×

সাময়িকী

বাবলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:১২ পিএম

বাবলি

কুসুমকলির যখন জ্ঞান ফেরে সে বুঝতে পারে কোনো একটি কক্ষে সে বন্দি। বন্দিদশা থেকে বেরোবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সিদ্ধান্ত নিতে কুসুম দেরি করেনি, দ্বিধান্বিত হয়নি। যে প্রহরী খাবার দিতে দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢোকে, দেখে কড়িকাঠে ওড়নার ফাঁস বেঁধে ঝুলে আছে মেধাবী ছাত্রী কুসুমকলি। কুসুমকলির লাশ কে গোসল করিয়েছে, কোথায় তার দাফন হয়েছে, কবে মরণোত্তর মিলাদ হয়েছে- কেউ জানে না, কেউ জিজ্ঞেসও করে না। কুসুমকে নিয়ে ভিন্ন একটি কাহিনীও আছে। অংক স্যারের সাথে পালিয়ে যাবার সময় শ্যুটার বাচ্চু ওসমান গনিকে গুলি করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কুসুমকলি স্যারকে জড়িয়ে ধরে, পেছন দিয়ে গুলিটা তার হৃৎপিণ্ড ঢুকে যায়- তারপর অংক স্যারকেই খুনের মামলার আসামি বানিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আর একটি একপেশে কাহিনী আছে। পালাবার সময় হঠাৎ কুসুমের মোহ কেটে যায়, সে ফিরে আসতে চাইলে তিনি বলেন, তা আর সম্ভব নয়। তখন কুসুমকলি নিজেই কিডন্যাপার কিডন্যাপার বলে চিৎকার শুরু করলে একজন সুন্দরী তরুণীকে অপহরণকারীর হাত থেকে রক্ষা করার হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট জনতা তাদের ঘিরে ফেলে। তরুণীকে তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং তার চোখের সামনে উন্মত্ত মানুষ পিটিয়ে তাকে হত্যা করে। নিহত ওসমান গনি আধখোলা স্থির চোখে যখন কুসুমের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন নাকি কুসুম বলেছে, মনে হয় এখনও মরেনি। থানার দারোগা তিনদিন তাকে পুলিশ হেফাজতে রেখে মুগ্ধ হয়ে তার বাবার সম্মতিতেই চতুর্থ দিন বিয়ে করে ফেলে। পরিচিতজনের দৃষ্টি এড়াতে কুসুমকলি হিজাব পরতে শুরু করে। হয়তো আমাদের জেলায় কিংবা দূরের কোনো জেলায় কোনো এক সেকেন্ড অফিসারের স্ত্রী হিসেবে কুসুম জীবনধারণ করছে। কিন্তু কোথায় আমরা কেউ জানি না। এটিও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যে কাহিনীকে গ্রহণযোগ্য বলে নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছি সেটি হচ্ছে ওসমান গনি স্যার ও কুসুমকলি শ্যুটার বাচ্চুর শুটিং রেঞ্জের বাইরে চলে যায় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি বর্ডার আউট পোস্ট দিয়ে সাফল্যের সাথে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে যায়- তারা এখন মুর্শিদাবাদের কোনো মফস্বল এলাকায় একরুমের একটি বাসাতে জীবনযাপন করছে। তাদের অর্থের অভাব অনেক, কিন্তু শান্তির কোনো অভাব নেই। কুসুমকলি সুখে আছে সুখে আছেন ওসমান গনি স্যারও। এটাই সত্যি হোক। অংকের আবদুল কাইয়ুম স্যার আমাদের গার্লস হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। খুব ভালো অংক করাতেন। পাটিগণিতের কিছু বিষয় পড়ানো নিয়ে তার খুব আপত্তি ছিল। একটি হচ্ছে সুদকষা- যেখানে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, সুদখোরের দোজখবাস নিশ্চিত করা হয়েছে আমরা কেন তাহলে সুদের হিসাব শিখব? কিন্তু তিনি শেখাতেন। দুধে পানি মেশানোর অংক শিখে লাভক্ষতি হিসাব করতেও তার আপত্তি ছিল। তিনি বলতেন চোর ধরার জন্য শিখে রাখো কিন্তু নিজেরা কখনো নিজেদের জীবনে প্র্যাকটিস করবে না। আমি ক্লাস নাইনে স্যারকে অংকের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। ক্লাসে একদমই হাসতেন না। আমার ধারণা তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষককে বিশেষ করে গার্লস স্কুলের শিক্ষককে অবশ্যই গম্ভীর হয়ে থাকতে থাকে। কখনো হাসি এসে গেলেও তা চেপে রাখতে হবে, ছাত্রীদের সামনে দাঁত বের করা যাবে না। এমনকি মুচকি হাসাও যাবে না। কারণ ছাত্রীরা হচ্ছে বাঁদরের মতো, একবার ঘাড়ে ওঠার চাঞ্চ পেলে স্যারের ঘাড় না মটকে নামবে না। স্যার আমাদের কারো দিকেই চোখ তুলে তাকাতেন না। আমাদের ক্লাসের কেউ বা আমাদের সিনিয়র কোনো আপু স্যারকে চিঠিপত্র লিখেছেন এমন শুনিনি। