×

জাতীয়

দেশে ফেরাতে উদ্যোগ আগ্রহ কোনোটাই নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

প্রত্যাবাসনে নিরুৎসাহিত করে এনজিও

নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন আর দেশে ফিরতে চায় না। খেয়ে পড়ে ভালো আছেন এমন ভাবনা থেকে কারো নিজ দেশে ফেরার আগ্রহ নেই বললেই চলে। তবে যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘আল-ইয়াকিন’ নামে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপসহ একাধিক রোহিঙ্গা সংগঠন ও এনজিও। এর মধ্যে সরকারিভাবে ২ দফায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ২ দফার উদ্যোগই ভেস্তে গেছে। একজন রোহিঙ্গাকেও তার দেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। ইউএনএইচসিআর ও আইএমও প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করলেও কবে রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে এ নিয়ে তাদের কাছে কোনো সদুত্তর নেই।

এদিকে আটকে পড়া রোহিঙ্গা মাঝিদের (দলনেতা) মধ্যে অনেকের দাবি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর ‘জেনোসাইড’ বা রীতিমতো ‘ক্রাইম অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ (মানবতাবিরোধী অপরাধ) সংঘটিত হয়েছে। তাদের দেশে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সবার আগে মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন প্রয়োজন। এটি সংশোধন করেও বদলানো যেতে পারে বা নতুন আইনও করা যেতে পারে। যত দিন না সংশোধন হচ্ছে ততদিন সেখানে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসবে। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে গেছে। ওই আইন পরিবর্তন করা হলে রোহিঙ্গারা স্বস্তিবোধ করবে। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ২ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে

গত বছরের ২৫ আগস্ট সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কুতুপালং ক্যাম্পের বর্ধিত-৪ নম্বর ব্লকে বিশাল ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয় এআরএসপিএইচ, ভয়েস অব রোহিঙ্গা এবং রোহিঙ্গা রিফিউজি কাউন্সিলের (আরআরসি) উদ্যোগে। এ ব্যাপারে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) নেতা মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জের (সিআইসি) কাছে লিখিত আবেদন জানায়। কিন্তু অনুমতি ছাড়াই সেদিন তারা সমাবেশ করে দেশে না ফেরার কথা জানায়। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর সঙ্গে এনজিওগুলো জোট বেঁধে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে জাতিসংঘের উদ্যোগে নিজ দেশে ফেরার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আতকে ওঠেন কুতুপালং ও বালুখালীর রোহিঙ্গারা। তারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, রোহিঙ্গাদের ভেতরে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ‘আল-ইয়াকিন গ্রুপে’র লোকজন সবকটি ক্যাম্পে এ নিয়ে তৎপর রয়েছে। দেশে ফিরে যেতে কেউ আগ্রহী হলেই তার ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। প্রতিটি ক্যাম্পে তাদের তৎপরতার কারণে কেউ আর দেশে ফেরার কথা বলতে সাহস করেন না।

অন্যদিকে উখিয়ার বালুখালী, কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া এলাকার রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তাদের ৫টি শর্ত না মানলে তারা কিছুতেই মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এই ৫ শর্ত হচ্ছেÑ ১. তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে; ২. নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৩. তাদের জমিজমা ফেরত দিতে হবে; ৪. নিজেদের গ্রামে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং ৫. অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

উল্লেখ্য, গতবছরের ২২ আগস্ট ও তার আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য দিন ধার্য হলেও সুফল মেলেনি। কোনো রোহিঙ্গা যেমন নিজ দেশে ফিরতে সম্মত হয়নি তেমনিভাবে সরকারও কাউকে জোর পাঠানোর উদ্যোগ নেয়নি। তখন ৬১টি এনজিও এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে বলেছে, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনবিষয়ক খবরে শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। এনজিওগুলো মিয়ানমারে পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা ব্যক্ত করে নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিতের আহ্বান জানায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন অভিযোগ করেন, এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন চালিয়েছে বহুবার। এরমধ্যে ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬-১৭ এবং বিশেষত ২০১৭-১৮ সালে। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধদের হামলার পর মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা। ২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সামরিক নির্যাতনের আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ থেকে ১৩ লাখ। ২০১৫ সালের পরবর্তী সময়ে কমপক্ষে ৯ লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে শুধু বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। আরো পাশের মুসলিম দেশগুলোতেও পালিয়ে গেছে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা। এরমধ্যে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু কির অনুরোধে কফি আনান ফাউন্ডেশন ও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের কার্যালয় রাখাইন স্টেট সম্পর্কিত একটি অ্যাডভাইজরি কমিশন গঠন করে। এর বেশির ভাগ সদস্যই ছিলেন মিয়ানমার থেকে। এই কমিশনকে ম্যান্ডেট দেয়া হয় রাখাইন রাজ্যের জটিল চ্যালেঞ্জগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার এবং সেই সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সম্ভাব্য উপায় উদ্ভাবনের।

কফি আনান কমিশনের ফাইনাল রিপোর্টে যে সুপারিশ করা হয়, তাতে মিয়ানমারের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার প্রতি জোর দেয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়। সেই সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নেয়াকে সেখানকার একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এর একটি সমাধানের সুপারিশ করা হয়। তখন রিফিউজি ইন্টারন্যাশনাল (আইআই) কফি আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও এর সুপারিশমালাকে স্বাগত জানায়। আইআই তখন মিয়ানমার সরকারের প্রতি এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়। কিন্তু কার্যত সবকিছু আটকে আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App