×

সাময়িকী

তিনি থাকবেন স্মরণে স্মৃতিতে পাঠে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:০৫ পিএম

তিনি থাকবেন স্মরণে স্মৃতিতে পাঠে

রাহাত খান

কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক রাহাত খান ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় দক্ষ কারিগর। আধুনিক জীবনের চাহিদা, মানুষের বদলে যাওয়া তিনি নিপুণ কুশলতায় তার সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তার জন্ম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলায়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম জীবনে রাহাত খান কলেজে অধ্যাপনা, পরে পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ময়মনসিংহ জেলার নাসিরাবাদ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাহাত খান দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় যোগ দেন। দৈনিক ইত্তেফাকে ষাট দশকে প্রথমে সহকারী সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পরে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি দৈনিক বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাসসের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ প্রকাশিত হয়। রাহাত রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে : অমল ধবল চাকরি, ছায়া, দম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, এক প্রিয় দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল। রাহাত খান বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফি মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৩), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), একুশে পদক (১৯৯৬) রাহাত খান রচিত সাহিত্য জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও মানুষের নিত্য ক্রিয়াকলাপে সমৃদ্ধ। সংগ্রাম, ভালোবাসা, বিরহ, ছদ্মবেশ সব আছে। সভ্যতার পালাবদলে মানুষের আচরণ, জীবনযাপন বদলে গেছে। মনোজগতে হয়েছে নানা রূপান্তর।

তুচ্ছ বিষয়ও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। তার সাহিত্যে সহজভাবে বলা হয়েছে। তিনি মমতায় চিত্রিত করেছেন ক্যানভাস। কাহিনী, চরিত্র ও চারপাশের পরিবেশ ভাবনার গভীরে পাঠককে নিক্ষিপ্ত করতে পারে। তার গল্প, উপন্যাস অস্তিত্ববাদের কোমল স্পর্শে সচকিত। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ নিজবৃত্তে ঘুরপাক খায়। কিছু প্রশ্ন আর দ্বান্দ্বিক সত্তার পর্যবেক্ষণে সে ক্ষত-বিক্ষত। ‘ইমান আলীর মৃত্যু’ গল্পে নিরন্তর বেঁচে থাকার লড়াই, দরিদ্র-ক্ষুধার্ত থাকার অনুভূতি, প্রেম-অপ্রেমে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার বৃত্তান্ত বিবৃত হয়েছে। বানভাসি মানুষের আহাজারি, জনপ্রতিনিধিদের প্রতারণা, অভাব, অকাল মৃত্যুর মধ্যেও কিছু মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা প্রকাশিত হয়েছে। অসুস্থ ইমান আলী মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে দুই ভাইয়ের বিরোধ মেটায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বন্যা পরবর্তী সময়ে ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনীরা তাকে একা ফেলে যাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ইমান আলী প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে। তার ক্ষোভ প্রকাশের পর তাকে নিয়ে সবাই যখন যাত্রা করে মাঝপথে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার আর্তনাদে কেউ কর্ণপাত করে না। তার পুত্র ও অন্যরা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সে গায়েবি ও বিবেকি আওয়াজ শুনতে পায়।

‘চুড়ি’ গল্পে স্ত্রী জৈগুনকে তার স্বামী বিত্তবান মানুষের শয্যাসঙ্গী হওয়ার প্ররোচনা দেয়। জৈগুন চরিত্র এক অধরা নারীর প্রতিকৃতি। তার সতিত্ব রক্ষায় সচেতন থাকার পর আর্থিক ও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সে আত্মসমর্পণ করে। স্বামীর সাথে একাত্ম থাকার সময় তার হাতের চুড়ি রিনিঝিনি সুর তুলতো। পরপুরুষে সমর্পিত হওয়ার মুহূর্তে একদম বন্ধ অবস্থা। চৌকির ক্যাচক্যাচ শব্দ ছাড়া তার জীবনে কোনো সুর ও ছন্দ যেন নেই। ঘোর তার চেতনা আচ্ছন্ন করে। ভালোবাসাহীন জীবনযাপন কেবল দুঃখকষ্টের জাগর চেতনার ফসল। বহুগামী পুরুষ চরিত্র এ গল্পে এসেছে। পাশাপাশি এক নারীর অবদমন ও মনস্তত্ত¡কে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন কথা সাহিত্যিক। নীতি, নৈতিকতা, বিকৃতি নিয়ে একদল মানুষ সমাজে বসবাস করছে তার বাস্তব চিত্র এই গল্পে প্রত্যক্ষ করি। অর্থ ও বিবিধ চাহিদার কাছে হার মানে অনেক নারী।

