×

মুক্তচিন্তা

আমাদের স্বজন ও অকৃত্রিম বন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:৩৭ পিএম

আমাদের স্বজন ও অকৃত্রিম বন্ধু
মৃত্যু স্বাভাবিক। কিন্তু সব মৃত্যুই আবার স্বাভাবিক নয়। পরিণত বয়সে প্রয়াণ ঘটলেও প্রণব মুখার্জির মৃত্যুকে আমরা খুব সহজে মেনে নিতে পারছি না স্বাভাবিক বলেও গ্রহণ করতে পারছি না। এর মূল কারণ তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশ একজন দক্ষ, স্থিতধি, প্রাজ্ঞ ও ধৈর্যশীল অভিভাবককে হারালো। বাংলাদেশ হারালো তার স্বজন, সুহৃদ এবং এক পরম আত্মীয়পুরুষকে। যে আত্মীয়ের সঙ্গে এই বাংলাদেশের মানবিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক সম্পর্কও ছিল গভীর এবং নিবিড়। বলাবাহুল্য, এই গভীর নিবিড়তার মধ্যে প্রবহমান ছিল মমতারও অনিঃশেষ ফল্গুধারা। তাই প্রণব মুখার্জি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু, অকৃত্রিম অভিভাবক, সুহৃদ-সহচর। হয়ে উঠেছিলেন আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনৈতিক নানা সংকট সমাধানের আশ্রয়স্থলও। আমরা আবেগগতভাবে কখনোই প্রণব মুখার্জির মতো অভিভাবকদের কাছ থেকে নির্ভরশীলতা হারাতে চাই না। তাঁর অভিভাবকত্বও হারাতে চাই না। তাই তাঁর মৃত্যুকে মেনে নিতে আমাদের মর্মস্পর্শী আবেগের জগতে হাহাকার ওঠে! কিন্তু তবুও মৃত্যুর কাছে আমাদের সব চাওয়া-পাওয়া উদ্ভ্রান্ত ও দিশাহারা হয়ে পড়ে প্রণব মুখার্জির প্রয়াণের মধ্য দিয়ে তা আবারো নিদারুণ অসহায়রূপে মূর্ত হয়ে দেখা দিল! প্রণব মুখার্জি রাজনৈতিক জীবনে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ককে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে রক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বাঙালি বলেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে ইতিহাসের গভীর তলদেশ থেকে অনেকটা যেন প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও আলোকে অবলোকন করেছিলেন। একদা তিনি বলেছিলেন : ‘ভারত ও বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক ও জাতিগত বন্ধন। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি ভারত সবসময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কেননা, আমরা অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক সংহতি ধারণ করি।’ অনেক সময় অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আমরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখি। তারা ইতিহাস থেকে জাতিকে, দেশবাসীকে বিচ্ছিন্ন করেন বলে কালের অমোঘ বিধানে ইতিহাস থেকে তারাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন উপমহাদেশীয় হাজার বছরের ইতিহাসের স্রোতধারায় সাঙ্গীকৃত। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাস ও প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক দর্শন প্রজন্মান্তরে কেবল প্রবহমানই থাকবে না অনেক প্রকৃত রাজনীতিবিদেরও পাথেয় হয়ে থাকবে। নিজ দেশের মানুষের অধিকার, স্বাতন্ত্র্যবোধ ও জাতীয় চেতনা সঞ্চারের প্রয়াস প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক জীবনের প্রেরণা। সেই সঙ্গে বিশ্ব মানবের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের বিষয়েও তিনি ছিলেন সোচ্চার। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রণব মুখার্জি সমর্থন করেছেন। সমর্থন করেছেন বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকেও। বাঙালির বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ দ্বারা উৎসাহিত করেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ বইতে। এই বইয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধ : দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামক অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রণব মুখার্জি নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন এভাবে : ‘১৫ জুন (১৯৭১) বাজেট অধিবেশন চলাকালে রাজ্যসভায় আমি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া। তখন একজন সদস্য জানতে চান কীভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে? উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় অংশগ্রহণের বহু দৃষ্টান্তও রয়েছে।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতির জন্য প্রণব মুখার্জি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা উদ্যোগেরও অংশীদার হয়েছিলেন। আমরা জানি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের করণীয় নির্ধারণে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক নৈকট্যও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গেও প্রণব মুখার্জি লিখেছেন : ‘সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের সভায় আমাকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন। সেই সভায় আমাদের কাজ ছিল প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এ বৈঠকে আমার ভ‚মিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠিয়েছিলেন।’