×

সাময়িকী

সাংবাদিকতা ও কথাসাহিত্যের ব্যক্তিত্ববান মানুষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:২৪ পিএম

সাংবাদিকতা ও কথাসাহিত্যের ব্যক্তিত্ববান মানুষ

রাহাত খান

কথাসাহিত্যিক আমাদের নিজেদের সাহিত্যে মনোযোগী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাহাত খান। সাপ্তাহিক রোববার নামে একটি কাগজে তাঁর ‘হে অনন্তের পাখি’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। খুব মনে আছে রাহাত খানের সেই উপন্যাস পড়ার জন্য সারাটা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম।

সদ্য প্রয়াত রাহাত খানকে কথাশিল্পী বলা হলে খণ্ডিত করা হয়; কথাশিল্পী হিসেবে রাহাত খান যতটাই খ্যাতিমান, সাংবাদিক হিসেবেও তিনি ততটাই উজ্জ্বল। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও কথাসাহিত্যের বিশাল দুই আঙিনার প্রবল ব্যক্তিত্ব কথাশিল্পী রাহাত খান। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যিনি পৌঁছেছেন দুই অঙ্গনেরই শীর্ষ অবস্থানে। আর শীর্ষ অবস্থানের মানুষদের নিয়ে অজস্র প্রশ্ন ভক্ত ও পাঠকের মনে থাকাই স্বাভাবিক। রাহাত খানের যাপিত জীবন এবং কৃত্য নিয়ে আলোচনা করলে তাঁর অর্জনের দুই আঙিনার কথাই আসা আবশ্যক। আজ এখানে রাহাত খানকে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা নয়; আজ তাঁর স্মৃতিতর্পণ এবং অনন্তের পথে যাত্রায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। যিনি তাঁর জীবনের এক বিশাল অংশজুড়ে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতায় অবদান রেখে গেলেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা না জানালে নিজেদের হীনমন্যতা আর অকৃতজ্ঞতাই বড় হয়ে ওঠে।

রাহাত খানের জন্ম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমানে জেলা)। তিনি তাঁর যৌবনের বেশ কিছুদিন ময়মনসিংহ সদরে অবস্থান করেছেন; সে কারণে রাহাত খান আমার শৈশব-কৈশোরে দেখা হিরো। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে তিনি বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। ময়মনসিংহ থেকে চলে যাবার পরও দীর্ঘদিন তিনি শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে উচ্চারিত ছিলেন। বিভিন্ন প্রসঙ্গে এখানকার বুদ্ধিজীবীরা বারবার রাহাত খানের কথা উচ্চারণ করতেন শ্রদ্ধার সাথে; তাঁদের উচ্চারণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠতো রাহাত খান কত বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন তারকা। আমার কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে মনে হতো, বুদ্ধিজীবীরা তাঁর নাম উচ্চারণ করে যেন প্রসাদ লাভ করছেন; পরবর্তীকালে আমি নিজেও যে কোনো ছুতোয় চলে যেতাম রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ইত্তেফাক ভবনে রাহাত খানের অফিসে; সময় থাকলে তিনিও তাঁর ময়মনসিংহ জীবনের স্মৃতিতর্পণ করতেন। রাহাত খানের অনেক গল্পেই তিনি তুলে এনেছেন ময়মনসিংহ জীবনের স্মৃতি। স্মৃতিতাড়িত গল্প ‘সময়ের গান’-এ একদিকে আসাদুর রহমান স্মৃতিতাড়িত একজন বয়স্ক মানুষ, কিন্তু তিনি সরকারের রিটায়ার্ড আমলা; নিজের পরিচয়পত্রটি সঙ্গে রাখতে ভুল করেন না। যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি না পাবার দীর্ঘশ্বাসও গুমড়ে ওঠে তাঁর বুকে। ডাকবাংলোতে ওঠেন আসাদুর রহমান, শহরময় হেঁটে হেঁটে স্মৃতি খুঁজে বেড়ান, ইচ্ছে করেই সেভ না হয়ে ঢিলেঢালা পোশাক পরে অবিন্যস্ত থাকেন এবং শেষতক অনুভব করেন- ‘স্মৃতিকে বেশি ঘাঁটা বোধহয় ঠিক না।

