×

সাময়িকী

এক অনন্য নগর-উপাখ্যান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৩৮ পিএম

এক অনন্য নগর-উপাখ্যান
এক অনন্য নগর-উপাখ্যান

বাংলাদেশের কথা-সাহিত্যকে যারা আপন ভিত্তিভ‚মির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন রাহাত খান তাদের অন্যতম প্রধান। বাংলা কথা-সাহিত্যের বয়স দেড় শতাধিক বছর পার করলেও এই ভূখণ্ডের জীবন-চরিত উপন্যাসে খুব কমই বিধৃত হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নগর জীবনের রূপদান খুব বেশি চোখে পড়ে না। ভারত বিভাগের পরে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হলেও নগর জীবনের সংকট ও সম্ভাবনা তখনো দানা বেঁধে ওঠেনি। ঢাকাকেন্দ্রিক উপন্যাস সাহিত্যের বন্ধ্যত্ব দূর হতে বেশ সময় লেগেছিল। উপন্যাসের সৃষ্টি অনেকটা শহরকেন্দ্রিক যন্ত্র-সভ্যতার ফল।

পঞ্চাশ দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুনধারার উপন্যাস তৈরির সূত্রপাত হয়। তবে তাদের প্রায় সবাই কোলকাতা থেকে পরিপুষ্ট হয়েছিলেন। পঞ্চাশ দশকের কথা-সাহিত্যিকগণ ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের একটি নতুন ধারা নির্মাণ করেছিলেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হলেন- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, রশীদ করীম, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, শওকত ওসমান প্রমুখ। এই প্রতিভাবান লেখকগণ এই অঞ্চলের অনগ্রসর বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংকট যেভাবে রূপদান করেছিলেন, তা হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে বাংলা কথা-সাহিত্যের পথ নির্দেশক। কিন্তু পাকিস্তান আমলে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী না হওয়ায়, তৎকালীন লেখকদের যেমন আত্ম-নির্মাণে সজাগ থাকতে হয়েছিল, তেমন একই সঙ্গে ঢাকা শহরটিও আধুনিক নগরায়নের দিকে এগিয়ে চলছিল।

রাহাত খানের উপন্যাস আলোচনার ক্ষেত্রে এ ভ‚মিকাটুকু অতিরিক্ত নয়- এ জন্য যে, তখন পর্যন্ত বাংলা উপন্যাস ছিল প্রায় গ্রামকেন্দ্রিক। আর তার প্রধান কারণ, পল্লী-জীবনের বিকাশের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠছিল। প্রায় সব লেখকই একটি গ্রামীণ মধ্যবিত্তের স্মৃতি নিয়ে রাজধানীতে একত্রিত হচ্ছিল। পঞ্চাশ দশকে ঢাকা নগর হিসেবে বিকাশ লাভ করলেও, অধিকাংশ মানুষ ছিল গ্রামীণ-স্মৃতির সন্তান। তাদের লেখাতে আমরা তার প্রতিফলনও দেখতে পাচ্ছিলাম। আমরা লক্ষ করেছি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সবকটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ জীবনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা। কেবল গ্রামীণ জীবন থেকে আসা নয়, উপন্যাসের বিষয় এবং দৃশ্যায়নও গ্রামীণ আবহে মঞ্চায়ন হচ্ছে। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র কেন্দ্রীয় চরিত্র মুহম্মদ মুস্তফা সরকারের উচ্চ পদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও গ্রামীণ পটভ‚মি থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। বরং ফেলে আসা গ্রামীণ স্মৃতি তাকে মানসিক রোগগ্রস্ত এবং পরিণামে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যেই মঞ্চস্থ হয়েছে। আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’ কিংবা আবুল কালাম শামসুদ্দিনের উপন্যাসসমূহ গ্রামকেন্দ্রিক। বাংলা উপন্যাসের বিকাশের এ ধারা প্রমাণ করে কথা-সাহিত্য একটি বাস্তবানুগ শিল্পকর্ম যা কেবল পল্লবগ্রাহী মন নিয়ে রচনা করা সম্ভব নয়।

