×

মুক্তচিন্তা

ভ্যাকসিন বাণিজ্য রাজনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০, ১০:১৮ পিএম

এখন ভ্যাকসিন বাণিজ্য ক‚টনীতি নিয়ে যা শুরু হতে যাচ্ছে তার পরিণতি আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য মোটেও সুখকর হওয়ার নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উচিত হবে নিজস্ব সক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়া। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি সত্যি সত্যি এই ক‚টনীতিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। আমার বিশ্বাস বর্তমান নেতৃত্ব হয়তো বিচক্ষণতার সঙ্গেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশে এক ঝটিকা সফরে এসে গেছেন। তার আগমন উপলক্ষে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশ উত্তপ্ত ছিল। তার আগমনটি কেন আগে থেকেই জানানো ছিল না, কেন তিনি আকস্মিকভাবে ঢাকায় এলেন, মোদির কী বার্তা বয়ে আনলেন ইত্যাদি প্রশ্ন গণমাধ্যমে সরব ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব, মন্ত্রী এবং স্বয়ং শ্রিংলাও সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের তোপের মুখে ছিলেন। সবচাইতে সরব হয়ে উঠেছিল বিএনপি। ভারতের প্রসঙ্গ এলেই বিএনপি সরব হওয়ার ইস্যু খুঁজে পায়। এবারো শ্রিংলার আগমন নিয়ে বিএনপি প্রাণখুলে কথা বলেছে। শ্রিংলা ঢাকায় সচিব, মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও হোটেল লাউঞ্জে নাগরিক সমাজের অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছেন। সবশেষ তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে যা জানালেন তাতে বুঝা গেল করোনা পরিস্থিতির কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ ভারতেরও অনেক দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়নি। করোনা কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত নয়, তবে অর্থনৈতিক ও ক‚টনৈতিক নানান সম্পর্ক দুদেশের বন্ধ রাখা দুদেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

সে কারণে করোনাকালে ভ্যাকসিন নিয়ে পৃথিবীতে এখন বড় বড় দেশে যে ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে তাতে সব দেশেই দ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। ভারত যেহেতু যৌথভাবে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে তাই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সুবিধা দেয়ার জন্য ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়ে গেছে। বাংলাদেশ অবশ্য বলছে যে, চীন, রাশিয়া, অক্সফোর্ড, আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব দেশের ভ্যাকসিনের প্রতি দৃষ্টি রাখছে, যেটি বাংলাদেশের জন্য সুবিধা ও লাভজনক হবে সেটি বাংলাদেশ পাওয়ার চেষ্টা করবে। বুঝা যাচ্ছে পৃথিবীতে এখন ভ্যাকসিন বাণিজ্যের ক‚টনীতি বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। সেটি খুবই স্বাভাবিক। কারণ যে দেশ সবার আগে ভ্যাকসিন নিয়ে মাঠে আসতে পারবে সে দেশ বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবে। এখানে শত শত মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয় জড়িয়ে আছে। বৈশ্বিক এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কতটা বেকায়দায় আছে সেটি সবাই অবহিত। করোনার কারণে প্রায় সব দেশের অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, সমাজ মানুষের চলাচল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সবই এখন বন্ধ হয়ে আছে। সেই অবস্থায় ভ্যাকসিন ছাড়া করোনা থেকে মুক্তি কেউ আশা করতে পারছে না। সে কারণে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে পৃথিবীর উন্নত সব দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রথমদিন থেকেই সচেষ্ট আছে। এমনকি বাংলাদেশের একটি ওষুধ কোম্পানিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে। কোম্পানিটি এখনো এর ট্রায়াল শেষ করতে পারেনি বলে পিছিয়ে আছে।

ভারতেও একাধিক প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বলে গণমাধ্যমে খবরে প্রকাশ। রাশিয়া এরই মধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করার কথা বলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও অন্তত দুটি ভ্যাকসিন আর ২/৩ মাসের মধ্যে বাজারে আসবে বলে দাবি করা হচ্ছে। চীন দুটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে বলে সবাই শুনেছে। চীনও চাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের একটি ভ্যাকসিন ট্রায়াল দিয়ে দেখুক। এভাবেই এখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের এই পর্বে পৃথিবীর উন্নত শক্তিশালী দেশগুলো ভ্যাকসিন বাণিজ্যে মাঠে নেমে পড়েছে। এই বাণিজ্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে। করোনায় অনেক দেশেই যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, ভ্যাকসিন বাণিজ্যের মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা কে না করবে। সেই চেষ্টাতেই নানা দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। পর্দার অন্তরালে অনেক চাপও হয়তো হচ্ছে- যা আমরা খোলা চোখে দেখি না, শুনিও না। তবে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে করোনা-উত্তর পৃথিবীর ক‚টনৈতিক সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন চীনা কোনো ভ্যাকসিন গ্রহণ না করে আমরা যদি ভারতে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ক্রয় করি তাহলে চীন বিষয়টা কতটা সহজে নিবে সেটি বুঝতে মনে হয় কূটনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। আবার চীনের ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত কতটা মনে মনে নাখোশ হবে সেটিও একটি প্রশ্ন। এ ধরনের বহু সংকট করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য তৈরি হতে পারে। না হলেই আমরা খুশি হতাম, অন্তত মুখে মুখে তো সবাই সুসম্পর্কের কথা বলছে। কিন্তু বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষিত না হলে উক্তিটিতে কতটা প্রভাব পড়ে সেইটা না বুঝার কোনো বিষয় নয়। যতই দিন এগুচ্ছে ততই করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংকট যেন ক‚টনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে, ভ্যাকসিন ইস্যুটি জোরদার হয়ে উঠছে। এটি আরো তীব্রতর হতে পারে। তখন দেখা যাবে আমাদের মতো দেশগুলো বড় বড় দেশের কূটনৈতিক শিকারে পরিণত হতে পারে।

