পুলিশ ও কারাগারবিহীন রাষ্ট্র হয়?
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০, ১০:১০ পিএম
ফাইল ছবি
কথায় পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও, বাইরের দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কার্যত পুলিশ ও জনগণ পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে থাকে। বিশেষ করে যখন সমাজে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয় ও মানুষ প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামে। প্রতিবাদকারীদের ঠেঙানোই যেন পুলিশের বড় কাজ আর এই ধারণাই বহু মানুষকে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামিয়েছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন মূলগতভাবে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ।
পুলিশের হাতে বিচারবহিভূর্ত হত্যা প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি মেজর সিনহা রাশেদ খানের মৃত্যুর পর নড়েচড়ে উঠেছেন অনেকে, বেরিয়ে আসছে কিছু সত্য। অতীতে অনেক কিছু ধামাচাপা পড়লেও এই নৃশংস হত্যার ঘটনা চেপে রাখা যায়নি। সমাজে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। যে কোনো ঘটনার বাবা-মা, ভাইবোন ও আত্মীয়-স্বজন থাকে। যে কোনো ঘটনা এক বিরাট ঘটনা- পরিবারের সদস্য। একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি সমপর্যায়ের ঘটনা রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত। ঘটনাসমূহের একটা প্যাটার্ন বা নকশা থাকে। অর্থাৎ আপাতত বিচ্ছিন্ন ঘটনাসমূহ এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট কোনো নকশার ফল। গত ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনার যে ব্যাখ্যা পুলিশ দিয়েছিল তা প্রশ্নের মুখে পড়ে। কারণ এসব ব্যাখ্যারও আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। যেমন বিচারবহিভর্‚ত হত্যাসমূহের মাঝেও থাকতে পারে কোনো আশ্চর্য মিল।
৭ আগস্ট ভোরের কাগজ দৈনিকটির ‘সত্য উদঘাটন ও বিচার নিশ্চিত করা জরুরি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বিচারবহিভূর্ত হত্যা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার অবসান ঘটানোই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’ এই যে ‘বন্ধ করা যাচ্ছে না’ এবং ব্যাপারটা কেবল সমাজ নয় খোদ রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে তা থেকে ঘটনাসমূহের তলায় বিদ্যমান ছক সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়, যদিও তা খালি চোখে দেখা যায় না। এই নকশা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেও তা বিশ^জনীন। সারা পৃথিবীতে পুলিশের হাতে বিচারবহিভর্‚তভাবে মানুষের মৃত্যুর উদাহরণ অনেক। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে তাই দাবি উঠেছে পুলিশে অর্থ বরাদ্দ না করার। বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন এই দাবিকে মূল আলোচ্য করে তুলেছে। আর তা যৌক্তিকভাবেই।
কথায় পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হলেও, বাইরের দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কার্যত পুলিশ ও জনগণ পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে থাকে। বিশেষ করে যখন সমাজে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয় ও মানুষ প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামে। প্রতিবাদকারীদের ঠেঙানোই যেন পুলিশের বড় কাজ আর এই ধারণাই বহু মানুষকে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামিয়েছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন মূলগতভাবে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ। সব বর্ণ, ধর্ম ও জাতির দরিদ্র, পশ্চাৎপদ ও প্রান্তিক মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে কেননা তারাই এর প্রধান শিকার। একইভাবে এ আন্দোলনকারীরাও হয়েছে ব্যাপক পুলিশি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। জ্যাকোবিন সাময়িকীতে মিগ্যান ডে দুই দফায় এ পুলিশি আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। ৯ জুন তিনি তাই লেখেন(Police Brutality Against Protesters Only Stoked the Anti–Police Brutality Movement), ‘তাদের লক্ষ্য শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার ও জনগণকে রক্ষা করা নয়, বরং প্রতিপক্ষকে হারানো, যারা প্রতিবাদকারী।’
