×

বিনোদন

৬৫ বসন্ত পার...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২০, ১০:৫৭ এএম

৬৫ বসন্ত পার...
৬৫ বসন্ত পার...

কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।

কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন তার জাদুময়ী কণ্ঠের নিপুণ ছোঁয়ায় জয় করেছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। মুগ্ধতাকে ছাড়িয়ে সমৃদ্ধ করেছেন এ দেশের আধুনিক গানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। সেই সত্তর দশক থেকে এ পর্যন্ত কতশত কালজয়ী গান তার কণ্ঠে আমরা পেয়েছি সেই পরিসংখ্যান রীতিমতো অভাবনীয়। চলচ্চিত্রসহ সবমিলিয়ে গেয়েছেন ১৬ হাজারের মতো গান।

এ বছর তিনি জীবনের ৬৫ বসন্ত পার করতে চলেছেন। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর কিংবদন্তি এই শিল্পী পা রাখবেন ৬৬ বছর বয়সে। সাবিনা ইয়াসমিনের পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরায়। খ্যাতনামা এই শিল্পী ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বল্লী ইউনিয়নের মুকুন্দপুর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। বড় হয়েছেন পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে। তার পরিবারের পাঁচ কন্যার চার জনই স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী। অপরদিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

ব্যক্তিজীবনে একজন ব্যাংকারের সঙ্গে প্রথম বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবুকে। ২০০০ সালে বিয়ে করেন নন্দিত গায়ক কবীর সুমনকে। সে সংসারও টিকেনি তার। বর্তমানে কবীর সুমনকে ছেড়ে একাই বাস করছেন এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে। সাবিনা ইয়াসমিন যেমন একজন তানপুরা প্রেমিক, তেমনি ছোটবেলায় ছিলেন হারমোনিয়ামের একজন একনিষ্ঠ সঙ্গী। পরিবারেই ছিল গানের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। একদম ছোটবেলা থেকেই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয়। হারমোনিয়ামে তোলা প্রথম ছড়াসঙ্গীত ‘খোকনমণি সোনা’। মাত্র ৭ বছর বয়সেই করেছিলেন স্টেজ পারফরম্যান্স। সুদীর্ঘ ১৩ বছর নিয়েছেন ওস্তাদ পিসি গোমেজের কাছে সঙ্গীতের তালিম।

ছোটবেলাতেই রেডিও-টেলিভিশনে শিশুশিল্পী হিসেবে গান গেয়েছেন। তবে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন ১৯৬২ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমাতে। তারপর ১৯৬৬ সালে খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমাতে প্লেব্যাক করেন। যে গান বাংলা আধুনিক সঙ্গীত ভুবনে জোয়ার তৈরি করেছিল সেই বিখ্যাত গান ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ গেয়েছিলেন গুণী নির্মাতা কাজী জহির পরিচালিত ‘অবুঝ মন’ সিনেমার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে পাখা মেলে উড়তে শুরু করে এই গানের পাখি ‘সাবিনা ইয়াসমিন’। ছোট্ট এই মানুষ জীবনে সাবিনা ইয়াসমিন সঞ্চয় করেছেন বিপুল অভিজ্ঞতা। মুখোমুখি হয়েছেন জীবন ও ইতিহাসের ভয়াল বাস্তবতার। নিজের চোখে দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পথের প্রান্তে পড়ে থাকতে দেখেছেন মানুষের লাশ।

সুরের মায়ায় গেঁথেছেন দেশপ্রেমের গান। যে গানগুলো প্রতিনিয়ত সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে গুনগুন করে। দেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত করে তরুণ প্রজন্মকে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে বাজতে থাকে এ দেশের মানুষের হাজারো প্রাণে। ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না/আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান কিংবা ‘একটি বাংলাদেশ/তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময়/তুমি আমার অহংকার’। তার গাওয়া এমন আরো অনেক দেশাত্মবোধক গানই সুর ছড়িয়েছে এ দেশের গ্রাম থেকে শহুরে মানুষের মনে।

শুরু থেকেই অনেক গুণী মানুষ এবং সঙ্গীতশিল্পীদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। অনেক শিল্পীদের সঙ্গে গেয়েছেন ডুয়েট গান, গুণী পরিচালকদের সিনেমায় করেছেন প্লেব্যাক। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মাহমুদুন নবী, কিশোর কুমার, মান্না দে, শ্যামল মিত্র থেকে শুরু করে কবীর সুমন, খুরশিদ আলম; এ রকম আরো অনেক লিজেন্ডারি গায়কদের সঙ্গে গেয়েছেন ডুয়েট গান। খান আতাউর রহমান, আর ডি বর্মণ, বাপ্পি লাহিড়ী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রমুখের সঙ্গীত আয়োজনে গেয়েছেন অসংখ্য গান। বাংলা গানের পাশাপাশি সাবিনা ইয়াসমিন হিন্দি ও উর্দু ভাষাতেও গেয়েছেন অনন্য সব কালজয়ী গান। সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। কখনোবা তাকে দেখা গিয়েছে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে। যদিও অভিনয়ের চেয়ে গানই তার চলার পথের পাথেয়। গানের জন্য ১৩ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন।

জীবন খাতায় যুক্ত করেছেন- একুশে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৬), ফিরোজা বেগম গোল্ড মেডেল (২০১৬)। এছাড়া তরুণ মজুমদারের ‘সজনী গো সজনী’ সিনেমাতে প্লেব্যাকের জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (বিএফজেএ) কর্তৃক পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার। সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। নায়িকার হাতের প্রক্সি হিসেবে ‘মনের মতো বউ’ ছবিতে ‘এ কি সোনার আলোয়’ গানে পিয়ানো বাজানোর দৃশ্য খান আতা শুট করেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘উল্কা’ চলচ্চিত্রে অবশ্য স্বনামেই একটি গানের দৃশ্যে অভিনয় করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন।

২০০৭ সালে সাবিনা ইয়াসমিন হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। জীবনযুদ্ধে অনেকদিন দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। তবে দেশ ও দেশের বাইরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে অগণিত মানুষের ভালোবাসায় এই দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ করেন। আবারো ফিরে আসেন এদেশের সঙ্গীত ভুবনে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App