আমাদের যেমন এখন দক্ষিণ-পূর্বদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু জটিল হয়ে আছে, এর সঙ্গে মিয়ানমার আবার মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক। সুতরাং ক‚টনৈতিক কোনদিক থেকে কোন দেশ কীভাবে কখন দেবে তা বুঝা মুশকিল। হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অবশ্য ঢাকা সফর শেষে কলকাতা হয়ে মিয়ানমার ছুটেছেন। তাতে বুঝা যায় মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কিছু একটা করতে চায়Ñ এমনকি বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে চীন ভারত সম্পর্কও খুবই জটিল। মিয়ানমার শ্যাম রাখি না কুল রাখি তা কতটা স্পষ্ট করবে সেটা আমরা জানি না। তবে চীনা ভ্যাকসিন সহজলভ্য হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টিকে সহজভাবে নাও নিতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসহ আরো অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার অসন্তুষ্টির পাশাপাশি মান নিয়েও নানা ধরনের প্রচারণা চলছে। তারপরও ২০টির অধিক দেশ রাশিয়ার ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এখনো মুখ খুলছে না। খোলাটি বাংলাদেশের জন্য সহজ ব্যাপারও নয়। সে কারণেই কিনা জানি না, আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলে বসলেন যে, আমাদের হয়তো ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই উক্তি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ ঝালটক বুলি শুনতে হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। তবে বাংলাদেশের ভ্যাকসিনটি যদি সত্যি সত্যি সফল বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বোধহয় আমাদের ভ্যাকসিন ক‚টনৈতিক সংকটে পড়তে হবে না।

আমরা জানি না বাংলাদেশের কোম্পানিটি একবার সরব হয়ে এখন নীরব কেন। তারা তো আশার বাণী শুনিয়েছিল। আমরা প্রয়োজন হলে ২/১ মাস দেরি হলেও দেশীয় ভ্যাকসিন নিতে অপেক্ষা করতে রাজি আছি। তবুও ভ্যাকসিন বাণিজ্যিক ক‚টনীতি বেড়াজালে জড়িয়ে পড়তে চাই না। কারণ করোনা-উত্তর পৃথিবী কতটা মানবিক থাকবে, কতটা ছোবল আনবে সেটি এখনো পরিষ্কার না হলেও বড় বড় দেশের মধ্যে এখনি যেসব উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে, একে অপরকে ‘সাইজ’ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে বুঝা যাচ্ছে মানবতা এখন ওইসব দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুবা এবার যে করোনার সংকট বিশ্বব্যাপী আট মাস ধরে চলে আসছে তাতে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যদি মানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে কাছাকাছি আসত তাহলে বিশ্বের অনুন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেকভাবেই করোনা সংকট মোকাবিলায় নানাভাবে সহযোগিতা করত। বিশ্বের সম্মুখে এখন করোনা সংকট নিরসন জরুরি বিষয়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক, ক‚টনৈতিকসহ পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধ হয়ে থাকায় বেশিরভাগ রাষ্ট্রই দীর্ঘমেয়াদি নানা সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এই অবস্থার মোকাবিলায় বিশ্ব নেতারা মানবিক মূল্যবোধে এগিয়ে এলে মানবতার অস্তিত্ব নিয়ে সংকটের কোনো কারণ থাকত না। কিন্তু এখন ভ্যাকসিন বাণিজ্য ক‚টনীতি নিয়ে যা শুরু হতে যাচ্ছে তার পরিণতি আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য মোটেও সুখকর হওয়ার নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উচিত হবে নিজস্ব সক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়া। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি সত্যি সত্যি এই ক‚টনীতিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। আমার বিশ্বাস বর্তমান নেতৃত্ব হয়তো বিচক্ষণতার সঙ্গেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App