×

সাময়িকী

দাদুর সৃষ্টি বাঙ্গালির সম্পদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২০, ০৯:২৭ পিএম

দাদুর সৃষ্টি বাঙ্গালির সম্পদ

কাজী নজরুল ইসলাম

প্রমীলাদাদি মারা যান ১৯৬২ সালের ৩০ জুন, তারপর বাবা দাদুকে নিয়ে আসেন ক্রিস্টোফার রোডের ফ্ল্যাটে। এর আগে দাদু ছোটচাচার (কাজী অনিরুদ্ধ) বাসায় ছিলেন। ১৯৪২ সালে দাদু সৃষ্টিশীলতার অবসানে চলে যান। পরিবারে মহাবিপর্যয় নেমে আসে। এর অনেক পরে ১৯৫৩ সালে দাদুকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হয়। একই বছরে ভিয়েনা থেকে নিরাময় না হওয়ায় ফিরিয়েও আনা হয়।

বেশ কিছুদিন পর কবিপরিবার থেকে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেবিকা চাওয়া হয়। সে বিজ্ঞাপন দেখে উমা মুখার্জি নামে একটি তরুণী কবির মানিকতলার বাড়িতে চলে যান। সেবিকারূপে কবির সেবা করতে করতে কবির জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচীর প্রেমে পড়ে যান। শ্রুতিফল বিয়ে। দাদি মারা যাওয়ার পর বাড়ির সবাই ঠিক করলেন ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে বাবা ও মায়ের কাছে দাদু থাকবেন।

দাদুর সেবাযত্ন মা নিয়মমাফিক করতেন। আরো দুজন লোক দাদুর অন্যান্য কাজ করে দিতেন। বাবার মুখে শুনেছি কাট্ট শিং ও কুশা সাউ নামে দুজনকে দাদু ছোটবেলায় নিয়ে আসেন। কাট্ট শিং ছিলেন কারমাটারের সিনারজুড়ি গ্রামের মানুষ। এটা বিহার জেলায় অবস্থিত। কুশা সাউ এসেছিল উড়িষ্যা থেকে। সংসারের সব কাজই তারা করত। বাবা ও চাচাকে স্কুলেও নিয়ে যেত। এদের কোলে-পিঠে যেমন কবির দুই পুত্র মানুষ হয়েছে, পরবর্তীকালে আমরা ভাইবোনেরাও এদের স্নেহের পরশ পেয়েছি। মায়ের কাছে শুনেছি, পরিবারের চরম দুঃখেও তারা অবিচল থেকে পরিবারকে তাদের সেবা দিয়ে সহযোগিতা করে গেছে। এদের অবদান আমাদের পরিবার আজো মনে করে।