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিও প্রণব মুখার্জির ভালোবাসা ও মমতার কথা আমরা জানি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৭ সালে তাঁরই নির্দেশে ভারত সরকার ব্যাপক ত্রাণ সামগ্রী পাঠায়। বাংলাদেশে চাল রপ্তানি বন্ধ হলে তাঁর নির্দেশেই ভারত পুনরায় বাংলাদেশে চাল রপ্তানি শুরু করে। তাঁরই উদ্যোগে বাগেরহাটের দুটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২ হাজার ৮০০ ঘর তৈরি হয়। এসব বৈশ্বিক সাহায্য-সহযোগিতার বাইরেও বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি প্রণব মুখার্জির যে নীতিগত ও দার্শনিক সমর্থন ছিল তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে আজ আমরা তা হারালাম। আর তাঁর মতো এমন অকৃত্রিম সুহৃদ বন্ধু ও সহায়কে হারালাম বলেই গভীর এক শোকস্তব্ধতায় ভারতবাসীর মতো আমরাও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে শোক প্রকাশ করেছেন তা কেবল রাষ্ট্রাচার মাত্র নয়। সেই শোকবার্তায়ও আছে প্রণব মুখার্জির প্রতি তাঁর মাধ্যমে এদেশবাসীরও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ স্বজনের মতোই তিনি আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিয়েছিলেন অভিভাবকত্বের আশ্রয়। সেই শোকবার্তায় তাই জননেত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্মৃতিমেদুর প্রসঙ্গও ঠাঁই পেয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন : ‘১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন এবং যে কোনো প্রয়োজনে আমার ছোট বোন শেখ রেহানা ও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জি সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যেকোনো সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন।’ শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনের পাশাপাশি একই শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন : ‘প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারালো একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারালো একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।’ আমরাও তাই জানি। কোনো নক্ষত্রেরই পতন হয় না। প্রণব মুখার্জির মতো রাজনৈতিক নক্ষত্রও উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে আলো ছড়াবেন অনন্তকাল। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে আমরা পরম আত্মীয় হারিয়েছি। আর ভারত হারিয়েছে তার নিজস্ব এক ভ‚মিপুত্রকে, গভীর দেশপ্রেমিক এক বরপুত্রকে। তাই ভারতের শোকও গভীর এবং অতল। এক গভীর বেদনাক্লিষ্টতায় মুহ্যমান ভারত। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেখানে শুরু হয়েছে সাত দিনের শোক। রাজনৈতিক শুধু নয় মানবীয় এক শোকের সাগরে ভাসছে আজ ভারত। প্রণব মুখার্জির প্রয়াণে শোকগ্রস্ত সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে পরপর তিনটি টুইট বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রেরণ করেছেন তা তাৎপর্যপূর্ণ। এরকম মনোভাবই রাজনীতির সর্বমহলে অনুশীলনের প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাবলম্বী শিবিরে অবস্থান সত্ত্বেও মনখোলা টুইট বার্তায় লিখেছেন : ‘ভারতরত্ন শ্রী প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত শোকাহত। আমাদের জাতির উন্নয়নে তিনি অমোচনীয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন। একজন পণ্ডিত, একজন গৌরবময় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক জগতে ও সমাজের সব শ্রেণির কাছে তিনি প্রশংসিত ছিলেন।’ অপর টুইটে লিখেছেন : ‘প্রণব মুখার্জি অর্থনৈতিক ও কৌশলগত মন্ত্রণালয়ে অনেক অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ পার্লামেন্টারিয়ান, সদাপ্রস্তুত, পরম বিজ্ঞ এবং চিত্তাকর্ষক।’ তাঁর তৃতীয় টুইটটিও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বলছেন : ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুখার্জি রাষ্ট্রপতি ভবনকে আরো সাধারণ, আরো বেশি জনমুখী করে তুলেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসকে শিক্ষা, উদ্ভাবন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের কেন্দ্রে পরিণত করেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর প্রাজ্ঞ পরামর্শ আমি কখনোই ভুলব না।’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদির এই টুইট বার্তা থেকে রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি ভবন সম্পর্কে আমাদের নতুন চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। প্রণব মুখার্জির গৃহীত উদ্যোগ অনুসরণীয় হলে অনেক রাষ্ট্রেরই মানসিক দৈন্য লাঘবের পাশাপাশি তার আত্মশক্তিও বলিষ্ঠ হবে কোনো সন্দেহ নেই। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App