জীবন জিজ্ঞাসার অপূর্ব সম্মিলন রাহাত খান তার রচিত গল্প উপন্যাসে ধারণ করেছেন। তার সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্মপীড়া, জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার লড়াই-সংগ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে চলতে গিয়ে নানা দ্বন্দ্ব ও মানসিক যাতনায় ভোগে তা এসেছে ‘মধ্যিগ্রামের চর’ গল্পে। ‘উদ্বেল পিপাসা’ গল্পের নারী খালেদা হাসানের শারীরিক সম্পর্ক অসুস্থ স্বামী দরোজার ফাঁক দেখেও কিছু বলতে পারে না। অর্থের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা তাদের ঘনিষ্ঠতা তাকে এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। খালেদা একসময় হাসানের সঙ্গে পালিয়ে যায়। মধ্য-নিম্ন বিত্ত পরিবারের অসংখ্য খালেদা হাসানের বিচরণ আমরা দেখতে পাই। রাহাত খান মমতায় তুলে আনেন বাস্তবতা।

‘মধ্যরাতে’ গল্পে দুইজন নর-নারীর ক্রস কানেকশনে পরিচিত হয়ে ওঠা এবং তাদের ভেতরকার কথোপকথন, হৃদয়বৃত্তির সুষম ব্যবহার বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। বেদনাবোধ থেকে অসমাপ্ত থেকে যায় তাদের চাহিদা কেবল আকর্ষণ পড়ে থাকে। কেউ কারো ফোন নম্বর সংগ্রহ করে না। রং নম্বরে যুক্ত হওয়া নর নারীর আহাজারির উদগীরণ শান্ত, সৌম্য হয়ে ধরা পড়ে গল্প শেষ হয়। ‘বিষ বৃক্ষ’ গল্পেও আমাদের চেনা জনপথ, বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক অবস্থা স্থান পেয়েছে। এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করেছে। বন্ধুত্ব উপেক্ষিত হয় না। দাঙ্গায় মাখন লাল মৃত্যুবরণ করে। বন্ধু রায়হানের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এ ঘটনা গ্রামবয়সীদের একসূত্রে গ্রথিত করে। একদল মুসলিম অন্য দল হিন্দুকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়।

সাহিত্যিক রাহাত খানকে মূল্যায়ন করা কষ্টসাধ্য। তার পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল বিস্ময়ে ও অভিনবত্বে পূর্ণ। তরুণ সাহিত্যিকদের তিনি ছিলেন পরম আশ্রয়স্থল। অনেকের চাকরি পাইয়ে দেয়া, পদোন্নতি, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার কাজটি তিনি গোপনে করেছেন। মানবিক গুণাবলিতে ভরপুর তাকে মন্ত্রী, আমলা, উচ্চপদস্থ যে কেউ সম্মান করত। তার বন্ধু কাজী আনোয়ার হোসেন তাকে মাসুদ রানা সিরিজের মেজর জেনারেল রাহাত চরিত্র বানিয়েছিলেন। তার জীবন ও সাহিত্যকৃতি সমৃদ্ধ। তিনি ছিলেন নাগরিক সাহিত্যিক। তার লেখা পড়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম ঈদ সংখ্যা কখন প্রকাশিত হবে। গত ২৮ আগস্ট রাহাত খান অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। বেদনাবিধুর কণ্ঠে শুধু বলব তিনি থাকবেন আমাদের স্মরণে, স্মৃতিতে, পাঠে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App