আমাদের ছোটবেলা কেটেছে কলকাতায় ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে দাদুর সঙ্গে। নানা স্মৃতি আজ মনে ভিড় করে আসে। কত স্মৃতি- ভোলা যায় না। সারাদিন গুণীজনের আনাগোনা, গান হচ্ছে, কবিতা পড়া হচ্ছে। গানে-কবিতায় বাড়িটা মুখরিত হয়ে থাকত। পারিবারিকসূত্রে তিনি আমার দাদু- এটা যে রকম সত্যি, তেমনি সব শ্রেণির মানুষের তিনি প্রাণের কবি, যিনি বিশে্ব সমাদৃত ও পরম শ্রদ্ধেয়- ভাবতেই গর্বে মনটা ভরে যায়। আমাদের ঘরের দেয়ালে দাদুর বিখ্যাত সেই ছবিটা টাঙানো থাকত, আমরা অবাক হয়ে দাদুর যৌবনের ছবিটা দেখতাম। আমি যখন দাদুকে দেখলাম, বুঝতে শিখলাম, তখন তিনি সম্পূর্ণভাবে নির্বাক। একটা খাটের ওপর নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতেন। কখনো-বা অনেক খবরের কাগজ পাশে নিয়ে বসে আছেন, কী যেন ভাবছেন আবার পড়ার মতো করে বিড়বিড় করে পড়ছেন, তখনি ছিঁড়ে ফেলছেন। সারা ঘরে হাঁটছেন, খোলা জানালার পাশে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আনমনে কী যেন বলতেন আর হাসতেন। দাদুর কাছে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, দাদুও তাকিয়ে থাকতেন। মাঝেমাঝে আমরা ভাইবোন দাদুর কোলে হাত রাখতাম, দাদু তাঁর সুন্দর দুটি হাত দিয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন। আমরা তিন ভাইবোন প্রায়ই দাদুর সঙ্গে সময় কাটাতাম, তাঁর সঙ্গে কথা বলতাম- ইশারাতে তিনি জবাবও দিতেন। যেমন, দাদু আমাদের সঙ্গে একটু খেলবে? তুমি পর্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াও, আমরা তোমাকে খুঁজে নেব। ঠিক কবিদাদু পর্দার পাশে লুকানোর ভঙ্গি করে দাঁড়াতেন, আমরা খুঁজে নিতাম। আবার আমরা পর্দার পাশে গিয়ে দাদুকে ডাকতাম, দাদু ঠিকই আমাদের একজন একজন করে বের করে আনতেন। আসলে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা ছিল না ঠিকই কিন্তু বাবা ও মাকে দেখেছি তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে এবং দাদুও সুন্দরমতো সেই কথামতো কাজ করতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি কিছুটা সচল ছিল বলেই অবিশ্বাস্যভাবে কাছের মানুষজন চিনতে পারতেন।

কতদিন বাবাকে দাদুর সামনে বসে আবৃত্তি করতে দেখেছি। দাদুকে তখন খুব উত্তেজিত দেখাত, যেন কিছু একটা বলতে চাইছেন। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরেশোরে হচ্ছে, দাদুর বিদ্রোহী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রচনা, সে সময় তরুণসমাজকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল।

মাকে দেখেছি তাঁর খাওয়া-দাওয়া অন্যান্য প্রাত্যহিক কাজ নিয়মমাফিক করে দিতে। এই কাজগুলো দাদু নিজে সম্পন্ন করতে পারতেন না। মায়ের কাছে দাদু ছিলেন ছোট শিশুর মতো। মা যখন দাদুর চুল কেটে দিতেন তখন দাদুর মাথাটা পেছন থেকে আমি ধরতাম আমার ছোট বোন মিষ্টি ও ছোট ভাই বাপি দাদুর দুপাশে বসে দাদুর হাত দুটো ধরে থাকত যাতে মাথাটা স্থির থাকে, এভাবে চুলটা কাটতে সুবিধে হয়। বাবাকে দেখেছি দাদুর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দিতে, তখন দাদু চুপ করে লক্ষ্মী ছেলের মতো বসে থাকতেন- একটুও নড়তেন না। অনেক সময় দেখেছি মাকে দাদুর রুপালি রঙের সুন্দর চুল একটু বড় হলেই কেটে একটা সুন্দর কৌটোয় ভরে রাখতেন। আমার মনে আছে, মা যখন দাদুর নখগুলো কেটে দিতে আসতেন দাদু সুন্দর করে তাঁর হাত দুটো মায়ের সামনে মেলে ধরতেন- মা একটা ছোট নখ কাটার কাঁচি দিয়ে কুট কুট করে তাঁর নখ কেটে দিতেন।

