×

সারাদেশ

স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দু’চাকরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২০, ০২:৪৩ পিএম

স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দু’চাকরি

সুজন বড়ুয়া

বান্দরবানে বরখাস্ত, বিস্ময়কর পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামে বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক

উপজাতি নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বরখাস্ত বান্দরবানের জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সুজন বড়ুয়া। অথচ তিনি বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন অফিসে। বিস্ময়করভাবে একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক।

এছাড়াও স্বাস্থ্য বিভাগের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে নেন তিনি একাই। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন’র (পিএসসি) অনুমোদন ছাড়াই ড্রয়িং ডিস্বার্সিং (আয়ন-ব্যায়ন) অফিসার পদ ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের স্বাক্ষরে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য আনুসাঙ্গকি অর্থ উত্তোলন করেন প্রায় দু’বছর ধরে। শুধু তাই নয়! কক্সবাজার ও বান্দরবানের স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতির মাধ্যমে একই সংস্থায় দুইটি চাকরি নেয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পরের নিয়োগটিতে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পদোন্নতি বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন সুজন বড়ুয়া।

সুজন বড়ুয়া’র ক্ষমতার এতই প্রভাব যে, ভয়ে তার এসব অভিযোগের বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সব কিছুই জানা আছে, এমনটা জানিয়ে সুজন বড়ুয়া’র জাল-জালিয়াতি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি’সহ অন্যান্য কর্মকর্তাগণ।

এদিকে সুজন বড়ুয়া দীর্ঘ ৮ বছর সরকারি চাকরি করার পর আগের স্থায়ী ঠিকানা ও তথ্য গোপন করে জালিয়াতি করে একই সংস্থায় ফের আরেকটি উচ্চপদে চাকরি এবং তিন পদোন্নতির নেয়ার অভিযোগ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পরই এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছে র্দুনীতি দমন কমিশন। গত দুই বছর আগে দুদক’র দেয়া এই চিঠি পেয়েও রহস্যজনক কারণে সুজন বড়ুয়া এসব অভিযোগ মাঠ পর্যায়ে তদন্ত না করেই পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

র্দুনীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও রাঙামাটি-বান্দরবান দু’পার্বত্য জেলা পরিষদ’র চেয়ারম্যান বরাবরে বিভিন্ন সময় সুজন বড়ুয়ার জাল-জালিয়াতি অনিয়ম ও যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এসব অভিযোগ তদন্ত না করেই অভিযোগের মাধ্যমে অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির প্রকাশ করে দেয়ার অভিযোগে উল্টো অভিযোগকারীদেরকে বিভিন্ন সময় শাস্তি প্রদান করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সুজন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে জমাপড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০০৪ সালে ‘স্বাস্থ্য সহকারী’ পদে চাকরি নেন ‘সুজন বড়ুয়া’। সেই সময় তার স্থায়ী ঠিকানা দেখান কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলিদিয়া ইউনিয়নের মরিচ্যা পালং গ্রাম। ওই গ্রামের-ই বিমল বড়ুয়া’র পুত্র তিনি। ‘স্বাস্থ্য সহকারী’ পদে প্রায় ৮ বছর চাকরি করার পর এই চাকরি থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে আবারও চাকরি নেন সুজন। এই চাকরির নিয়োগপত্রে তার স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয় “পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বালুখালী উত্তর ঘুনধুম বড়ুয়া পাড়া”। কারণ জেলা পরিষদের এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা ব্যতীত বাহিরের প্রার্থীরা আবেদন করার সুযোগ ছিল না।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ওই“ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’র” ৮নম্বর শর্ত উল্লেখ রয়েছে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চাকরি’র জন্য আবেদন করতে হবে। এছাড়া যোগদানের আগে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র গ্রহণ করতে হবে। তবে নিয়োগের এসব শর্ত কোনটিই মানেননি সুজন বড়ুয়া। নতুন চাকরির আবেদন ও নিয়োগপত্রে স্থায়ী ঠিকানা পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুনধুম বড়ুয়া পাড়া দেখালেও সুজন বড়ুয়া মূলত কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলিদিয়া পালং গ্রামের বাসিন্দা।

২০১২ সালে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে নতুন চাকরি নিয়ে পার্বত্য রাঙ্গামাটির রাজস্থলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে যোগদানের পরপরই সুজন বড়ুয়ার স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতির অভিযোগটি প্রকাশ পায়। সে সময় সুজন বড়ুয়ার পার্বত্য ভুয়া নাগরিকত্ব ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি এবং স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কোটায় চাকরি নেয়ার বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’র চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন রাঙামাটির স্থানীয়রা।

