স্বাস্থ্যখাতের রুগ্ণদশা কাটেনি
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২০, ১০:২৮ এএম
স্বাস্থ্য খাতে বাইরের পদক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ বেশি। এজন্য স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি না - স্বাস্থ্যমন্ত্রী
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে। একে একে গণমাধ্যমে উঠে আসে এই খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা। বেরিয়ে আসে কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের সমন্বিত অবৈধ সিন্ডিকেট। স্পষ্ট হয়ে ব্যবস্থার বেহাল চিত্র। অনিয়ম-দুর্নীতির বৃত্তে বন্দি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ের কয়েকজনের অপসারণ বা পদত্যাগের দাবি ওঠে। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে সরকার। শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। নেয়া হয় রদবদলের পদক্ষেপ। বড় ধরনের কয়েকটি পদে রদবদলও হয়। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতি দূরীকরণে আর দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে, একই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং মিডিয়া সেলের প্রধান মো. হাবিবুর রহমান খানসহ কয়েকজনকে বদলি করা হয়। পদত্যাগ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসান এবং পরিচালক (পরিকল্পনা) ডা. ইকবাল কবিরকে করা হয় ওএসডি। যদিও পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন পদে পদায়ন করা হয়েছে। পরিচালক প্রশাসনকে বদলি করা হয় স্বাস্থ্যের বিভাগীয় অফিসে। কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদ উল্লাহসহ বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হয়। অধিদপ্তরের আওতায় নতুন কয়েকটি পদে নিয়োগ নিয়ে ভেতরে ভেতরে রয়েছে চাপ ও অসন্তোষ। নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের পর কয়েক ডজন কর্মকর্তাকে দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পদায়ন, বদলি ও সংযুক্ত করা হয়। তবে অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে এর অধিকাংশই ছিল রুটিনমাফিক কাজ। গত ২২ জুলাই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, যে শাখাগুলো বেশি সমালোচিত হয়েছে সেগুলো ভালোভাবে খতিয়ে দেখে সরকার শক্ত ব্যবস্থা নেবে।
স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অসঙ্গতি দূর করতে বিশেষজ্ঞরা বরাবরই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজনের পরামর্শ দিচ্ছেন। করোনাকালে তা আরো জোরালো হয়। একই সঙ্গে চিকিৎসক ও আমলাদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা দূর করারও পরামর্শ দেন। তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে নতুন পদায়নের পর কাজে খুব বেশি গতি আসেনি। বরং করোনাকালের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না স্বাস্থ্য খাত। তাই বদলি-পদায়ন করে স্বাস্থ্য খাতের সংকট দূর করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বরং তাকে পাস কাটিয়েই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি হয়। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে মন্ত্রীর অমত থাকা সত্ত্বেও তা গৃহীত হয়েছে। আর এসব কারণেই এই খাতের বেহাল অবস্থা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও একাধিকবার নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কমিটির প্রধান হলেও অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাকে না জানিয়েই। গত ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে ‘বাইরের পদক্ষেপ ও হস্তক্ষেপ বেশি। এজন্য স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি না।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক অব্যবস্থাপনার জন্য শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নয়। স্বাস্থ্য খাতের টপ টু বটম পর্যায়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। দুয়েকটি পদে পরিবর্তন করে এই বিষবৃক্ষ নিধন সম্ভব নয়। স্ট্রাকচারাল পরিবর্তন না করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। এই খাতের বিভিন্ন পদে এমন অনেকে আছেন যারা ৮-১০ বছর ধরে কাজ করছেন। যারা এই খাতের খুঁটিনাটি সব জানেন। এমন সব লোকই দুর্নীতির ক্ষেত্রে সহায়ক। এছাড়া স্বাস্থ্যের ‘স’ বুঝেন না এমন কিছু অযোগ্য লোক এই খাতের উচ্চপর্যায়ে আসীন আছেন। এমন অযোগ্য লোক দিয়ে ডুবে যাওয়া স্বাস্থ্য খাতকে ভাসানো সম্ভব নয়। এছাড়া নিয়মনীতির তোয়াক্কা না অনভিজ্ঞদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ননটেকনিক্যাল লোক দিয়ে টেকনিক্যাল কাজ করানো হলে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সেলান ভোরের কাগজকে বলেন, রদবদলে স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা বেড়েছে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তি, ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ, অ্যান্টিবডি অ্যান্টিজেন টেস্টের অবস্থার উন্নতি হয়নি। সেই সঙ্গে কোভিডের অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগও কার্যকর হচ্ছে নয়।
মেডিকেল অ্যানথ্রোপলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস ভোরের কাগজকে বলেন, কেবল রদবদলে সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু অধিদপ্তর নয়, পুরো মন্ত্রণালয়কে দায়বদ্ধতার জায়গায় আনলে আনতে হবে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক পরিচালক ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের রদবদলের পর কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যেগুলো মন্ত্রীকে টপকে নেয়া হয়েছে। যেমন করোনা হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীদের আবাসন সুবিধা বাতিলের বিপক্ষে ছিলেন তিনি। স্বাস্থ্য খাতের বড় ধরনের নয়-ছয় হয় কেনাকাটায়। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়। কেনাকাটা সম্পর্কিত একটি কমিটি আছে। কিন্তু এই কমিটির অনেকেরই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। কেনাকাটা কমিটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিনিধি রাখার পরামর্শ দেন তিনি।