স্মৃতিকে মোকাবেলা করতে হলে দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ও প্রচুর শারীরিক-মানসিক শক্তি চাই। মানুষের প্রত্যেকটা স্মৃতির মধ্যে একটু করে সময় ও মৃত্যুর বিষ মাখানো। বেশি সাহস করা ঠিক না।’ স্মৃতির সাথে ধস্তাধস্তির জন্য যেহেতু প্রচুর শক্তি দরকার, অগত্যা বৃদ্ধ আসাদুর রহমান সন্ধ্যার ট্রেনে বন্ধুদের কাউকে না বলে ঢাকা ফিরে যান। গল্পটিতে মূল চরিত্র হেমন্ত মুখার্জির গান গেয়ে গেয়ে নিজের কৈশোর-যৌবনের স্মৃতি তুলে আনছেন। যখনই স্মৃতির সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে তখনই তিনি গুনগুনিয়ে গাইছেন- ‘কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলোছলে/ প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া/ সোনার বরণ মেয়ে বল কার পথ চেয়ে/ আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া \’ আসাদুর রহমান অবসর জীবনের অখণ্ড নিরালা সময়ে ঢাকা থেকে একা চলে এসেছেন তাঁর কৈশোরের-যৌবনের স্মৃতির শহরে। ঢাকা থেকে প্রায় একশ মাইল দূরের মফস্বল শহরটির নাম গল্পে বলা না হলেও ব্রহ্মপুত্র নদী (নদ), জুবলী পার্ক সড়ক, জুবলী পার্ক, কবরখানা লেন, সাহেব কোয়ার্টার, সিটি কলেজিয়েট স্কুল-মুখোমুখী বিদ্যাময়ী স্কুল, মাড়োয়ারী পরিবার ইত্যাদির সমীকরণে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না, এ শহর লেখকের নিজের শহর। যদিও ‘জুবলী পার্ক সড়ক’-এর প্রকৃত নাম ‘কংগ্রেস জুবলী রোড’ আর জুবলী ঘাটের পাশের বৃক্ষহীন পাতাবেঞ্চির পার্কটির নাম ‘বিপীন পার্ক’; অবশ্য লেখকের কৈশোরে পার্কটির নাম ‘জুবলী পার্ক’ ছিল কী-না সে জিজ্ঞাসাও এসে যায় পাঠকের সামনে।

রাহাত খান ১৯৪৯-এ ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ শহরেই বসবাস করেন। প্রায় দেড় যুগ ধরে রাহাত খান ছিলেন আমার শহরে সে স্মৃতি তিনি কখনো ভোলেননি; যতবার তাঁর অফিস অথবা বাসায় দেখা করতে গেছি ততবার তিনি আমাকে তাঁর শহরের উত্তরসূরি বলে সমাদর করেছেন। করোনাকাল শুরু হবার অল্প ক’দিন আগে আমি আর আর আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর ফিরোজ তাঁর নিউ ইস্কাটনের বাসায় গেলাম সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য, প্রধানত রাহাত ভাই অসুস্থ খবর পেয়ে দেখা করার জন্য; যথেষ্ট অসুস্থ তিনি; কিন্তু আমাদের প্রতি তাঁর যতে্নর সামান্য ঘাটতি নেই। আমরা একই শহরের মানুষ বলে নয়; তাঁর প্রতি আমার দায়বদ্ধতা বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের সম্পাদক হিসেবেও; আজ আমি যে সংগঠনের সম্পাদক একই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলে কথাশিল্পী রাহাত খান। আর আমার সবচেয়ে বড় দায়, আমাদের প্রথম যৌবনে শরৎচন্দ্র-নীহাররঞ্জন গুপ্ত-নিমাই ভট্টাচার্যের কথাসাহিত্যের ভুবন থেকে যে ক’জন কথাসাহিত্যিক আমাদের নিজেদের সাহিত্যে মনোযোগী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাহাত খান। তাঁর ‘অনিশ্চিত লোকালয়’, ‘ভালোমন্দের টাকা’, ‘অমলধবল চাকরি’, ‘শহর’, ‘ছায়াদম্পতি’, ‘আমার সময়’, ‘সেই মুখস্ত নামতা’, ‘ইমান আলীর মৃত্যু’, ‘হে অনন্তের পাখি’ ইত্যাদিসহ অসংখ্য রচনার কথা সামান্যেই মনে পড়ে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক রোববার নামে একটি কাগজে তাঁর ‘হে অনন্তের পাখি’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো খুব মনে আছে রাহাত খানের সেই উপন্যাস পড়ার জন্য সারাটা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। সেই রাহাত খান আজ অনন্তের পাখি হয়ে উড়ে গেছেন অনন্ত জীবনের পথে; তাঁর এ যাত্রায় তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App