×

মুক্তচিন্তা

কবে যাবে করোনা : নিষ্পত্তিহীন প্রশ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২০, ০৮:৩৯ পিএম

করোনা নিয়ে বিদেশিদের বুঝজ্ঞান আরো ভিন্ন মাত্রার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ-বিসিজির পূর্বাভাস বলছে, শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না বিশ্ব। করোনার ক্ষয়ক্ষতির এই বীভৎস চমকের শেষ কোথায়, সেটাও কেউ বলতে পারছে না।

উৎপত্তি, আগমন, বিস্তারের চেয়ে এখন কথামালা বেশি করোনার বিদায় নিয়ে। করোনা কোত্থেকে, কীভাবে এলো, বিস্তার ঘটল, কী এর চিকিৎসা?- এসব নিয়ে প্রায় সব কথাই মাঠে মারা গেছে। কোনো ফয়সালা আসেনি। ততক্ষণে মাড়িয়ে-বাঁচিয়ে করোনা তার কাজ করেই যাচ্ছে। প্রকৃত সুখবর কোথাও নেই। তবে বাংলাদেশে স্বপ্নের সুখবর দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। বলেছেন, টিকা আসুক বা না আসুক করোনা বাংলাদেশ থেকে এমনি এমনিতেই বিদায় নেবে।

করোনায় মৃত্যু এবং আক্রান্ত কমে গেছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি এ স্বপ্নের জানান দিয়েছেন। বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভালো বলেই হাসপাতালে ৭০ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে, এমনটা দাবি করে মন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে ৪,০০০-৫,০০০ চিকিৎসক টেলি-মেডিসিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষ বাড়ি থেকে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পাওয়ার কারণে হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড খালি পড়ে আছে। এটা সরকারের সাফল্য। এ নিয়ে অনেকে নানা কথা বলছেন, কেউ কেউ হাসাহাসিও করছেন। যার যা ইচ্ছা করুক। মন্ত্রীদের কথা কখনো নিরর্থক হয় না। মন্ত্রীরা বোকা নন। বোকারাও মন্ত্রী হতে পারেন না। তাদের কথার আগে-পিছে বা মাঝে বোঝার আরো অনেক কিছু থেকে যায়।

কেবল বাংলাদেশের মন্ত্রী কেন? বিশ্বের দেশে দেশেও করোনা নিয়ে এ ধরনের কথা কম হচ্ছে না। করোনা চলে যাবে বলে আশা জাগানিয়া কথাবার্তা রয়েছে আরো অনেক দেশেই। তা কবে? সেই ডেটলাইন দিচ্ছেন না কেউই। বিশ্বের বড় বড় গবেষক-বিজ্ঞানী লাখো প্রশ্নের এই এক প্রশ্নের ক‚লকিনারা না পেলেও জাহিদ মালেক তা পেয়েছেন। ভাব এবং ভঙ্গিতে তিনি বুঝিয়েছেন যথা শিগগির। কিসের ভিত্তিতে, কোন তথ্যে, কোন যুক্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ স্বপ্ন দেখলেন বা দেখালেন তা বলেননি। অবশ্য কেউ জানতেও চাননি? প্রশ্ন ছোড়েননি। হতে পারে তার এ ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই গরজ হয়নি কারো। চীনে করোনার হানার পর বাংলাদেশেও আসতে পারে বলে শঙ্কার সময়ও তিনি এ ধাঁচের কিছু বুঝ দিয়েছিলেন। শুরুতে বলেছেন, গুজব-অপপ্রচার। ২৮ জানুয়ারিতে বলেছিলেন, করোনা বাংলাদেশে আসবে না। ৩০ জুনে এসে বলেছেন, ভেন্টিলেটর দরকার নেই। ভেন্টিলেটরে যাওয়া প্রায় সবাই মারা গেছেন। ১৩ আগস্টে বলেছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে গেছে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন প্রচার বন্ধ। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে এসে জানালেন- ভ্যাকসিন লাগবে না, করোনা এমনিতেই চলে যাবে।

বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়া ভয়ানক এ মহামারির এমনি এমনি চলে যাওয়ার কথা শুনে অবুঝ হয়ে গেছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমন একটা সময়ে এসে স্বপ্নটা জানান দিলেন যখন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সমাধান অন্যান্য সাধারণ মৌসুমি ভাইরাসের মতো সহজ নয়। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, সামনের শীতে ভাইরাসটি দ্বিতীয় ধাপে ও ভয়াবহ আঘাত হানতে পারে। দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘দেশ থেকে আপনাআপনি করোনার চলে যাওয়া নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য তার কাছে নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলেছেন ‘বিভ্রান্তিকর’।