দাদু যে এত বড় কবি তখনো তাঁকে জানার বা বোঝার মতো বয়স হয়নি। ছুটির দিনগুলোতে দেখতাম, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে লোকজন এসে দাদুর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিতেন; রজনীগন্ধার গুচ্ছ তাঁর হাতে দিয়ে ধন্য হতেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম আমি এক অসাধারণ প্রতিভার ছত্রছায়ায় জন্মগ্রহণ করেছি। আমার দাদু বিদ্রোহী কবি নজরুল। দাদুর ঘরে একটা হারমোনিয়াম রাখা থাকত। অনেক সময় দেখেছি, দাদুর ভক্তদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে গান শুনিয়ে যেতেন। দাদু গান শুনতে খুবই পছন্দ করতেন। ছোটদের জন্য লেখা খুকি ও কাঠবিড়ালী কবিতা আমার খুব প্রিয় ছিল- বাবা প্রায়ই দাদুর সামনে পড়তে বসতেন। আরো পড়তাম, ভোর হল দোর খোলো, ঝিঙে ফুল, লিচু চোর, দেখবো এবার জগৎটাকে ইত্যাদি কবিতা। কী যে আনন্দ হতো কবিতাগুলো পড়তে। সবচেয়ে খুশি হতাম যখন আমার স্কুলে পড়ার বইয়ে দাদুর লেখা কবিতাগুলো পড়ানো হতো, বুকটা গর্বে ভরে যেত।

বাড়িতে এসে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠত, দাদু কেন নির্বাক হয়ে গেলেন? তিনি যদি সুস্থ থাকতেন তাহলে আরো কত কবিতা-ছড়া লিখতেন আমাদের জন্য। বাবার কাছে শুনেছিলাম, দাদু তাঁর দুই ছেলেকে নিয়েও ছড়া লিখেছিলেন। বাবার ডাকনাম দিয়েছিলেন সানি ও চাচার নিনি, দাদুর দুই প্রিয় মানুষ সান ইয়াৎ সেন এবং লেনিনের নামানুসারে।

কতদিন বাবাকে দাদুর সামনে বসে আবৃত্তি করতে দেখেছি। দাদুকে তখন খুব উত্তেজিত দেখাত, যেন কিছু একটা বলতে চাইছেন। ১৯২১ সালে দাদু বিদ্রোহী কবিতা রচনা করেন, ১৯২২ সালে তা প্রকাশিত হয়। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরেশোরে হচ্ছে, দাদুর বিদ্রোহী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রচনা, সে সময় তরুণসমাজকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। বিদ্রোহী কবিতা শুনলে আমি নিজেকে আজো ঠিক রাখতে পারি না- সমাজের ভণ্ডামি, অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

বাবা আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে দাদুর সামনে বসে প্রায়ই তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা বলতেন। দাদু ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী, সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন, অসংখ্য সুরও সৃষ্টি করেছেন। সমাজের কোনো শ্রেণি বাদ যায়নি তাঁর গান থেকে। বাংলা গানে দাদু গজলের সফল প্রবর্তক। সমাজে যারা অবহেলিত তাদের নিয়েও তিনি গান রচনা করেছেন- শ্রমিক কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, বেদে-বেদেনীদের গান। তাঁর দেশাত্মবোধক গান, মার্চ সংগীত, সাম্প্রদায়িরক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান মানুষকে যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করেছে। বাবা বলতেন, তিনি ছিলেন সাম্যের কবি- জাতপাতকে কখনো গ্রাহ্য করেননি। সবার ওপরে মানুষকে বড় করে দেখেছেন। সমাজে পাপ-অন্যায় যেখানে, সেখানে তিনি গানে-কবিতায় প্রতিবাদ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাঁর লেখা গান-কবিতা ব্রিটিশ শাসকদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাঁর অগ্নি-বীণা কাব্য সবচেয়ে পরিচিতি লাভ করেছিল। ব্রিটিশ সরকার বিষের বাঁশি, ভাঙার গান বাজেয়াপ্ত করল। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিসংবলিত কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হলে রাজদ্রোহের অপরাধে দাদুর বিরুদ্ধে জারি করা হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ১৯২৩ সালে রাজবন্দীর জবানবন্দী রচনা করলেন। দাদুকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তারপর রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষের জুলুমের প্রতিবাদে দাদু ৩৯ দিন অনশন করেন। ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত গীতিনাট্য দাদুর নামে উৎসর্গ করলেন। অনশন ভাঙতে অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন, ‘Give up hunger strikc, our literature claims’ দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

