×

বিনোদন

ওয়েব প্ল্যাটফর্ম থেকে কতদূর দেশীয় সিনেমা?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২০, ১০:০৬ এএম

ওয়েব প্ল্যাটফর্ম থেকে কতদূর দেশীয় সিনেমা?

মুক্তির অপেক্ষায় মাহমুদ দিদার পরিচালিত বাংলাদেশের সিনেমা ‘বিউটি সার্কাস’

ওয়েব প্ল্যাটফর্ম থেকে কতদূর দেশীয় সিনেমা?

সদ্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া বলিউডের সিনেমা ‘রাত অ্যাকেলি হ্যায়’

কিছুদিন আগে কলকাতার নির্মাতা অভিরূপ ঘোষ ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সময়ে সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যত সংকটই আসুক সিনেমা হল থাকবে। তবে তার উত্তরের প্রেক্ষাপট কলকাতার সিনেমা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আর কলকাতাসহ সমগ্র ভারতের প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর। বিষয়টা একটু উদাহরণসহ বলি। ধরুন মি. এক্স ও মি. ওয়াই-এর একটি কোম্পানি আছে। যারা ভাত উৎপাদন করেন। এদিকে শুরুতে দুজনেই ভাতের ব্যবসা দিয়ে শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মি. এক্স ভাতের পাশাপাশি পোলাও, কোরমাসহ নানা মুখরোচক খাবার উৎপাদন শুরু করলেন এবং জনগণের মাঝে নতুন নতুন খাবারের চাহিদা তৈরি করে নিজের একটি শক্তপোক্ত জায়গা করে নিলেন। অন্যদিকে মি. ওয়াই সেই প্রথম থেকে এখনো ডাল-ভাতেই রয়েছেন। সুতরাং ডাল-ভাত মি. এক্স-এর কোম্পানিতেও পাওয়া যায়, সঙ্গে মুখরোচক খাবারও। ফলে জনগণ ডাল-ভাতের পাশাপাশি নতুন স্বাদের খাবারের দিকে ঝুঁকলো এবং মি. এক্স-এর কোম্পানি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে শুরু করলো। অন্যদিকে ভাত-ডালের ব্যবসায়ে পড়ে থেকে এক পর্যায়ে মি. ওয়াই তার কোম্পানিতে বড়সড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিলেন এবং বললেন এখানে পাঁচতারকা হোটেল হবে। সঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টও। অর্থাৎ বাঙলাদেশের সিনেমার অবস্থা মি. ওয়াইয়ের কোম্পানির মতো। এরা শুরু থেকেই ডাল-ভাত নিয়ে আছে, এখনো সে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি বা চেষ্টাও করেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যে ডাল-ভাত ছাড়াও এখন নানা ধরনের খাবার খাচ্ছে এবং খুবই সহজলভ্যে তা এদের কল্পনায়ও জায়গা করতে পারছে কিনা তা বোধগম্য নয়। ফলে পৃথিবীর অন্য কোথাও সিনেমা হল বন্ধ না হলেও বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমাণের সিনেমা হল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে এবং এই করোনাকালীন সংকটের পর তা আরো দ্বিগুণভাবে হবে বলেই মনে হয়। কোম্পানি যদি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় না থাকে তাহলে কোম্পানির দরজা খুলে রাখা না রাখা সমান কথা। বিশ্বে ইতোমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। অবশ্য এটি সময়ের চাহিদা বটে। তবে এ বিপ্লবে বাংলাদেশের কি অবদান রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জুতসই কোনো উত্তর মিলছে না! এ বিষয় নিয়ে তরুণ নির্মাতা মাবরুর রশীদ বান্নাহ বলেন, ‘বৈশ্বিক ওয়েব প্ল্যাটফর্মের যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে আমাদের কোনো রকম অবদান নেই। আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। করোনাকালীন এ সময়ে অ্যামাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য ওয়েব প্ল্যাটফরমগুলো যেভাবে এগিয়ে গিয়েছে সেখানে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। এর একটি কারণ আমাদের সামগ্রিক ব্যবস্থা। তার জন্য প্রথমেই আমাদের সহজে সিনেমা, নাটক পাওয়ার যে ব্যবস্থা সেটি বন্ধ করতে হবে। সালমান খান, শাহরুখ খান বা অন্যদের মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো আপনি চাইলেই ইউটিউব কিংবা বিনা মূল্যের স্ট্রিমিং সাইটে পাবেন না। কিন্তু আমদের এখানে ইউটিউবে আপনি নতুন নাটক থেকে সিনেমা সবই পাচ্ছেন। এ বিষয়টা বন্ধ করা প্রয়োজন। দর্শক ইউটিউবেও টাকা দিয়ে মেগাবাইট কিনে দেখে। ওয়েব প্ল্যাটফর্মে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিবশন করে দেখতে পারবে না? অন্যদিকে সিনেমা হলের ওপর নির্ভরতা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে আদৌ কোনো সফলতার মুখ দেখাতে পারবে কিনা তা নিয়ে বড় একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন ঢাকা শহরে স্টার সিনেপ্লেক্স বা বøক বাস্টার সিনেমা হলগুলো আছে। কিন্তু বাংলাদেশ মানেই তো ঢাকা নয়! দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল নেই। তাহলে সেসব জায়গায় কবে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল হবে, কবে তার ওপর নির্ভর করে আমরা সিনেমা বানাবো? মূলত আমাদের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সিনেমা হল পাঁচ মাস বন্ধ বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। একচেটিয়াভাবে কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করাটা ভালো কিছুর দিকে আমাদের নিয়ে যাবে না।’