বলা চলে, নগর জীবনের রূপদানের ক্ষেত্রে রশীদ করীমের ‘উত্তম পুরষ’ উপন্যাসটি একার্থে প্রথম। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হয়, রশীদ করীমের উপন্যাসের পটভূমি ঢাকা নয়, কোলকাতা। লেখক যদিও ১৯৬১ সালে ঢাকায় বসে এ উপন্যাসটি রচনা করছেন, তবু এটি তার যৌবনের কোলকাতার বাস্তব চিত্রায়ন। এ কথাও সত্য, কোলকাতা তখনো মেট্রোপলিটন সিটি হয়ে ওঠেনি। সুতরাং, শহরের যে নিজস্ব চরিত্র এবং শহরের মানুষের যে বহুমুখী বিকাশ তখনো কোলকাতায় তার স্পর্শ লাগেনি। এ ছাড়া, তখন ঔপনিবেশিক ভারত, বিশেষ করে হিন্দু মুসলমান সকলেই তার আত্ম-পরিচয় নির্মাণে ব্রত। এক অর্থে বলা চলে, জাতীয় চরিত্র নির্মাণে তখনকার কোলকাতা ছিল ব্যস্ত। মনে রাখতে হবে, আধুনিক নগর একটা বিশাল অগ্ন্যাশয়, তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সবকিছু পরিপাক করে নেয়। তার বহুমুখী চেতনা, লোভ, রিরংসা ও বণিকবৃত্তি সবকিছু একই সঙ্গে মঞ্চায়ন হয়। আলাদা করে দেখানো প্রায় অসম্ভব।

নগরকেন্দ্রিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে রাহাত খানের ‘হে অনন্তের পাখি’ বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যের একটি মাইলফলক। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি যখন এ উপন্যাসটি রচনা করছেন তখন ঢাকা কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীই নয়, ভেতরে ভেতরে নগর জীবনের চরিত্র তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। নগর মানে এক মানবারণ্য, কেউ কাউকে চেনে না- বহুমুখী চেতনা ও বিচিত্র মানুষের সমাহার। কেউ সেখানে নায়ক নন। প্রকৃত নগর নিজেই নায়ক।

রাহাত খান যে সময় বাংলা কথা-সাহিত্যে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করলেন, ততদিনে ঢাকা তার নিজস্ব চরিত্রে আবিভর্‚ত হতে শুরু করেছে। যদিও সময়টি ছিল উন্মাতাল। বাঙালি জাতি যেমন স্বাধীনতা চাচ্ছিল, তেমন সবকিছুই তার নিজের মতো করে দাঁড় করাতেও চাচ্ছিল। সুতরাং এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা ও সন্ত্রাস একই সঙ্গে দানা বেঁধে উঠছে। বলা চলে, রাহাত খানের সময়টি বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ। এ সময়ে একই সঙ্গে একদল প্রতিভাবান লেখক বহুমুখী সাহিত্যিক কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করে তুলেছিলেন। রাহাত খানের সমসাময়িক কেবল কথা-সাহিত্যের কথা বললেও, যাদের নাম সর্বাগ্রে চলে আসে, তারা হলেন- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক প্রমুখ। কিন্তু আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব, তাদের উপন্যাসেরও মুখ্য চরিত্র ও পটভূমি গ্রাম। অবশ্য যে গ্রাম অনেকখানি ভেতরে প্রবিষ্ট হয়ে আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস রচনা করেছে। রাহাত খানই বলা চলে এ সময়ে তার উপন্যাসে নগর তুলে আনলেন। এ কথা সত্য, এখন পর্যন্ত গ্রামই আমাদের জাতিসত্তা ও মানসিক বিকাশের কেন্দ্র। ঢাকার বয়স কয়েক শতাব্দী হলেও কেবল শহরকে কেন্দ্র করে এখানকার মানুষ খুব বেশি প্রজন্ম অতিক্রম করেনি। সে ক্ষেত্রে কেবল নগর নিয়ে উপন্যাস লেখা একটি ব্যক্রিক্রমী সাহসী পদক্ষেপ।

আমার মনে হয়, নগরকেন্দ্রিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে রাহাত খানের ‘হে অনন্তের পাখি’ বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যের একটি মাইলফলক। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি যখন এ উপন্যাসটি রচনা করছেন তখন ঢাকা কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীই নয়, ভেতরে ভেতরে নগর জীবনের চরিত্র তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। নগর মানে এক মানবারণ্য, কেউ কাউকে চেনে না- বহুমুখী চেতনা ও বিচিত্র মানুষের সমাহার। কেউ সেখানে নায়ক নন। প্রকৃত নগর নিজেই নায়ক। রাহাত খানের এ উপন্যাসের নায়ক স্বয়ং ঢাকা নগরী। এ উপন্যাসে তিনি যে সময়টি ধারণ করেছেন, সেটি এ দেশের রাজনীতিক ইতিহাসের একটি অস্থির ও নষ্ট সময়। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার নতুন মেরুকরণ, সামরিক ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় এক নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। গড়ে উঠছে নতুন ধনিক শ্রেণি। সন্ত্রাস, যৌনতা এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা দিচ্ছে। বিচিত্র শ্রেণিপাতের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঢাকার জীবনই রাহাত খানের এ উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে। সুতরাং এ উপন্যাসে নায়ক চরিত্র গৌণ। সমাজের বহুস্তরে মিশে থাকা হাজারও মানুষের একজন এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিংবা স্খলন, বিপ্লব কিংবা অধঃপতন কোনোটাই মুখ্য করে তোলা ঔপন্যাসিকের দায়িত্ব নয়। এখানেই একজন সত্যিকারের কথা-শিল্পীর সার্থকতা। কথা-শিল্পী যেমন তার গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজের কাহিনীবুননের কাজটি করে তোলেন, তেমননি তাদের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি সমাজ বাস্তবতাও ফুটিয়ে তোলেন। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, উপন্যাস একটি সমাজের প্রকৃত ইতিহাস। উপন্যাসের মাধ্যমেই সেই সমাজের প্রায় সর্বশ্রেণির মানুষের অনুকম্পনগুলো অনুভব করা যায়।

রাহাত খানের ‘হে অনন্তের পাখি’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জামিল, যে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার স্ক্রিপ্ট রাইটার। সমাজের এমন কোনো দিককেই সে প্রতিনিধিত্ব করে না, যার দ্বারা সে সমাজের একটি অভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই আমরা বুঝতে পারবো, ঔপন্যাসিক কেন একজন স্ক্রিপ্ট রাইটারকে তার এ মহায়তনিক উপন্যাসের নায়ক করে তুললেন। এ চরিত্রের মধ্যেই আসলে ধরা পড়েছে নগরের প্রথম চরিত্র। এ উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ করলে অবাক হতে হয়, এমন একটি সাধারণ চরিত্রকে তিনি অসাধারণ ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখবো, গ্রামীণ জীবনে প্রত্যেক মানুষের পেশা ও জীবনযাত্রার সঙ্গে অন্য মানুষ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কিন্তু নগর জীবনে সেই প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই আমরা জানি। এখানে পাশাপাশি বাস করলেও কেউ কাউকে চেনার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? শহরের যে চারিত্রিক বিকাশ, তাতে কেউ কাউকে না চিনেও প্রত্যেকেই তার নিজের প্রয়োজনে অন্যের সঙ্গে জড়িত। নগর জীবনের সবকিছুই ঘনসন্নিবদ্ধ ও সংযুক্ত। এখানকার ব্যবসা, সন্ত্রাস, যৌনতা এবং সেবা সার্ভিসগুলো পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাই জামিলের সঙ্গে রওশনের যেমন দেখা হয়ে যায়। কংকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় নোমানীর। হয়তো কংকা ও মুমু একই মায়ের সন্তান কিন্তু তাদের রুচি আলাদা, তাদের চাওয়া আলাদা, তাদের কৌত‚হল আলাদা। নগর জীবনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যৌনতা ও ক্ষমতা। অর্থ ও ক্ষমতার কাছে নারীর আলাদা কোনো মূল্য নেই। সব কিছুকে পণ্য করে তোলা শহরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। শরীরের শুদ্ধতা এখানে মধ্যবিত্তের ইমোশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আধুনিক ঔপন্যাসিক শিল্পের কাঠামোকে গুরুত্ব না দিলেও রাহাত খানের এ উপন্যাসে আদি, মধ্য ও অন্তের একটি সূক্ষ্ম সীমারেখা নির্ণয় করা যায়। অতি তুচ্ছতার মধ্যে এ উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে গেলেও মাঝ পর্যায়ে রাজনীতি, যৌনতা, ক্ষমতার বহুমুখী লড়াই উপন্যাসকে একটি ক্লাইমেক্সের দিকে নিয়ে যায়। পরিণতিতে জামিল ও মুমুর বিয়ে, তৈফুর ও রওশনের মধ্যেও একটি আপসরফা লক্ষ করা যায়। উপন্যাসের শিল্প সৌকর্যের ক্ষেত্রে একটি কথা বলা হয়ে থাকে, যে পল্লবগ্রাহী মন কোনো ভালো উপন্যাসের স্রষ্টা হতে পারে না। একজন সৎ ঔপন্যাসিককে তার সৃষ্ট সকল চরিত্র ও পরিবেশের প্রতি নিরাসক্ত যত্ন রাখতে হয়। রাহাত খানের ভাষা এবং চরিত্র নির্মাণের কৌশল দেখলেই এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তার চরিত্রগুলো তার ভাষা ও পারস্পরিক যোগাযোগের কৌশল দ্বারা সরব ও সজীব হয়ে আছে।

একটি ভালো উপন্যাস বিচারের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ রাখি, কোন পদ্ধতিতে একজন ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে বর্ণিত জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি কীভাবে তা অনুধাবন করেন এবং সচেতনভাবে তিনি কি কি পরিহার করেছেন। কোন ধরনের সমস্যা তিনি উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি কোনো নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করতে চেয়েছেন। তবে উপন্যাস বিচারের এ পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনায় রেখে আজকের উপন্যাস বিচার করা যায় না। সামাজিক চরিত্র বর্ণনের দক্ষতাও একটি ভালো উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এ উপন্যাসে সবচেয়ে বড় হয়ে এসেছে সামাজিক অবক্ষয়। কিন্তু সে অবক্ষয় ঠেকানোর জন্য কোনো কৃত্রিম প্রচেষ্টা লেখক সংগঠিত করে তোলার চেষ্টা করেননি। যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, এক দশকের মধ্যেই সে সব স্বপ্ন ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ক্ষমতার মেরুকরণ। কমরেড আকবরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যদিও এ উপন্যাসের পরিসমাপ্তি কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে, লেখক তার ওপর তার নিজস্ব চেতনার আলোকপাত করতে চেয়েছেন। বরং সত্য ও শ্লেষ এখানে একাকার হয়ে গেছে। কমরেড যজ্ঞেশ্বর রায়ের শিস্য কমরেড আলী আকবর যে একটি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতো তা এ উপন্যাসে দানা বেঁধে না উঠলেও একটি শুভ সময়ের অবসানের ইঙ্গিত এর মধ্যে লেখক দিয়ে যাচ্ছেন।

রাহাত খানের এ উপন্যাসটি সম্পূর্ণ শাহরিক আবহে রচিত। এর রক্তমাংসে শহর ও ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লড়াই, প্রেম ও সন্ত্রাস তবু ঔপন্যাসিক আলী আকবরের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ চৈতন্যের মধ্যে এ উপন্যাসের ইতি টেনেছেন। এতেই ঔপন্যাসিকের মূল প্রধাবণা লক্ষ করা যায়। পুরো উপন্যাসের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত হলেও শেষ অংশ থেকে কিছুটা উদ্ধার করা যায়। ‘খুলনা যশোরের প্রান্ত সীমায় গাছগাছালি ঘেরা একটি গ্রাম। কত কত মানুষের মুখ ভেসে উঠতে লাগলো।... ভেসে উঠলো পথের ছবি। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানা।

আলী আকবর দুঃখ করলো না। তার বুকের ব্যথা উত্তাল হয়ে উঠলো। দাঁত চেপে সব কিছু সহ্য করতে চাইল। মনে মনে এও ভাবতে চাইল যে আমি মরব না। আমি বেঁচে উঠব। আবার জীবন শুরু করবো যশোর থেকে। অনাহারজনিত খবরগুলো পত্রিকার পাতা থেকে কেটে কেটে রাখব ফাইলে। আর কম্প্রোমাইজ নয়। এবার বিপ্লব।’

লেখক যদিও বিপ্লবের আকাক্সক্ষা দিয়ে এ উপন্যাস শেষ করেছেন। তবু এ উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে একটি মরমিয়া সুর। এ উপন্যাসের নামকরণ থেকেই তা অনুমান করা যায। ‘হে অনন্তের পাখি’ মানে আত্মার প্রবাহমানতা। মানবের মহামিছিল। সময় এ মিছিলের নায়ক। শত ধারা একত্রে প্রবাহিত হলেও সময় সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আলী আকবর বিপ্লবী হলেও দোষেগুণের মানুষ। কিন্তু মানুষের শুভ ইচ্ছের মরণ নেই। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের ক্ষয়িষ্ণু সময়ের সেনানি আলী আকবর। কিন্তু মৃত্যু শয্যায়ও তিনি বিপ্লবকে সংগঠিক করে তোলার স্বপ্ন দেখেন। আমার মনে হয় ক্ষয়িষ্ণুতার চ‚ড়ান্তে এসেও লেখক তার এই নৈতিক মূল্য নিষ্কাশিত করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App