করোনা নিয়ে বিদেশিদের বুঝজ্ঞান আরো ভিন্ন মাত্রার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ-বিসিজির পূর্বাভাস বলছে, শিগগিরই এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না বিশ্ব। এ ভাইরাস কোনো না কোনো আদলে আজীবন থাকতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারের জরুরি পরিস্থিতিতে বৈজ্ঞানিক পরামর্শ কমিটির একজন সদস্য। স্যার মার্ক ওয়ালপোর্ট বলেছেন, এমন ক্ষেত্রে নিয়মিত বিরতিতে মানুষজনের টিকা নেয়ার দরকার হতে পারে। তার এই মন্তব্যের একদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান আধানম তেদ্রোস জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাস দুই বছরের মধ্যে বিদায় নেবে। তবে তথ্য নয়। এটি তার আশাবাদ। এই আশাবাদের বিপরীতে বলেছেন, ঘন জনবসতি আর ভ্রমণের কারণে ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে হবে উল্লেখ করে বলেছেন, করোনা স্মল পক্সের মতো কোনো রোগ নয় যে, টিকা দিলেই সেটা চলে যাবে।

এর আগে তেদ্রোস করোনা ভাইরাসকে তুলনা করেছিলেন ১৯১৮ সালের ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গে। তার তুলনা বাস্তবে খাটছে না। কারণ সেই ফ্লুতে বিশ্বে অন্তত পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। করোনায় এরই মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ৯ লাখ ছুঁই ছুঁই। আর উপসর্গে মৃত্যু যোগ করলে সংখ্যাটি ১২ লাখের কম হবে না। আক্রান্ত আড়াই কোটি প্রায়। পরীক্ষা করা হয়নি বা লক্ষণ দেখা যায়নি, এমন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। সম্প্রতি ইউরোপিয়ান দেশগুলোয় আবারো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে। যেমন দেশ করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফল বলে মনে করা হয়েছিল, সেসব দেশেও নতুন করে রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এ আলামত সামনে বিপর্যয় কমার বার্তা দিচ্ছে না। বরং প্রতিদিনই তা বেড়ে চলেছে। এরপরও করোনা থেকে কবে মুক্তি মিলবে- এ প্রশ্ন তাড়া করছে মানুষ মাত্রই।

নিশ্চিত করে বলা যায় করোনা গোটা দুনিয়া শেষ করে দিতে পারবে না। দেশ বা দুনিয়ার সব মানুষকে নিয়েও যেতে পারবে না। বরং তাকেই যেতে হবে। কিন্তু সেটা কবে? করোনার ক্ষয়ক্ষতির এই বীভৎস চমকের শেষ কোথায়, সেটাও কেউ বলতে পারছে না। প্রথমদিকে কারো মনে হয়নি চীন এত দ্রুত ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এও মনে হয়নি, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বিপর্যয় এত ব্যাপক হবে। তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ওই সব অঞ্চল। অথচ সেখানেই অস্তিত্বের সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর মতো কথামালা শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত দেশেও। একেবারে শুরুতে মনে করা হয়েছিল, এই ভাইরাসটি সামুদ্রিক খাবার থেকে ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক প্রাণী থেকে মানবদেহে ছড়াচ্ছে এই ভাইরাস। তথ্য পরিষ্কার করতে না পেরে গবেষকরা বলছেন, এটি একেবারে অন্য রকম বৈশিষ্ট্যের আলাদা ভাইরাস। উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু কী সেই উপযুক্ত ব্যবস্থাটি? এ জিজ্ঞাসার জবাব একেক রকম। হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া থেকে শুরু করে গোমূত্র পান, কালিজিরা চিবিয়ে খাওয়া পর্যন্ত কত উপযুক্ত পদ্ধতি চলছে দেশে-বিদেশে।

অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানোর পরিণতিতে বর্তমানে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর একক আর কোনো উপায় নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসটি সম্পর্কে অভিন্ন তথ্যও আসেনি। তবে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আধুনিক-অনাধুনিক সব মহল থেকে যে অভিন্ন কথাটি আসছে সেটি হলো- করোনা নতুন রোগ আবার এমনো নয়, এটা কোনো মৌসুমি রোগ, দিন কতক পরেই চলে যাবে একবার যখন এসেছে, হয়তো থেকেই যাবে হয়তো একে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও খুঁজে পাবে তবে, শিগগিরই চলে যাবে সেটি মনে করছে না। এইচআইভি, সার্স, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু- এসব ভাইরাসের মতো এটিও থেকে যেতে পারে, সেই শঙ্কা অনেকের। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়েছেন, এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বড়জোর ৩ শতাংশের মতো মানুষ মারা যায়, এমন তথ্যে কিছু দিন একটা ভরসা পেলেও মৃত্যুর লক্ষণে সেটা কেটে গিয়ে আতঙ্কই মুখ্য হয়ে উঠছে। কেউ কি জানে আক্রান্ত হলে তার অবস্থান কোথায় হবে? ওই ৩ শতাংশের মধ্যে না বাইরে?

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App