×

মুক্তচিন্তা

শোক কি শক্তি হতে পেরেছে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২০, ০৫:৪১ পিএম

আমরা যেন ভুলে না যাই একুশে আগস্ট সাকসেসফুল হলে এদ্দিনে এ দেশ হয়তো আফগানিস্তানের খাতায় নাম লেখাতো। মানুষ বাস করত বাংলাস্তানে। সে কারণেই শোক শক্তি হওয়ার দরকার। কিন্তু হয়নি। আওয়ামী লীগে এখন হাইব্রিড আর উটকো লোকের ভিড়। দেশে যেদিকে তাকাবেন শুধু বন্দনা আর স্তুতি। এগুলো যে কত ঠুনকো আর মেকি সেটা সবাই বোঝেন। তার ভেতরে চলছে চুরি ডাকাতি আর সব নারকীয় ঘটনা।

শোক শক্তি হলে কথা বলার দরকার পড়ত না। কিন্তু এটা মানতে হবে বাংলাদেশে জাতীয় শোক দিবসে শোকের মাতম হলেও শোক শক্তিতে পরিণত হয়নি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ১৫ আগস্ট থেকে ২১ আগস্টের দূরত্ব কতটা। ছয় দিনের ব্যবধান রেখে যারা শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তারা আগস্টকে ঘৃণা করে। এই শক্তি আপাতত নির্জীব আর মৃত মনে হলেও আসলে কি তা সত্য?

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তবে কেন এই মৃত সাপকে রোজ একবার টেনে আনেন তার কথায়? এ পর্যন্ত আমি যতদিন তাকে টিভি ক্যামেরার সামনে দেখেছি কোনো না কোনোভাবে তিনি বিএনপির কথা বলেছেন। এর ভেতর কি এই সত্য লুকায়িত যে আসলে তারাও জানেন এর গোপন শক্তি কতটা? বিএনপি এখানে আলোচনার বিষয় নয়। আমি বলতে চাইছি একটি দল দেশের সর্ববৃহৎ দল ১২ বছর একটানা দেশ শাসনে থাকার পরও কেন তাদের ভুলগুলো শোধরাতে পারছে না। তাদের সামনে তো বিরোধিতা বা প্রতিরোধের কোনো দেয়ালই নেই। বলতে গেলে একতরফা খেলার মাঠ।

আমি সবসময় পাশের দেশ ভারতের দুটি দলের কথা মাথায় রাখি কংগ্রেসের তুলকালাম জনপ্রিয়তা ইন্দিরা গান্ধী থেকে রাজীব গান্ধী পর্যন্ত সময়কাল আমরা দেখেছি। সে দল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান দল। আজ কি তার সে প্রিয়তা আছে? তাদের যে নেতৃত্বের সংকট তা একটি বালকও বুঝতে পারে। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনমুখী দেশে লিডারশিপের অভাব হওয়ার কথা? না সেখানে মানুষের অভাব? মূলত ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব গড়ে তোলা হয়নি বলেই আজ রাহুল গান্ধীর ওপর নির্ভরশীল কংগ্রেসের মাথার ওপর ছাতা নেই। অন্য দলটি পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম। তিন দশককাল রাজ্য শাসনের আমলে তারা হয়তো ধরে নিয়েছিলেন তারাই শুরু তারাই শেষ। আজ সেখানে সিপিএম প্রায় অস্তিত্বহীন। ভোটের বাক্সে খরা তাদের। এই দুই উদাহরণ কিন্তু মাথায় রাখা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য মঙ্গলের। বিলেতের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা বা বিদেশনির্ভর নেতৃত্ব মানুষকে কতটা আগ্রহী করবে সেটা সময়ের হাতে হলেও আমরা একথা বলতে পারি দেশে নেতৃত্বের বিস্তার নেই।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য আমাদের সমাজ ও দেশে বরাবর ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে। সেটা আমরা একাত্তরেও দেখেছি। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত আমাদের পাশে না দাঁড়ালে পাক-চীন-মার্কিন বলয়ের বিরুদ্ধে জিতে আসা সম্ভব ছিল না। একাত্তরে আমাদের সৌভাগ্য ছিল আমরা বন্ধু বিশেষত খাঁটিও সত্যিকারের মিত্র চিনতে ভুল করিনি। আপনি যদি পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তাহলে মানতে হবে আমেরিকা আর চীনের উচিত ছিল তাদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়ানো। তারা তা করেনি বা করতে পারেনি। যে কারণে আত্মসমর্পণ করে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে তাদের। তাই বন্ধু নির্বাচন ও চেনাটা জরুরি। পাকিস্তান আমাদের বন্ধুত্ব চাইছে এই কথা এখন বেশ চালু। তা তারা চাইতেই পারে। আর নিয়ম ও নিজের স্বার্থ বজায় রেখে যে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেও গলার কাঁটা অতীত আর রাজনীতি।

