×

জাতীয়

দুবছর কেন থমকে ছিল দুদকের অনুসন্ধান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২০, ০৯:০৮ এএম

এস এম মিজান

আলোচিত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হয় ২০১৮ সালের মাঝামাঝি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নোটিসের জবাবে তখন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের দায়সারা একটি হিসাব দাখিল করেছিল প্রদীপ দম্পতি। কিন্তু সম্পদের হিসাব দাখিলের পর গত দুই বছর অজ্ঞাত কারণে থমকে ছিল সেই অনুসন্ধান। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর প্রদীপের ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে ফের মাঠে নামে দুদক। দ্রুত অনুসন্ধান শেষে গত রবিবার এই দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন এতদিন কী কারণে থমকে ছিল দুদকের অনুসন্ধান। এর পেছনের রহস্যই বা কী?

জানা গেছে, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়। একই সঙ্গে তাদের সম্পদ বিবরণীর তথ্যউপাত্ত চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে নোটিস দেয়া হয়। নোটিস পেয়ে একই বছরের মে মাসে প্রদীপ দম্পতি আলাদাভাবে দুদকে সম্পদবিবরণী জমা দেয়। সেখানে তার ও স্ত্রীর নামে ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকার সম্পদ দেখানো হয়। সম্পদ বিবরণীতে প্রদীপের সম্পদের ঘোষণা ছিল মাত্র ৭০ লাখ টাকার কিছু বেশি। তবে চুমকির নামেই অনেক বেশি সম্পদের ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া নথিপত্রে চুমকিকে মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চুমকির সম্পদ বিবরণীতে বলা হয়, স্ত্রী চুমকির (গৃহিণী) নামে বোয়ালখালীতে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য খামার রয়েছে।

পাথরঘাটায় চার শতক জমি রয়েছে চুমকির নামে, যার মূল্য ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। ওই জমির ৬ তলা ভবনের বর্তমান মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার, পাঁচলাইশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকার জমি কেনা হয়। ২০১৭-১৮ সালে কেনা হয় কক্সবাজারে ঝিলংজা মৌজায় ৭৪০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, যার দাম ১২ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

প্রদীপ দম্পতির দুর্নীতি অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু সেখান থেকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা না দেয়ায় ফাইলটি সেখানেই স্থবির হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দুইজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কিছু জানাতে পারেননি। এছাড়া যেহেতু বর্তমানে প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাই অতীতের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে এখন দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করাই হবে মূল কাজ। এর বাইরে তারা বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

জানা যায়, মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর প্রদীপের ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বেরিয়ে আসতে থাকে তার ও স্ত্রীর নামে বিপুল সম্পত্তির তথ্য। এরপর ফের অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। অনুসন্ধান শেষে গত রবিবার প্রদীপ দম্পতির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক। দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজউদ্দিন বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) চট্টগ্রাম-২-এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় মোট ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, প্রদীপ ও তার স্ত্রী অসৎ উদ্দেশ্যে কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। তারা মোট ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন। চুমকি তার স্বামীর অর্থ নিজের কাছে রেখে তার অবৈধ সম্পদ উপার্জনে সহায়তা করেন। যা অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর সম্পৃক্ত অপরাধ। ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে এসব সম্পদ অর্জন করে তা স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করে ভোগদখলে রাখেন প্রদীপ ও চুমকি। এ অপরাধে কমিশন দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭(১) ধারা, অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ দ-বিধির ১০৯ ধারায় মামলা নথিভুক্ত করেছে।

জানা যায়, ২৬ বছরের চাকরিজীবনে প্রদীপ মানুষকে ক্রসফায়ারের ভয়, ঘুষবাণিজ্য, দখলবাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে যোগ দিয়ে চোরাকারবারি-ইয়াবাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। প্রবাসী ও শিল্পপতিদের ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। দুদক ও এনবিআরের চোখ ফাঁকি দিতে সম্পদ দেখানো হয়েছে স্ত্রী চুমকির নামে। প্রদীপের স্ত্রী চুমকি গৃহিণী হলেও দুদকে জমা দেয়া হিসাব বিবরণীতে মৎস্য খামারি দেখানো হয়েছে। ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূলধনের মৎস্য খামার থেকে চুমকি প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। লাভের টাকায় চট্টগ্রাম নগরীতে কিনেছেন জমি, গাড়ি ও বাড়ি। নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় চার শতক জমি (দাম ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা)। ওই জমিতে গড়ে তোলা ছয়তলা ভবন (মূল্য এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা), পাঁচলাইশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কেনা হয় ৬ গ-া ১ কড়া জমি (দাম এক কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা), ২০১৭-১৮ সালে কেনা হয় কক্সবাজারে ঝিলংজা মৌজায় ৭৪০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (দাম ১২ লাখ ৩২ হাজার টাকা)। সব স্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা। অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে প্রাইভেটকার (দাম পাঁচ লাখ টাকা), মাইক্রোবাস (দাম সাড়ে ১৭ লাখ টাকা) ও ৪৫ ভরি স্বর্ণ। ব্যাংকে ৪৫ হাজার ২০০ টাকা।

১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়া প্রদীপ ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর কুঞ্জুরি গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপের বাবা হরেন্দ্র লাল দাশ ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) নিরাপত্তা প্রহরী। তার দুই সংসারে রয়েছে পাঁচ ছেলে ও ছয় মেয়ে। প্রদীপের ভাই সদীপ কুমার দাশ সিএমপির ডবলমুরিং থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত। তাদের আরেক ভাই দিলীপ কুমার দাশ চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের হেডক্লার্ক হিসেবে কর্মরত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App