×

সাময়িকী

বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫২ পিএম

বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ এবং এ ব-দ্বীপ ভূমির মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর বুকে কী গভীর মমতা ছিল, আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৭০-এ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে যখন লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালো-গৃহহীন-বিপন্ন হলো, তখন তাঁর তৎপরতার কথা পত্রিকায় পড়ে অভিভ‚ত হয়েছি। বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি তাঁর জীবনের উজ্জ্বল সময়গুলো কারাগারে কাটিয়েছেন, বাঙালির চোখে তিনি স্বশাসিত হবার স্বপ্ন এঁকে দিয়েছেন; ফাঁসির রজ্জুকেও তিনি তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা এমন এক হৃদয়বান নেতার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষের তাঁর প্রতি আস্থা দেখে আমার বুকেও স্বাধীনতার স্বপ্ন জেগে উঠেছিল। বাঙালির আকাক্সক্ষা পূরণে তাঁর বজ্রকঠিন উচ্চারণ আমার বুকে বিশ্বাস দিয়েছিল, এইতো আমাদের নেতা! তিনিই পারেন আমাদের পথের দিশা দিতে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে যখন তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকেদের (তিনি বলেছিলেন-‘আমার লোকের উপর’) হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর-কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো! তোমাদের যার যা-কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো! মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো! এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ! এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম! জয় বাংলা!’ আমার কচি হৃদয় মুক্ত হবার জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল সেদিন। তাই তো ৮ মার্চ থেকে পাকিস্তানি দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হবার স্বপ্নে আমরা যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলাম তেমন কিছু না বুঝেই। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতি বেতারযন্ত্র সামনে নিয়ে বসে থাকলেও সেদিন রেসকোর্স মাঠ থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিও সরাসরি সম্প্রচার করেনি, ৮ মার্চ রেডিওতে সেই ভাষণ প্রচার করা হয়। একজন নেতার আহ্বান লক্ষ মানুষের অন্তর কী-করে উদ্বেল করে, সেদিন আমি তাই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস দিয়েছিলেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? সংস্কৃতি মানেই তো অগ্রসরচিন্তা। সংস্কৃতি মানেই তো প্রবহমান নাব্যনদী; নদী তার প্রবহমানতা হারালে যেমন অনাব্য হয়ে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, নদীজল মজে-পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়; সংস্কৃতি হারালে মানুষও মজানদী হয়ে পড়ে; মানুষের সংস্কৃতিমান থাকতে তার মুক্তির প্রয়োজন অনিবার্য, এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; বঙ্গবন্ধুই আমাদের শিখিয়েছিলেন ‘স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তি’ শব্দ দুটির পার্থক্য। বাঙালির জীবনে অর্থবহ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জীবনের সেই কঠিন সত্যটির কথা মাথায় রেখেই ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক রচনার সূত্রপাত করতে চাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর যৌবনের সোনালি দিনের অনেকগুলো বছর যেমন কারাগারের অন্ধকারে কাটিয়েছেন; তেমনি দেশবাসীর ভালোবাসার টানে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বাংলার গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে আমরা তাঁর জীবন-সংগ্রামের কিয়দাংশ জানতে পেরেছি, কিন্তু অজানা রয়ে গেছে তাঁর কর্মময় জীবনের বৃহদাংশই। বাঙালি জাতির কষ্ট লাঘবের চিন্তায় জীবন কেটেছে তাঁর অস্থিরতায়। উদ্বিগ্ন জীবনে যখন মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দুশ্চিন্তায় কাটে তখন সুকুমারবৃত্তির কথা ভাববার চেয়ে আবশ্যিকতা প্রয়োজন-মুক্তির সংগ্রাম জরুরি হয়ে পড়ে। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানি দুঃশাসনের ২৩ বছর বঙ্গবন্ধুর অবকাশ ছিল না আলাদা করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করা; কিন্তু তারপরও যেটুকু জানতে পারা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর যাপিত জীবনের অবসর মুহূর্তগুলো, বিশেষ করে কারাজীবনে যখন সময় পেতেন, তখন সাহিত্যপাঠে কিছু সময় ব্যয় করতেন; ব্যক্তিগত জীবনে সামান্য ফুরসতে তিনি পাঠমগ্ন হতেন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন এরপর তিনি দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন; যদি ধরে নিই ১৫ জানুয়ারি থেকে তিনি কাজ শুরু করেন, তাহলে তাঁর শাসনামল ৩ বৎসর ৭ মাসকাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন মানুষের খাদ্য নাই, লজ্জা নিবারণের বস্ত্র নাই, যখন কলকারখানায় উৎপাদন নাই, ব্রিজ-কালভার্ট ভাঙা, চলাচলের ব্যবস্থা নাই; উপরন্তু ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত শত্রুর লাগাতার ষড়যন্ত্র; বঙ্গবন্ধু যখন বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে চিৎকার করে বলছেন দেশের দুর্দশার চিত্র, যখন তিনি তাঁর দেশের মানুষকে বারবার বলছেন, ‘তিন বছর আমি তোমাদের কিছুই দিতে পারবো না!’ মানুষ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অঙ্গীকার করছে, ‘কিছুই চাই না আমাদের!’ তখন একদল কুচক্রী, মানুষের অধিকারের দোহাই দিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে এবং তাদের প্রকাশ্যে অথবা গোপনে উসকে দিচ্ছে দুই দল ষড়যন্ত্রী; তাদের একদল ৭১-এর পরাজিত শক্তি, অন্যদল অসময়ের হঠকারী বিপ্লবী; আর বঙ্গবন্ধু তাঁর ঔদার্য-মহানুভবতায় সবাইকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। যদিও কখনো কখনো তিনি ‘লালঘোড়া দাবড়ানো’র কথা উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তিনি ততটা কঠোর হতে পারেননি কখনো; উল্টো তিনি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছেন। অতঃপর ১৯৭৪-এর দুর্যোগ! এই যখন দেশের বাস্তবতা, তখন সেই দেশের হৃদয়সংবেদী সরকার প্রধানের সুযোগ কোথায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো সুকুমারবৃত্তি নিয়ে প্রজাবৎসল সরকারপ্রধানের ব্যস্ত হবার? তারপরও কি তিনি থেমে ছিলেন? আমরা যদি পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের দিকে তাকাই, কী দেখবো? আমরা দেখবো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি জাতিকে একটি প্রাগ্রসর চিন্তার সংবিধান উপহার দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সেই সংবিধান বিশ্বের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দলিল। যদি বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তির ক্ষেত্রে অবদানের কথা বলতে হয়, তাহলে অকপটে বলা যায় ১৯৭২-এর সেই সংবিধান বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তির অনন্য দলিল। ৭২-এর সংবিধানে কী ছিল? সেখানে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের চারিত্র্যিক মূলভিত্তি বলা হয়েছিল চারটি; জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা; একটি আধুনিক প্রাগ্রসর জাতির জন্য এরচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংবিধান কী হতে পারে? একটি নিমজ্জমান জাতি যদি তার পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে এই চার মূলনীতিকে ধারণ করতে পারে, তাহলে সে জাতিকে অগ্রযাত্রার পথে পেছনে তাকাতে হবে কেন? সে বিবেচনায় সহজেই বলতে পারি সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় ১৯৭২-এর সংবিধান বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী অবদান। কিন্তু ধর্মান্ধ ষড়যন্ত্রীরা তাদের কুসংস্কার-কূপমণ্ডূকতা-সংকীর্ণতায় বিরোধিতা করলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক চারনীতিকে। বিরোধিতা করা হলো ধর্মের দোহাই দিয়ে। তারা বললো, ধর্মনিরপেক্ষতা সংখ্যাগুরু মুসলমানের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে, তারা ভুলে গেল, পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান বলে স্বীকৃত ‘মদীনার সনদ’ ধর্মনিরপেক্ষতার কনসেপ্টের ভিত্তিতেই রচিত হয়েছিল; এবং সেটির রূপকার ছিলেন ইসলামের নবী স্বয়ং হজরত মুহাম্মদ (দ:)। তাদের প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু নিজে বলেছেন, “যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। আপনারা যাঁরা এখানে মুসলমান আছেন, তাঁরা জানেন যে, তাঁর খোদা যিনি আছেন তিনি ‘রাব্বুল আলামিন’ ‘রাব্বুল মুসলিমিন’ নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান।” (১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে প্রদত্ত ভাষণ)। অন্যদিকে একদল বাম বললেন, “গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রের সহাবস্থান অলীক বিষয়!” কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এক প্রেমময় কল্যাণ রাষ্ট্র! যে কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক পাবে সমান মর্যাদা, পাবে সমান অধিকার, পাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা; যে সত্যের উচ্চারণ ছিল খোদ মদীনার সনদেও। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রীরা প্রেমময় কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিয়ে গেল মৌলবাদী চিন্তার পাকিস্তানি প্রভুদের দিকে। আমরা জানি, উৎকট-উগ্র সংস্কৃতির আগ্রাসী চারিত্র্য প্রায়শ শিষ্ট-সংস্কৃতিকে বিপন্ন করতে চায়, কিন্তু শিষ্ট-সংস্কৃতি সহজে পরাভব মানে না; এর একটাই কারণ, শিষ্ট-সংস্কৃতির শিকড় প্রথিত থাকে আপন মৃত্তিকায়। মানুষের সংস্কৃতির যোগ যখন মৃত্তিকার সাথে সংযোগ হারায় তখনই ঘটে বিপর্যয়; তখনই অপসংস্কৃতি-বিজাতীয় সংস্কৃতির উৎকট-উগ্র প্রভাব ভাসিয়ে নিয়ে যায় দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধকে, ডুবিয়ে-ভাসিয়ে তছনছ করে দিতে চায় আবহমানকালের লালিত সংস্কৃতিকে। এ সত্য কেবল সংস্কৃতিকর্মী বুঝলেই হবে না, বুঝতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও। বঙ্গবন্ধু এ সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই বাঙালিকে দিশা দিয়ে বিজয়ের মোহনায় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু সবসময়ই বাংলার মাটি ও মানুষের কথা, বাঙালির নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির কথা বলেছেন, তিনি যে মনে-প্রাণে একজন বাঙালি সে কথা সগৌরবে উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্বের গৌরব আমরা শুনি ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি, যেদিন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নামলেন, সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যখন তিনি রবীন্দ্রনাথকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, “আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরু মিথ্যাকথা প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ, আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে; দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এত লোক জান দেয় নাই।” একই ভাষণের অন্যত্র তিনি বলেন, “জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম; আমি বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান; একবার মরে দুইবার মরে না! আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাবো না! তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না!” তাঁর বাঙালিত্বের গৌরব আমরা প্রত্যক্ষ করি যখন তিনি ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়ে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাঙালিকে গৌরবান্বিত করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংস্কৃতি-শৌর্য-বীর্যের কথা উচ্চারণ করেছেন বারবার। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সে সত্যের সংশ্রব অনেকাংশেই খোয়া গেছে বলে আমরা আজ সংকটাপন্ন-দ্বিধাগ্রস্ত-দ্বিধা-ত্রিধা বিভক্ত হয়ে আছি। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের দিকে তাকাই দেখবো, দেশের সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবির প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের জন্য টঙ্গীতে জমি বরাদ্দ করেন, যেখানে প্রতিবছর তবলিগ জামাতের উদ্যোগে বিশ্ব-মুসলিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ‘বিশ্ব ইজতেমা’ আয়োজিত হচ্ছে। তিনি তাঁর শাসনামলেই ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’-এর মতো কালাকানুন বাতিল করেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩) ‘কসাচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা ও প্রকাশের পর তোলপাড় হয় ইংরেজ শাসকমহলে। ফলশ্রুতিতে ইংরেজ শাসকরা ১৮৬৩ সালে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ জারি করে নাটকের উপর সেন্সরশিপ প্রথা চালু করে। একশত দশ বছর ধরে চলা সেই আইনের কারণে যে কোনো নাটক মঞ্চায়ন করতে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেতে হতো। নাট্যকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকে এ আইন বাতিলের দাবি করলেও কেউ সে আইন বাতিল করেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যখন দেশে নাট্যচর্চা বেগবান হলো, সঙ্গত কারণেই অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের দাবিও জোরদার হলো, শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নাট্যচর্চার স্বার্থে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করেন; সন্দেহাতীতভাবে যা দেশে নাট্যান্দোলনের জন্য সহায়ক ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই বাংলাদেশ টেলিভিশন রামপুরায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসহ তাদের কার্যক্রম শুরু করে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থাকে (এফডিসি) বঙ্গবন্ধুই করপোরেশনে উন্নীত করে এ দেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে যাবার পথ করে দেন এবং তাঁর আমলেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করে চলচ্চিত্রের শিল্পী-কুশলীদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, শিক্ষা ছাড়া জাতির পক্ষে সংস্কৃতিমান হওয়া সম্ভব নয়, তাই তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন এবং ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বই এবং গরিব-মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পোশাক প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন; নৈতিকতাবিরোধী বলে তিনি রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে উদ্যান তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। আইন তৈরি করে মদ্য উৎপাদন ও আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধদের পুনর্বাসনের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন, নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; শিশুর সার্বিক কল্যাণ চিন্তায় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ‘শিশু আইন প্রণয়ন করেন, তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়, শিশু পুরস্কার প্রবর্তিত হয়। বঙ্গবন্ধু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-নেপাল প্রভৃতি রাষ্ট্র সমন্বয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করেন, পরবর্তীতে তা-ই ‘সার্ক’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা গানের বুলবুল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’ উদ্বোধন করে সাহিত্যকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলার মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন। অফিস-আদালত এবং জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার তিনি বাধ্যতামূলক করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেকে একজন পরিপূর্ণ বাঙালি হিসেবে, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন তাঁর কর্মে-চিন্তায়-আচরণে। বাঙালির সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রণয়ন করে গেছেন; যে রূপরেখার আলোকে যতক্ষণ আমরা নিজেদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করবো, ততক্ষণ কোন শক্তিই বাঙালিকে প্রতিহত করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বাঙালির যতো আয়োজন হবে, সেসব আয়োজন থেকে আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং জীবন সৌন্দর্যকে নিজেদের অন্তরে ধারণ করতে পারি, তাহলেই আমাদের মুক্তি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App