মিনিয়াপলিসে যে বাহিনীর এক শ্বেতাঙ্গ সদস্যের হাঁটুর নিচে ৯ মিনিট শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন জর্জ ফ্লয়েড সে সম্পর্কে মিনেসোটার জনপ্রিয় কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর এবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মিনিয়াপলিসের পুলিশ শিকড় পর্যন্ত পচে গেছে এবং এটা এখন একটা ক্যানসার।’ তিনি আরো বলেন, পুলিশি কার্যক্রমে ১৯৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় যা গৃহায়ন খরচের ৬ গুণ, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ১১ গুণ ও অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ব্যয়ের ৪৮২ গুণ।
পুলিশের হাঁটুর নিচে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ফ্লয়েডের আগে অনেকে এবং পরে আরো কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন, গুলি খেয়ে মারা গেছেন আরো বেশি। মানুষের চাপা পড়া ক্ষোভ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে আর পুলিশ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দ্বিগুণ শক্তিতে। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বহু দেশে। ওই নিবন্ধে মিগ্যান ডে লিখেছেন, ‘মানুষ পুলিশি সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করে। পুলিশ তখন পাশবিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদকারীদের ওপর, পুলিশের বিরুদ্ধে আরো ক্ষোভ জমা হয়, আরো প্রতিবাদকারী রাস্তায় নামে। এ হচ্ছে আদ্যিকাল থেকে চলে আসা গল্প।’
আজ রাষ্ট্রের পেটোয়াবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সবখানে পুলিশবাহিনীর ভ‚মিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফ্রান্সে ২০১৬ সালে পুলিশের হাতে খুন হন মালিয়ান বংশোদ্ভ‚ত অ্যাডামা ট্রেওর। ফ্লয়েডকে হত্যার পর ফ্রান্সে পুলিশি নির্যাতন বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নামে মানুষ। ৩০ মে ইজরায়েলি পুলিশের গুলিতে অটিস্টিক ইয়াদ হালাকের মৃত্যুতে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ হয়েছে জেরুজালেমের রাস্তায়। প্যালেস্টাইনবাসীর বিরুদ্ধে ইজরায়েলের পুলিশি নির্যাতন সবচেয়ে সুপরিকিল্পিত, সুসংগঠিত ও নিয়মিত এক বর্বরতা। নিজ নিজ দেশে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, ইংল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়ামসহ বহু দেশে।
অনেক জায়গায় দাবি উঠেছে পুলিশি কার্যক্রমে টাকা দেয়া বন্ধ করার, এমনকি পুলিশ বিভাগই বাতিল করে দেয়ার। সারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি কার্যক্রমে ব্যয় হয় ১১৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি খাতে পর্যাপ্ত বাজেট নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘প্রোজেক্ট এনআইএ’র (যার লক্ষ্য পুলিশ কর্তৃক তরুণদের আটক প্রক্রিয়ার সমাপ্তি) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মরিয়ম কাবা নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন (Yes, We Mean Literally Abolish the Police, June 12, 2020), ‘প্রথমেই বলা প্রয়োজন, পুলিশ কর্মকর্তারা যা করেন বলে মনে করা হয় তারা তা করেন না।’ তিনি বলেন পুলিশ সদস্যরা ছোটখাটো বিষয়েই নাক গলান, কোনো বড় অপরাধী সহজে ধরেন না। ব্রুকলিন কলেজের পুলিশিং এন্ড সোশ্যাল জাস্টিস প্রোজেক্টের সমন্বয়ক আলেক্স ভাইটেলকে উদ্ধৃত করে তিনি লেখেন, ‘আমাদের শেখানো হয়েছে তারা বদমায়েশদের পাকড়াও করে, ব্যাংক ডাকাতদের ধাওয়া করে, সিরিয়াল খুনিদের ধরে...। কিন্তু এটা একটা ডাহা মিথ্যা।’
এনআইএর মরিয়ম কাবা যে সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা ভাবেন সেখানে পুলিশ ও কারাগার নেই। ওই নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমার মতো যেসব লোক পুলিশ ও কারাগারের অবলুপ্তি চায় তারা এক ভিন্ন সমাজের কল্পনা করে। যা ব্যক্তিতান্ত্রিকতার বদলে সহযোগিতার ও আত্মস্বার্থ সংরক্ষণের বদলে পারস্পরিক সহায্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। দেশটি কেমন দেখাবে যখন বাড়তি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে সবার জন্য গৃহ, খাদ্য ও শিক্ষায়?’
ফ্লয়েড হত্যা ও বিএলএমের আন্দোলনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের আচরণে কিছু পরিবর্তন হয়েছে ও কিছু সংস্কার হচ্ছে। যদিও তা খুবই সামান্য। কিন্তু দুনিয়ার কোথাও পুলিশি নির্যাতনের কমতি দেখা যায়নি। মরিয়ম কাবার স্বপ্নের সমাজ ও রাষ্ট্রের আবির্ভাব হতে এখনো অনেক দেরি। তবে সর্বত্র পুলিশের দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতা ও মনোভাবে সংস্কার ও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন জরুরি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক।