×

মুক্তচিন্তা

ভারতীয় রাজনীতির নিষ্ঠাবান শুদ্ধাচারী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩০ পিএম

ভারতীয় রাজনীতির নিষ্ঠাবান শুদ্ধাচারী
প্রণব মুখার্জি ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে পরিচিত ছিলেন ট্রাবলশ্যুটার বা ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে। ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি চাণক্য। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি তিনি সামলে দিয়েছেন ক‚টনৈতিক বুদ্ধির জোরে। যে কোনো কঠিন যুদ্ধেই জয় অনিবার্য করেই ফিরতেন তিনি। তবে এবারের সংকটটা আর কাটিয়ে উঠতে পারলেন না! এবারে রত্নহারা হলো ভারত। চলে গেলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জি। সোমবার দিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যু হলো তাঁর। নিজের করোনা আক্রান্তের খারাপ খবরটা নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। লিখেছিলেন, ‘অন্য চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলাম। করোনা পরীক্ষায় রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। গত এক সপ্তাহে যারা আমার সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের অনুরোধ করছি, সেলফ আইসোলেশনে থাকুন এবং করোনা পরীক্ষা করিয়ে নিন।’ এই লড়াইটা জেতা হলো না প্রণবের। চলে গেলেন ভারতীয় রাজনীতির এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিক প্রণব মুখার্জির পাশাপাশি মানুষ মনে রাখবে ব্যক্তি প্রণবকেও, যার জীবনজুড়ে নানা গল্পের আনাগোনা। সেই পাতাগুলোতেই একটু চোখ বোলানো যাক। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে যান প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের নড়াইলে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেবার বাংলাদেশ সরকারের আতিথেয়তায় মুগ্ধ প্রণবের মুখে শোনা যায় অজানা অনেক কাহিনী। প্রথম জীবনে, ১৯৬৩ সালে কলেজে অধ্যাপনা করতেন প্রণব মুখার্জি। এরপর ২০১৬। রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদ ফুরানোর ঠিক এক বছর আগের শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জিকে ফের পাওয়া যায় শিক্ষকের ভ‚মিকায়। দিল্লির রাজেন্দ্রপ্রসাদ সর্বোদয় বিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তিনি। বিষয় ছিল, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস ও বিবর্তন। প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন তিনি। রাত জেগে কাজ করতে ভালোবাসতেন সাবেক রাষ্ট্রপতি। কর্মযোগী মানুষটি স্বাস্থ্য সচেতন বরাবর। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমি প্রতিদিন লনে ৪০ রাউন্ড হাঁটি। হিসাব করলে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার। ৪০ বছর ধরে ডায়েরি লেখার অভ্যাস তাঁর। সারা দিনের নানা অভিজ্ঞতা নথিবদ্ধ রাখতেন তিনি। উদার অর্থনীতির যুগের আগে ও পরেও তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। এই রেকর্ড অন্য কারো নেই। কিন্তু এই লম্বা রাজনৈতিক সফর অসম্পূর্ণ থাকত যদি না তিনি ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসে ফিরে আসতেন। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সেই কংগ্রেসে ফেরার পথ খুব সহজ ছিল না। ১৯৮৯ সালে দলে ফিরতে পারলেও আগের সেই সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অবস্থান থেকে তিনি তখন অনেক দূরে। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধী যদি নিহত না হতেন, তাহলে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক যাত্রাপথ কোন দিকে এগুতো, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। রাজীবের মৃত্যুর পরে দলে ও সরকারে নরসিংহ রাওয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এবং সেই নরসিংহ-যুগ শুরু হতেই প্রণব মুখার্জির পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায়। প্রথমে তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদ পান। তার পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে ছিল কংগ্রেস। ফলে প্রণব মুখার্জিও ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই ছিলেন। ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। মনমোহন সিংহের সেই মন্ত্রিসভাতেও প্রণববাবু নাম্বার-টু হয়ে ওঠেন। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে হন অর্থমন্ত্রী। তবে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের মাপজোখে একটানা দুনম্বরে। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে চলে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্তই তিনি থেকে গিয়েছিলেন ওই অবস্থানে। রাষ্ট্রপতি পদে অনেককেই দেখেছে ভারত। কিন্তু প্রণব মুখার্জির মতো সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষমতাধর রাজনীতিককে রাষ্ট্রপতি পদে বসতে খুব একটা দেখা যায়নি। ফলে দেশের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক শীর্ষ পদাধিকারী হয়ে থেকে যাননি প্রণববাবু। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বসে প্রকৃত অর্থেই দেশের এবং রাজনীতির অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে নিজের মেয়াদ সসম্মানেই পূর্ণ করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। তার পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে প্রস্থান করেছিলেন। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় এলেন একটি আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনে। আমিও হাজির, তবে লেখক হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘পরিবেশ দূষণের চেয়েও বড় দূষণ মানুষের মন ও চিন্তার দূষণ। মানুষের হিং¯্রতার শিকার হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ। ভাষা সংস্কৃতি লুট হয়ে যেতে দেননি এদেশের মানুষ। এই হিংস্রতার বিরুদ্ধে আজ কবি শিল্পী সাহিত্যিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’ রাষ্ট্রপতি পদ ও সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে প্রণববাবু কীভাবে এখন অবসর কাটাচ্ছেন, হেসে জানতে চান হাসিনা। প্রণববাবু জানান, বই পড়তে তিনি ভালোবাসেন। কিন্তু রাজনীতির ব্যস্ততায় অনেক সময়েই তা হয়ে উঠত না। কিন্তু এখন অফুরন্ত সময়। আর তাই বই-ই তাঁর সব সময়ের সঙ্গী। সে পাঠের অন্ত হলো এবারে। অস্তমিত হলেন প্রণব। ভারত হারালো তার রত্ন আর বাংলাদেশ হারালো তাদের সেরা বন্ধুকে। উপমহাদেশের রাজনীতির জগতে তিনিই বোধহয় একমাত্র মানুষ যার প্রয়াণে মন ভার দুই বাংলার, দুদেশের। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App