×

মুক্তচিন্তা

শুধু সাহায্য নয়, সমাধান জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২০, ০৮:৪৩ পিএম

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য শুরু থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু মিয়ানমার বরাবরের মতোই ‘কথা দিয়ে কথা না রাখার বদ খাসলত’ থেকে একটুও সরে আসেনি। ফলে বাংলাদেশের হাজার চেষ্টা, সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতা থাকলেও মিয়ানমারের অনিচ্ছা, অনাগ্রহ এবং নানা ছল-ছুতোয় কালক্ষেপণের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, মেমোরি এবং ন্যারেটিভসে একটি বিশেষ দিন হিসেবে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কেননা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন, নির্মম অত্যাচার, অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞ, নির্বিচার ধর্ষণ এবং জঘন্য জেনোসাইড থেকে বাঁচতে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে এ প্রবেশ অব্যাহত থাকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর পর্যন্ত। এমনকি ২০১৭ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। কেবল ২০১৭ সালেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেছে, তা নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গাদের বড় ঢল বাংলাদেশে প্রবেশ করে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকেই পূর্ববাংলার এ সীমান্ত অঞ্চলের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অল্প বিস্তার যাতায়াত সবসময় ছিল। তবে সেটা ঠিক শরণার্থী হিসেবে নয়। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল সংলগ্ন উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলায় আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের প্রথম বড় ঢল নামে ১৯৭৮ সালে যখন মিয়ানমারের মিলিটারি ‘অপারেশান ড্রাগন কিং’ নাম দিয়ে উত্তর রাখাইনে বসবাসরত সিভিলিয়ান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্বিচার অত্যাচার এবং হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে।

এরপর রোহিঙ্গাদের বড় ঢল আসে ১৯৯১-৯২ সালে যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘অপারেশন ক্লিন এন্ড বিউটিফুল নেশান’ শিরোনামে রোহিঙ্গা বিতাড়নের জন্য নতুন অপারেশন শুরু করে তখন বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে প্রবেশ করেছিল প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে একটা ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু এসব ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গা বিভিন্নভাবে অবৈধপথে পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা। ২০১৬ প্রবেশ করে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। আর সর্বশেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৩ লাখ, কারো কারো মতে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাস করে। সুতরাং আমরা যখন রোহিঙ্গা ঢলের তিন বছর বলছি, তার অর্থ এ নয় যে, তিন বছর আগে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামেনি। কিন্তু ব্যাপকতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা এবং মানবিক বিপর্যয়ের বিবেচনায় ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢল আগের সব ঢলগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে। একইভাবে রোহিঙ্গাদের কাছে ২০১৭ সালের নির্যাতনের মাত্রা, তীব্রতা, ভয়াবহতা এবং নিষ্ঠুরতা আগের সব নিষ্ঠুরতার ইতিহাসকে অসহায় করে দিয়েছে। তাই ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ রোহিঙ্গারা ‘জেনোসাইড রিমেম্ব্রারেন্স ডে’ হিসেবে পালন করে কেননা এ অভিজ্ঞতা অমোচনীয় এবং কোনোভাবেই ভোলার নয়। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কী?