বাবা দাদু সম্পর্কে এ কথাগুলো আমাদের যখন বলতেন, গর্বে আমাদের মনটা ভরে যেত। পরে বুঝতে পেরেছি, ভবিষ্যতে আমাদের মানসগঠন যেন সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে কাজে লাগে এবং জীবনে চলার পথে দাদুর জীবনকে পাথেয় করতে পারি, তাই বাবা স্মৃতিচারণ করে আমাদের মনকে দৃঢ় করতেন।

বাবা আবৃত্তিকার হওয়ায় অনেক অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হতো। তখনকার সব বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে বাবার বন্ধুত্বও ছিল। মনে আছে, একদিন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক রবিশংকর বাবার সঙ্গে দাদুকে দেখতে এলেন। সিআইটির ছোট ফ্ল্যাটে অনেক গুণীজন দাদুকে দেখতে চলে আসতেন। একদিন মনে পড়ে, বাবা রেডিওপ্লেয়ারে দাদুর রচনা বিদ্যাপতির রেকর্ডগুলো বাজিয়ে শুনছেন আর চোখের জল মুছছেন।

দাদু ১৯৩৯ সালে সাপুড়ে ছায়াচিত্রের কাহিনী ও গান রচনা করেন। বাবা বলেছিলেন, দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ছায়াছবির সংগীত ও অভিনয়। সাপুড়ে ছবিতে নায়কের ভ‚মিকায় অভিনয় করেছিলেন পাহাড়ী সান্যাল, আরো অভিনয় করেছিলেন তখনকার জনপ্রিয় গায়িকা ও অভিনেত্রী কাননদেবী। এই ছবিটির গানও তিনি গেয়েছিলেন- আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ- খুবই বিখ্যাত হয়েছিল। সাপুড়ে হিন্দিতেও চিত্রিত হয়েছিল সাপেড়া নামে।

এ কথাগুলো লেখার কারণ, কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে মাঝে মধ্যে সকাল বেলায় পাহাড়ী সান্যাল চলে আসতেন। আমাদের বাসাটা ছিল দোতলা, তাই তিনি যখন আসতেন নিচতলা থেকে হাঁক দিতেন ‘সানি’, ‘সানি’ বলে (বাবার ডাকনাম)। আমাকে ও আমার ছোট বোন মিষ্টিকে ডাকতেন বড় বুড়ি ও ছোট বুড়ি বলে। পাহাড়ীদাদু এলে বাবা ও আমরা সবাই খুব খুশি হতাম। এসেই দাদুর ঘরে চলে যেতেন তাঁকে দেখতে। তাঁর সঙ্গে পুরনো দিনের না-ভোলা স্মৃতির কথা শোনাতেন। পাহাড়ীদাদুকে দেখে দাদুকে কী যে খুশি হতে দেখেছি- পাহাড়ীদাদু যা বলতেন দাদু তা শুনে মাথা ঝাঁকাতেন। মনেই হতো না তিনি নির্বাক।

কলকাতার ঐ আড়াই রুমের ফ্ল্যাটে আমরা সবাই কোনোরকমে মাথা গুঁজে থাকতাম। ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে বাবা ও চাচা ঠিক করলেন, প্রতিমাসে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান করবেন। তাতে দাদুর মনটাও ভালো থাকবে, পুরনো দিনের শিল্পী- যাঁরা দাদুর কাছে সংগীতের দীক্ষা নিয়েছিলেন, সবাই এসে কলকাতার সিআইটি ফ্ল্যাটে দাদুকে গানে গানে শ্রদ্ধা জানাতেন। দাদু সেদিন কী যে খুশি হতেন, তা লিখে প্রকাশ করতে পারব না।

