×

জাতীয়

৫০ বছরের সাহিত্য জীবনের ইতি টানলেন রাহাত খান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২০, ০৯:০১ পিএম

সাংবাদিকতা পেশায় তিন দশক আর ৫০ বছরের দীর্ঘ সাহিত্য জীবন ছিল কথাসাহিত্যিক রাহাত খানের। যে জীবনের সবটুকুজুড়েই গভীর মানবপ্রীতির আকাঙ্খা নানাভাবে উৎকীর্ণ। তার সৃষ্টির যে কৃতিত্ব ও গৌরব এই নিয়েই ছিল একজন রাহাত খানের অনন্যতা। গল্প লেখা দিয়ে শুরু করলেও উপন্যাসে হাত দেন এবং ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষার অসাধারণ স্পষ্ট ভাষাভঙ্গির এক কথাসাহিত্যিক, নিরাভরণ গল্পের ক্ষুরধার কথাশিল্পী। তাকে বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ ও ভঙ্গি তৈরির অগ্রণী সৈনিকও বলা হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রাঞ্জল ভাষা রীতির প্রচলন করেছিলেন।

তার গদ্যের ভাষা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম, গতিময়তায় ভরপুর এবং কোনো দুর্বোধ্যতা ছিল না। বাহুল্য শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করতেন না তিনি। মানুষ এবং মানুষের জীবনকে ঘিরেই ছিল তার যা কিছু সাধনা। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যে নিমগ্ন করে রেখেছিল তার লেখক সত্তা। কিন্তু সকল প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব অমিমাংসিত রেখেই চিরবিদায় নিলেন তিনি! এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৫০ বছরের সাহিত্যজীবনের ইতি টানলেন রাহাত খান! গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় ইস্কাটনের বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শুক্রবার রাতে এই কথাসাহিত্যিকের মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়। গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয় প্রেসক্লাবে আনা হয় এবং জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে এই কথাসাহিত্যিকের মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধু, স্বজনসহ সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় জানাজায় অংশগ্রহণ করেন- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন সাহা, বিএফইউজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকারিয়া কাজল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়েনর সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁইয়াসহ প্রয়াতের পরিবারের সদস্য ও সাধারণ জনগণ। জানাজা শেষে মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় প্রেসক্লাব, প্রতিদিনের সংবাদসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। এসময় দেশের খ্যাতিমান এ সাহিত্যিক ও সাংবাদিককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তারা।বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, রাহাত খান অপূর্ব ও বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী ছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয় তার কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রাহাত খান। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। এসেছিলেন জসীমউদ্দিন ও জয়নুল আবেদিন। আমাদের গর্ব এটাই রাহাত ভাই সেই বয়সে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাহিত্যে। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্যে যে একটি গতিময় বাংলা ভাষা আছে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে পরবর্তীতে বাংলাদেশে যাদের হাত ধরে তা প্রবাহিত হয়েছে রাহাত খান তাদের অন্যতম। রাহাত খানের সহধর্মিনী অপর্ণা খান বলেন, আপনাদের সবার কাছে রাহাত খানের জন্য আমি দোয়া প্রার্থী। আমাদের পরিবারের জন্যও আপনাদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করি। আর এ দুঃসময়ে যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, আমরা যেন একটা লাশের মিছিলের মধ্যে আছি। এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের ১৬ জন সদস্যকে হারিয়েছি। এদের মধ্যে সর্বশেষ রাহাত ভাই, যিনি আমাদের অত্যন্ত প্রিয় সাংবাদিক ও অভিভাবক। শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও রাহাত খান কিংবদন্তিতুল্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, রাহাত খান শুধু কর্মজীবনে নয়, ব্যক্তি জীবনেও নিরহংকার ও অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি সুন্দর ও নান্দনিক জীবন-যাপন করতেন। রাহাত খানের কাজ, তার কথা, সান্নিধ্যের অভাব আমরা দীর্ঘদিন অনুভব করবো। এরপর মরদেহ তার সর্বশেষ কর্মস্থল ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ কার্যালয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাদ জোহর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শেষ ইচ্ছানুযায়ি তাকে সমাহিত করা হয়।

রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৬০-এর দশকে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন শিক্ষক হিসাবে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষ করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। তারপর একে একে জগন্নাথ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি রাহাত খানের। পরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। সর্বশেষ তিনি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হলেও রাহাত খান ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক। বর্ণাঢ্য জীবনে রাহাত খান ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয় প্রকাশিত হয়। তার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি। জনপ্রিয় ও বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তাঁকে অনুসরণ করেই তৈরি করা। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App