এই অভিযোগের পরই গোপনে স্ট্যান্ড রিলিজ নিয়ে চলে যান বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে নিজ বেতনে পদায়ন হয়ে বান্দরবান জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে যোগদেন। ওই সময় সুজন বড়ুয়া উপজাতি মারমা সম্প্রদায়ের এক নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নানানভাবে হয়রানি করতে থাকেন ওই নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে। যৌন হয়রানির শিকার ওই নারী স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পরে এর প্রতিকার চেয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে। এই ঘটনায় সুজন বড়ুয়াকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি বিভাগীয় মামলা রুজু দায়ের করেন বান্দরবানের সিভিল সার্জন।

সে সময় ঘটনা আড়াল করে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে স্ট্যান্ড রিলিজ নিয়ে সুজন বড়ুয়া চলে যান ফেনী সিভিল সার্জন অফিসে। এবার তিনি জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর’র বেতনে (নিজ-বেতনে) পদায়ন হন জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে। ফেনী জেলায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টর দায়িত্ব পালনের কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন সেখানকার ছয়জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। একইভাবে এই অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ২০১৮ সালে ফেনী সিভিল সার্জন অফিস থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ নিয়ে যোগ দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন অফিসে। এরপর জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়কের বেতন-ভাতায় দখলে নেন ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক’ এর গুরুত্বপূর্ণ পদটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে চাকরি জীবন শুরু করেন সুজন বড়ুয়া। স্থায়ী ঠিকানা জালিয়াতি করে ২০১২ সালে শুরুতে উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে নতুন নিয়োগ নিয়ে যোগ দেন তিনি। এরপর জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সর্বশেষ বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক পদে পদায়ন হন অলোকিকভাবে। এসব নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিকে পুরোপুরি আড়াল করেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর’র চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পদোন্নতি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২১ জুলাই জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর’দের (ডিএসআই) ১৫ জনকে জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক (ডিএইচএস) পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগে ডিএসআই ও ডিএইচএস পদোন্নতি-পদায়ন যোগ্য প্রার্থীদের পদোন্নতির প্রেডেশন তালিকা প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত ১৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেই তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। আর ওই ডিএইচএস পদোন্নতি তালিকায় চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়কের সুজন বড়ুয়ার অবস্থান ২২ নম্বরে। তবে এই তালিকার ১৫ জন পদোন্নতি পেলেও বাদ পড়েন সুজন বড়ুয়াসহ মোট ৭ জন। যদিও সুজন বড়ুয়া প্রায় দু’বছর এই পদ ব্যবহার করে সরকারি সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুজন বড়ুয়া বলেন, এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কর্মদক্ষতায় তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক হয়েছেন। আগে কক্সবাজারের উখিয়ায় স্বাস্থ্য সহকারী পদে চাকরি করলেও ২০১১ সালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে জমি কিনে স্থানীয় বাসিন্দা হয়েছি। পরে ২০১২ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পদোন্নতি নিয়েছি। তবে এটা নতুন কোনো নিয়োগ না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি এডভোকেট জয়নাল আবদীন সম্রাট বলেন, সরকারের পার্বত্য বিধি অনুযায়ী সমতলের অ-উপজাতিদের তিন পার্বত্য জেলায় ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, বন্দোবস্তি ও বাসিন্দা হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যদি সমতলের কোনো ব্যক্তি পাহাড়ে গোপনে জমি ক্রয় করেন; তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং দন্ডনীয় অপরাধ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, অভিযোগ অনেক আগের, আমার সময়ের না। আর এই বিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মহোদয় অবগত আছেন। তাঁরাই বিষয়টা দেখছেন।

সুজন বড়ুয়ার জাল জালিয়াতি এসব অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলতেই চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির একটু উত্তেজিত কন্ঠে বলেন, এইটা এক-দুই-তিন নম্বর ব্যক্তি সম্পর্কে কথা উঠতে পারে। তাদের সম্পর্কে বলতে পারে মন্ত্রী মিনিস্টাররা। আমি এখানে বইসা আমার ওর সম্পর্কে এর সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলে উত্তর দিতে বাধ্য নই এবং দেবও না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App