আঙুরবালাদেবী, ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, সুপ্রভা সরকার, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, জাস্টিস মাসুদ, ফিরোজা বেগম, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ডা. অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, ধীরেন বসু- আরো অনেক গুণী শিল্পী সেদিন বাড়িতে ভিড় করতেন, এখন সবার নাম মনে করতে পারছি না। প্রবীণ ও নবীনের মিলনমেলায় পরিণত হতো আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা।

বাবা যখন অনুষ্ঠান থেকে ফিরতেন, মনে আছে, তাঁর সঙ্গে অনেক শিল্পীই দাদুকে দেখতে চলে আসতেন। একদিন দেখলাম উত্তমকুমারের ছোট ভাই তরুণকুমার দাদুকে দেখতে এসেছেন- আশপাশের বাড়ি থেকে এসব শিল্পীকে দেখার জন্য ভিড় পড়ে যেত। তখন বাবাকেই ভিড় সামলাতে হতো। দাদুর জন্মদিনের কথা আজো ভুলতে পারি না। জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই বাড়িটা খুশিতে ঝলমল করে উঠত। দাদুর কথা তো লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি যে কী আনন্দে থাকতেন এই সময়টায়। মনে হতো তিনি বুঝতে পারতেন এটা তাঁর জন্মদিনের মাস। জন্মদিনের আগের দিন বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে যেত। ফুলে ফুলে ভরে যেত। ক্রিস্টোফার রোডের মুখে বিরাট একটা তোরণ বানানো হতো। তাতে লেখা থাকত ১১ই জ্যৈষ্ঠ বিদ্রোহী কবির জন্মজয়ন্তী ইত্যাদি। আমরা ছোটরাও উদগ্রীব হয়ে থাকতাম দাদুর জন্মদিনটির জন্য। কারণ সেদিন আমাদের ছোট ফ্ল্যাটটা বাঙালির তীর্থভ‚মি হয়ে যেত। কত যে মানুষ আসতেন- কলকাতার মানুষ তো বটেই, সেই সঙ্গে কলকাতার বাইরে থেকেও দাদুকে শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন কতশত মানুষ।

সেদিন ফুলে ফুলে দাদু ঢেকে যেতেন। কী যে অপূর্ব লাগত দাদুকে। আমাদের ছোটদের কাজ ছিল দাদুর গলার মালাগুলো আস্তে আস্তে খুলে পাশে রাখা। সেদিন গান আর গান। শিল্পীরা আসছেন, একেকজন তার গান গাইছেন, উঠে যাচ্ছেন, আরেকজন বসছেন। মানবকাকু (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) গাইছেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ আর দাদুর সেকি আনন্দ! হাসছেন আর একটা হাত দিয়ে নিজের মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। গুরু যেমন শিষ্যের গানে তৃপ্ত হয়ে হাত তুলে আশীর্বাদ করেন, দাদুকে দেখে সেদিন তাই মনে হচ্ছিল। হঠাৎ তাঁর গলার মালাটা খুলে মানবকাকুর হারমোনিয়ামের ওপর রেখে দিলেন, শত শত ভক্ত সাংবাদিক শিল্পী গায়ক- আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম। আর মানবকাকু প্রায় কেঁদে ফেললেন, বললেন- আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়া হয়ে গেল। তখন মনে হলো অসুস্থতা কবির সত্তাকে একটুও ক্লান্ত করতে পারেনি, ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করেছে মাত্র। এত ভক্ত ছবি তুলছে, গান গাইছে। পুরো জন্মদিনটা আকাশবাণী কলকাতা সরাসরি সম্প্রচার করত। সে যে কী আনন্দ, কোনোদিন ভুলতে পারব না। দাদুর জন্মদিন এলেই আমার দাদুর সঙ্গে জন্মদিনের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এখনো এই সুখকর স্মৃতি হৃদয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি।