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কোনো পোশাকে তাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সব ঋতুতেই গলায় একটি উলের মাফলার পেঁচাতেন। স্যার যোগ দেবার পর কিছুটা ভয়ে হলেও আমরা অংকও মুখস্ত করতে শুরু করলাম। শুরুতে স্বৈরাচারী মনে হলেও হেডস্যার এবং গভর্নিং বডির মেম্বাররা এটা মেনে নিলেন- রাত সোয়া এগারোটার মধ্যে সব রুমের আলো নিভতে হবে, কেবল মাত্র দুই করিডোরে দুটো বাল্ব আর দু’প্রান্তর বাথরুম অঞ্চলে দুটো বাল্ব জ¦লবে। ছাত্রীরা ছয় ঘণ্টা ঘুমোবে, বেশিও না, কমও না। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে উঠে তৈরি হয়ে আগের রাতে অসমাপ্ত কাজ, হোমওয়ার্ক যদি থাকে শেষ করবে। সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখা যাবে, পরবর্তী বারো ঘণ্টা দিনের আলোতে কাজ চলবে। আবদুল কাইয়ুম স্যারের কড়া শাসনের সুনাম এতোটাই রটল এতোদিন যেসব অভিভাবক মনে করতেন মেয়েকে হোস্টেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে তারাই বলতে শুরু করলেন প্রতিদিন ছয় সাত কিলোমিটার জার্নি করার চেয়ে হোস্টেলে থাকাই ভালো। কেউ কেউ এসে দুই মেয়ের জন্য একরুমে দুটো সিট মিলবে কি না সে খবরও নিলেন। ছয় মাসের মধ্যে পঞ্চাশ সিটের হোস্টেলে যে সতেরোটা খালি ছিল সেগুলো তো ভরলই, কোনো কোনো রুমে বাড়তি চকি ঢুকিয়ে বোর্ডারের সংখ্যা বাষট্টিতে উঠানো হলো। চাহিদা আরো ছিল, কিন্তু বাধা দিলেন কাইয়ুম স্যার। বললেন, বেশি গাদাগাদি করলে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। যদি হোস্টেলে আরো বেশি ছাত্রী ভর্তি করাতেই হয় তাহলে হোস্টেল বিল্ডিং এক্সপানশন প্রজেক্ট আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। হোস্টেলবাসী ছাত্রীদের অভিভাবকরা কখনো হোস্টেল সুপারের সাথে বৈঠক করার কথা ভাবেননি, কিন্তু প্রথম ছ’মাসে তারা দু’দফা বৈঠক করেছেন, তাদের সন্তানদের আচরণের রিপোর্ট নিয়ে গেছেন। স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের শূন্যপদে বেশ ক’জন সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙ্গিয়ে তাকে নেয়া যায় কি না সে আলাপও চলছে। স্যার যথেষ্ট গম্ভীর হলেও হলের কোনো ছাত্রী কোনো সমস্যা নিয়ে এলে তিনি দ্রুত সমাধান করে দেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি প্রত্যেক দিন গার্লস হোস্টেলের শেষ ছাত্রীটি স্কুলে ঢোকার পর নিজে ঢুকতেন। যদিও স্কুল ও হোস্টেল একই কম্পাউন্ডে ভেতরে ঢোকার গেট ছিল ভিন্ন। তিনি কখনো লেট করেননি। পিরিয়ডিক অসুস্থতার কারণে ছাত্রীদের দু’একজন কখনও কখনও লেট করেছে। কিন্তু একদিন সকালে স্যার এলেন না। আমরা টের পেলাম সেকেন্ড পিরিয়ডে। হেডস্যার নিজে এসে গত বছরের ফাইনাল পরীক্ষার অংকের উদ্বৃত্ত কিছু প্রশ্ন আমাদের মধ্যে বিতরণ করে বললেন, আমি জানি শুধু সেকেন্ড পিরিয়ডে সব প্রশ্নের উত্তর লেখা সম্ভব হবে না- যে ক’টা প্রশ্নের উত্তর লেখা সম্ভব তাই লিখো। ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে ফার্স্ট গার্ল সবার খাতা তুলে জমিয়ে রাখবে। অংক স্যার এলে তার কাছে দেবে। আমাদের পরীক্ষায় বসিয়ে দিলেও আমাদের ফিসফিস কিন্তু থামেনি। আমাদের হোস্টেলবাসী ক্লাসমেট জামিলা বুপাশা বলল, ঘটনা খারাপ। নারীঘটিত। সে বেরোবার সময় দেখেছে একজন মহিলা তাকে রীতিমতো হাত ধরে টানছেন- চলেন, আমাদের বাড়িতে চলেন। তবে এই মহিলা যে আমাদের এলাকার নন এটা সে জোর দিয়েই বলেছে। আমাদের এলাকার যে নয় তা নিশ্চিত হয়েছে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে- তার পায়ে সাদা মোজা এবং পুরুষ মানুষের কাপড়ের জুতো। আমাদের এলাকার হলে এমনকি পুরুষ মানুষের টি-শার্ট পরলেও জুতোটা হতো হাই হিল লেডিস স্যু। থার্ড পিরিয়ডেও স্যার আসেননি। সেই নারীর সাথে একটা সমঝোতা করে তাকে বিদায় করে আধবেলার ছুটির দরখাস্ত নিয়ে টিফিনের পরপর স্কুলে ঢোকেন। জামিলা বুপাশা টিফিনের সময় হোস্টেল ঘুরে এসে আমাদের ধারণা সঠিক খবরটিই নিয়ে এসেছে। আকস্মিকভাবে সকালে আগত নারী স্যারের সাবেক স্ত্রী। তার কাছে খবর গেছে আবদুল কাইয়ুম স্যার একেকদিন একেকজন ছাত্রীর সাথে ঘুমোন। সেজন্যই লেডিস হোস্টেলের সুপার হয়েছেন। স্যার বলেছেন, আমার কামাই কম- এজন্য তুমিই আমাকে তালাক দিয়েছ। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। তুমি কি কর আমি তো সে খবর নিতে যাই না; আমি কি করি তুমি সে খবর নিতে কেন এসেছ? তখন তিনি কাঁদতে শুরু করেন এবং বলেন, তালাকের জায়গায় তালাক থাকুক। কিন্তু তার সাথে দু’বছরের যে সম্পর্ক- এক বিছানায় শোয়া, এক সাথে খাওয়া- এগুলোর কি কোনো দাম নেই।