বিগত তিন বছরে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বাড়তি চাপ পড়েছে স্থানীয় প্রতিবেশের ওপর, শ্রমবাজারের ওপর, অর্থনীতির ওপর, সমাজব্যবস্থার ওপর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর এবং ভৌত অবকাঠামোর ওপর। ফলে উখিয়া এবং টেকনাফের স্থানীয় জনগণের মধ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী একটা মনোভাব ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠছে, যার ফলে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটেছে। পরিস্থিতি এখনো ততটা সংঘাতময় হয়ে ওঠেনি, তবে বিরূপ মনোভাব যে ক্রমবর্ধমান সেটা অনস্বীকার্য। শুধু স্থানীয় জনগণ বা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিতেই প্রভাব পড়ছে না, এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের প্রশাসনিক সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি ক্যাম্পে নিয়োজিত আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থার বিভিন্নমুখী সাহায্য-সহযোগিতার পরও জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে প্রায় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীয় দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিগত তিন বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটা চাপ তো পড়ছেই কেননা এগুলো এ দেশের জনগণের করের টাকা।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য শুরু থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু মিয়ানমার বরাবরের মতোই ‘কথা দিয়ে কথা না রাখার বদ খাসলত’ থেকে একটুও সরে আসেনি। ফলে বাংলাদেশের হাজার চেষ্টা, সদিচ্ছা এবং আন্তরিকতা থাকলেও মিয়ানমারের অনিচ্ছা, অনাগ্রহ এবং নানা ছল-ছুতোয় কালক্ষেপণের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে একটা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি হয়, যার সূত্র ধরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার দিন থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করার কথা। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ এবং ২০১৯ সালের আগস্টের ২২ তারিখ দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং দুই দফা প্রত্যাবাসন উদ্যোগই ব্যর্থ হয় কারণ রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে যেতে রাজি হয়নি। এজন্য অবশ্যই রোহিঙ্গাদের দায়ী করা যাবে না। কেননা যে নিরাপত্তাহীনতার কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জান নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, সে রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি এখনো পর্যন্ত হয়নি। তাছাড়া সেখানে এখনো যেসব রোহিঙ্গা বাস করে, তারা নিজেরাই চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। সে অবস্থায় বাংলাদেশের রোহিঙ্গারা কোন প্রতিশ্রুতি এবং কোন আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে মিয়ানমারে ফিরে যাবে? মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো ধরনের আস্থা, বিশ্বাস, এবং নির্ভরতার জায়গা কী তৈরি করতে পেরেছে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে মিয়ানমারে ফিরে যাবে? সুতরাং এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের হাতে। বাংলাদেশ হাজার চেষ্টা করলেও মিয়ানমার যদি না চায়, রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সন্তোষজনক সমাধান করা বাংলাদেশের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। এখানে এসেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায় ও দায়িত্বের প্রশ্ন বড় করে আসে।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, কোনো জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় নির্যাতন থেকে বাঁচতে জানের মায়ায় একদেশ থেকে অন্যদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন সে শরণার্থীদের দেখাশোনা করা, দেখভাল করা, ভরণপোষণ করা এবং শরণার্থী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কেবল আশ্রয়প্রদানকারী দেশের একার নয়। এ দায়দায়িত্ব নিতে হয় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় এটাকে বলা হয়, ‘বার্ডেন-শেয়ারিং’। কিন্তু হাব-ভাব দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের বেলায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দায়দায়িত্ব যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খুব একটা নেই! আন্তর্জাতিক ন্যায়-বিচার আদালতে জেনোসাইড সংঘটনের অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের বিচার হচ্ছে কিন্তু কবে এর রায় হবে এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কী রায় দেবে, তা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের রোহিঙ্গা সমস্যা-সমাধানে আদৌ কোনো কাজে আসবে কিনা তা নিয়ে আমি গুরুতর সন্দিহান।

তবে এটা স্বীকার্য যে, ২০১৭ সালের পর থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিত্যদিনের চাহিদা পূরণে (অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির ব্যবসা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা) জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে। অন্যথায় এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণ-পোষণ করা বাংলাদেশের জন্য কষ্টকর হয়ে যেত। এখনো সে সাহায্য-সহযোগিতা যাতে অব্যাহত থাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ সাহায্যের প্রবাহ যাতে অব্যাহত থাকে তার জন্য জোর আবেদন করেছেন। কিন্তু আমি মনে করি, সাহায্যের প্রয়োজন আছে বটে, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভ‚মিকা রাখার জন্য সামনে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক সাহায্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বরঞ্চ শরণার্থী অবস্থা টিকে থাকবে। তাই বাংলাদেশের এখন শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সাহায্যের চেয়ে শরণার্থী সমস্যার সমাধান অনেক বেশি জরুরি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এখন এগিয়ে এসে সক্রিয় ভ‚মিকা নিতে হবে এবং মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায়, সাগ্রহে, নিরাপদে এবং ইজ্জতের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যায়। রোহিঙ্গারাও সেটা চায়। বাংলাদেশও সেটা চায়। বাংলাদেশের মানুষও সেটা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটা চায়। কেবল মিয়ানমার হচ্ছে বেয়াড়া। এ বেয়াড়াকে লাইনে আনার দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। তাই এখন সাহায্যের চেয়ে সমাধান অধিকতর জরুরি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App