[caption id="attachment_239620" align="aligncenter" width="700"] সদ্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া বলিউডের সিনেমা ‘রাত অ্যাকেলি হ্যায়’[/caption]

তিনি আরো বলেন, ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্ম একটি অবস্থান করে নিতে পারলে দেখা যাবে কাজের মান ভালো হবে। তাছাড়া নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, দর্শক প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের একটি দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। দর্শক টাকা দিয়ে আপনার একটি কাজ যখন দেখবে তখন অবশ্যই ভালো কিছু দেখতে চাইবে। আর আপনি যখন সরাসরি দর্শকের সঙ্গে কানেক্ট হবেন তখন অবশ্যই ভালো কাজ করার একটি চাপ থাকবে।’ এদিকে বিষয়টি নিয়ে নির্মাতা তানিম রহমান অংশু বলেন, ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেমা হলের বিকল্প হবে না ঠিক তবে সিনেমার ভবিষ্যৎ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ওটিটি কনসেপ্টটা এখনো ক্লিয়ার-ই না। দর্শক টাকা খরচ করে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে সিনেমা দেখবে এমন বিষয় এডাপ্ট করতেই পারেনি এখনো। তাছাড়া হলের বিপরীতে আপনি দর্শকের থেকে টাকা নিয়ে একটি সিনেমা দেখাবেন, তার গুণগত মান অবশ্যই ভালো হতে হবে। ফলে সব কিছুর বিবেচনায় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা আসলে বেশ সময়ের ব্যাপার।’ কিন্তু নির্মাতা দীপঙ্কর দীপন বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘সিনেমার জন্য আগামী দিনগুলো আসলেই ওটিটির দিন। সিনেমা হলগুলোর থেকে মানুষ বিনোদনের জন্য এই প্ল্যাটফর্মগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দিনকে দিন দেবেও। কিন্তু আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের চর্চা হচ্ছে তাতে আমরা ভুল পথে হাঁটছি এবং আমরা এটিকে হারিয়ে ফেলব। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য মূলত টিন্টি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, ওটিটির স্ট্যাকচার, দ্বিতীয়ত কনটেন্ট ও তৃতীয়ত দর্শক। এখন ওটিটির জন্য টাকা খরচ করা দর্শক আমাদের রয়েছে। আমাদের যেটা নেই তাহলো প্রোপার স্ট্যাকচার এবং কনটেন্ট। এ দুটি বিষয়ে নজর না দিলে আমাদের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পথে হাঁটা একেবারেই অসম্ভব।’ শিল্প বরাবর-ই বিকশিত একটি মাধ্যম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প পরিবর্তিত হয়। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যখন মুষড়ে পড়েছে তখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতেও তার আঁচ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে আঁচকে সময়ের প্রেক্ষিতে কাটিয়ে উঠতে বিশ্বের বড় বড় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সিনেমা হল কেন্দ্রিক না হয়ে ডিজিটাল ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নতুন সিনেমা মুক্তি দিয়ে বৈশ্বিক দর্শকের কাছে সিনেমাকে পৌঁছে দিচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে সিনেমা মুক্তি নেই, হল বন্ধ থাকায়। অথচ ওটিটি প্ল্যাটফর্মমুখী হলে একচেটিয়া হল নির্ভর হয়ে বসে থাকতে হতো না। সর্বোপরি পুরনো ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে যুগের সঙ্গে যে চলা যায় না এবং তার ফলাফল কি হতে পারে তা বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে এখনো যে সময় নেই তা নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সিনেমার মান্দাতার আমলের চিন্তা ভাবনাকে দূরে রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারলেই বাংলাদেশের সিনেমা, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বের কাছে একটি সম্মানজনক অবস্থান করে নিতে পারবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App