১৯৭২ সালে কলকাতায় এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সদ্য স্বাধীন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশটি বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধে পূর্ববাংলার লাখ লাখ মানুষ কলকাতার আশপাশে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছিল। কলকাতাতেও অনেক রাজনীতিবিদ, গুণীজন আশ্রয় নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় রাজভবনে উঠেছিলেন। বাবা ও চাচাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর ইচ্ছে ১৯৭২ সালে দাদুর জন্মদিনটি স্বাধীন বাংলাদেশে পালন করবেন। স্থির হলো ১৯৭২ সালের ২৪ মে- ঠিক জন্মদিনের আগের দিনটিতে আমরা সবাই দাদুকে নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যাব। আমাদের আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেল। সব কিছু ঠিক হলো, দুই দেশের সরকারি কার্যক্রমও সমাপ্ত। বাবার কাছে শুনেছি, দাদুকে বাংলাদেশে না পাঠানোর জন্য কয়েকটি সংস্থা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু ততক্ষণে বাংলাদেশে দাদুর আসার খবর প্রচারিত হয়েছে। ঢাকার মানুষ আনন্দে উদ্বেল। রেডিও-সংবাদপত্রে বিশেষ বিমানে দাদুকে ঢাকায় নিয়ে আসার সময়সূচিও প্রচারিত হয়েছে। ফলে দাদুকে যদি ঢাকায় না দিয়ে আসা হয় তাহলে সেখানেও প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হতে পারে।

সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থশংকর রায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ দূত হিসেবে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন মুস্তফা সারওয়ার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকায় তখন বিরোধিতা সত্তে¡ও কবিকে ভারত সরকার ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি তখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতেন তাহলে দাদুকে ঢাকায় আনা সম্ভব হতো না। আমাদের পরিবার ও বাংলাদেশের জনগণ এর জন্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি চির কৃতজ্ঞ।

যা হোক, সেই প্রথম আমাদের বিদেশ সফর। এই প্রথম আমরা একটি স্বাধীন দেশে যাচ্ছি যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। যাঁর আমন্ত্রণে যাব সেই মহান নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখব। ১৯৭১ সালে তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণটা রেডিওতে শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ বিমানের প্লেনটা যখন ঢাকা এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁইছুঁই করছে তখন পরিবারের সবাই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখলাম হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছে। সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় নজরুল’। কোনো মতে দাদুকে সেই বিশাল জনতার আড়াল থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে ধানমন্ডির ‘কবিভবনের’ উদ্দেশে রওনা করিয়ে দেয়া হলো। সঙ্গে মা উমা কাজী ছিলেন। তার কিছুক্ষণ পর আমাদের পরিবারের অন্যদের আরেকটি গাড়িতে তুলে ধানমন্ডির কবিভবনে পাঠানো হয়। এয়ারপোর্ট ছেড়ে বের হতেই দেখি রাস্তার দুধারে স্কুলের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ফুলের গুচ্ছ নিয়ে আমাদের অভিবাদ জানাচ্ছে, ফুলের পাপড়ি গাড়ির ওপর ছিটিয়ে দিচ্ছে। সেদিনের এই অপূর্ব দৃশ্যের অনুভূতির কথা আজো ভুলিনি। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু দাদুসহ আমাদের পরিবারকে এ দেশে না আনতেন তাহলে আমাদের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যেত। বঙ্গবন্ধুকে এত কাছ থেকে দেখার অনুভ‚তি, সেই রোমাঞ্চ আজো অনুভব করি। ধানমন্ডির বাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। দাদু জীবনে যে রকম বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলেন, ঠিক তেমনি ছিল বাড়িটা- দোতলা, সামনে বিরাট একটা বাগান ফুলে ফুলে ভরা। দাদু প্রায়ই বাগানে হেঁটে বেড়াতেন। আজ দাদু নেই কিন্তু তাঁর মহান সৃষ্টি আমাদের জন্য রেখে গেছেন। তাঁর কবিতা ও গান আমাদের সংস্কৃতির চির সম্পদ- যত বেশি তার চর্চা হবে, ততই আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ সমৃদ্ধ হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App