স্যার বললেন, তালাকের আগে পর্যন্ত দাম ছিল, এখন এসবের কোনো অর্থ নেই। স্যার কি তার চোখের পানি মুছে দিয়েছেন? জামিলা বুপাশা বলল, তালাকের পর টাচ করা না-জায়েজ। সে জন্য স্যার চোখ মুছে দেননি। আমি তখন বললাম, এটা বেশি বাড়াবাড়ি। আপাতত এটুকুই আমাদের জানা হলো যে স্যার এক সময় বিয়ে করেছিলেন দু’বছর পর তার স্ত্রী তাকে তালাক দিয়েছেন। কারণ? জামিলা বুপাশা বলল, আমি কি তালাকনামা দেখেছি নাকি? কত কারণে যে তালাক হয়। আমার বড় ফুপোতো বোন তার হাজব্যান্ডকে তালাক দিয়েছে, কারণ বেচারা নাকি শুধু ঘুমোয়, তার গায়ে হাতও দেয় না। স্যারকে নিয়ে এ বিষয়ে আমাদের আলাপ দু’দিনেই ফুরিয়ে গেল। পুরনো রুটিন অনুযায়ী স্যারও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু মাস তিনেক পর সেকেন্ড পিরিয়ডে টের পেলাম অংক স্যার আসেননি। থার্ড পিরিয়ড শেষ হবার পর যে ঘণ্টাটি বাজল তা ছুটির ঘণ্টা। অথচ তারপর ফোর্থ পিরিয়ডে ইংলিশ সেকেন্ড পেপার। তারপর টিফিন। টিফিনের পর আরও তিন পিরিয়ড। ছুটি স্যারের কারণেই। কোনো এক অজ্ঞাত ঘাতক স্যারের গলার উলের মাফলার পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। স্যার আর বেঁচে নেই। শোনা গেল এটা নারীঘটিত হত্যাকাণ্ড। এতোক্ষণ ঠিকই ছিলেন, কিন্তু নারীঘটিত হত্যাকাণ্ড শোনার পর টিচার্সরুমে আমাদের বায়োলজি ম্যাডাম ইসমত আরা খানম অজ্ঞান হয়ে গেলেন। শিক্ষকদের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা ছিল আবদুল কাইয়ুম ও ইসমত আরা খানমের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। ইসমত ম্যাডাম প্রকাশ্যেই স্যারকে দোষারোপ করেছিলেন- ডিসিপ্লিনের নামে তিনি লেডিস হোস্টেলে বাড়াবাড়ি করছেন। মেয়েরা আমাকে বলেছে। জবাবে স্যার বলেছিলেন, নিজের চরকায় তেল দিন। আর যদি তেল না থাকে বলুন ঘানিটানা খাঁটি সর্ষের তেল এনে দেব। হতভম্ব ম্যাডাম বললেন, মানে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App