহীত

ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেনি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ২০০৮ সালের আইন সংশোধনের তাগিদ

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে মেডিকেল বর্জ্য এখন বড় সমস্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনাকালে এই সমস্যা আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ এর বিধিবিধান পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন আদালত।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। দেশে প্রতিদিন উৎপন্ন মেডিকেল বর্জ্যরে পরিমানের সঠিক হিসাব নেই কারো কাছে। তবে মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল ও ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৬৩ থেকে ১ দশমিক ৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর এটা আরো বাড়তে পারে।

ল্যানসেট লিখেছে, শুধু ঢাকা শহরেই কোভিডের কারণে ২০৬ টন মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) জুন মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ টন মেডিকেল বর্জ্য সংগৃহীত হয়েছে। আর করোনাকালে তা হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৪০ লাখই শিশু। এই বৈশি^ক পরিসংখ্যানের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, হাসপাতাল ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অথচ বাংলাদেশে মেডিকেল বর্জের নিরাপদ নিষ্কাশনের কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশনের মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব বাড়ানো দরকার। ২০০৮ সালে মেডিকেল বর্জ্যরে নিরাপদ নিষ্কাশন নিয়ে আইন হলেও তা খুবই দুর্বল কিংবা যুগোপযোগী নয়। তাই আইনটি সংশোধনের দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, অদৃশ্য করোনা ভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনারও দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ৪০ বছরে মেডিকেল বর্জ্য নিয়ে খুব একটা কথা হয়নি। আবার যেটুকু কথা হয়েছে তাতে অগ্রগতি হয়নি।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন সহযোগী ও গণমাধ্যম একসঙ্গে কাজ করতে পারলে পুরো ব্যবস্থাপনা দাঁড় করানো সম্ভব। এমবিবিএস, নার্স এবং মিডওয়াইফ কারিকুলামে এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন বিশিষ্ট এই চিকিৎসক।

জানা যায়, হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশনে ২০১৮ সালে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে’র সঙ্গে চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রিজম ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের চিকিৎসা বর্জ্য নিষ্কাশনের কাজ করছে। কিন্তু তাদের যন্ত্রপাতি, বর্জ্য সংগ্রহকারী ট্রাক এবং লোকবলসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের অপর্যাপ্ত জ্ঞান চিকিৎসা বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।

প্রিজম বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার আনিসুর রহমান বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি হয়নি, এটা বলা যাবে না। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দাবি করছি, কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০৮ সালের আইনটি অসম্পূর্ণ। মেডিকেল বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে। অথচ হাসপাতালের অনুমোদন দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা। কিন্তু সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। আইনটি যুগোপযোগী করতে ২০১৩ সালে একটি খসড়া দেয়া হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেন, একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মেডিকেল বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কার্যকরী বাস্তবায়ন এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কলেবরে বেড়েছে, ডিসপোজিবল বা একবার ব্যবহারযোগ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ব্যবহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই বর্জ্যরে বেশির ভাগই সংক্রামক, এগুলোর মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ বাড়তে পারে। চিকিৎসা বর্জ্যকে অবশ্যই জনস্বাস্থ্যসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কার্যকরী হবে না, বর্তমান নাগরিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করত পারবে না।

তিনি বলেন, ২০০৮ সালের মেডিকেল বর্জ্য নিষ্কাশন সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। স্বাস্থ্য শিক্ষার সব শাখায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর সুনির্দিষ্ট কোর্স সংযুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটে সব হাসপাতালের চিকিৎসা বর্জ্যে নিরাপদ নিষ্কাশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিদ্যমান আইনটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। ঢাকা শহরের বেশকিছু হাসপাতালে মানা হলেও অনেক হাসপাতালে মানা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন এবং প্রিজমের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি থাকলেও চুক্তির বাইরে হাসপাতালগুলোয় এই অব্যবস্থাপনাটা বেশি রয়েছে। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো এ সম্পর্কে কিছুই ভাবে না। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য রাজধানীর চার পাশের নদীসহ হাসপাতালগুলোর সামনের খোলা ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায় ফেলা হয়। মেডিকেল বর্জ্য ও ওষুধের যেসব কেমিকেল থাকে, সেগুলো ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে পানিতে প্রবাহিত হয়। ক্রমাগতভাবে এটি জৈবখাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানুষের দেহে ফিরে আসে। যা প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গবেষণায় এ তথ্য এখন প্রমাণিত। প্রতিটি মহানগরে এবং জেলা ও উপজেলায় যেখানে হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোকে একটি স্থায়ী ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App