আপনার আমার ভোলার কথা নয় বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলেই কথা চালু ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এসে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। যে দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি ইতর শুয়োর কালো চামড়ার বলে গালাগাল করেন তারা তাকে কত ভালোবাসে। যে দেশের জন্মলগ্নে তিনি রাষ্ট্রসংঘে কাগজ কুটিকুটি করে ছিঁড়ে পায়ে মাড়িয়ে সভ্যতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বেরিয়ে গেছিলেন সেদেশের মানুষ ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে রাস্তায় লাইন ধরে তাকে একপলক দেখার জন্য দাঁড়িয়ে। ভুট্টো সম্পর্কে আমাদের ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা নিয়েও তর্ক আছে। তিনি তার ‘সেই সব পাকিস্তানি’ গ্রন্থে বেনজীরের কথা কোট করে লিখেছেন ভুট্টো সাহেব নাকি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এই খবর পেয়ে খুব বিমর্ষ ছিলেন ও আশ্চর্য হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টোর ভাষ্য আর মতামতে তা মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। খন্দকার মুশতাক সরকারের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন আর বিবৃতি বলে দেয় তারা এই হত্যাকাণ্ডে ছিল উল্লসিত। অথচ আমরা জানলাম উল্টো কথা।

এখন আবার পাকিস্তানের দাবার ঘুঁটি সচল। এমন কি কি কারণ আছে যাতে মনে হতে পারে যে পাকিস্তান আমাদের উন্নয়ন আর অগ্রগতিতে খুশি? এই সেদিন তাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা টকশোতে বললেন আমাদের দেশকে সুইজারল্যান্ড বানানোর দরকার নেই দয়া করে আগে বাংলাদেশ বানিয়ে দেখাও। ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা সভায় একজন তো প্রকাশ্যে বললেন নারী শক্তির উদ্ভাস আর প্রগতিশীলতাই বাংলাদেশকে তাদের থেকে একশ হাত এগিয়ে রেখেছে। এসব কথাবার্তা হজম করে ইমরান খান আমাদের জন্য দিওয়ানা হয়ে গেছেন এটা মানা যায়? এই ১৫ আগস্ট আমরা মিডিয়ায় কেক কাটার গল্প বা ছবি দেখিনি। তার মানে এই না যে তা হয়নি। বা জন্মদিন পালিত হয়নি। আওয়ামী লীগের সরকার দেশে পোক্তভাবে গদিতে আছে বলে মিডিয়া এগুলো নিয়ে মাতম করে না। কিন্তু আমরা তো খবরে দেখলাম চীনা দূতাবাসের উপহার পৌঁছে গেছে জন্মদিনের বাড়িতে। সে যে কেউ পাঠাতেই পারেন। আর কারো জন্মদিন যদি সত্যিকারের জন্মদিন হয় আর তিনি হন সাবেক সরকারপ্রধান তাকে উপহার পাঠানো শিষ্টাচার বৈকি। কিন্তু আমরা কি ভুলে যাচ্ছি তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত দণ্ডভোগকারী। তার এই মুক্তি সাময়িক। সে কথা জানার পরও এই কাজ করা হলো নাকের ডগায়।

মনে হতে পারে আমি কোনো একটি দলের বিরুদ্ধে লেখার জন্য কলম ধরেছি। না তা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি দীর্ঘ সময় সরকারে থাকার কারণে যে সুখনিদ্রা আর আত্মসন্তুষ্টি তা কিন্তু ক্রমেই সব ঝাপসা করে দিচ্ছে। বন্ধু দুশমনের জায়গাটাও বোঝা যাচ্ছে না। এমনটা আমরা আমাদের তারুণ্যেও দেখেছিলাম। সেই কালো দিনে রাস্তায় নামার কোনো লোক ছিল না।

আমরা যেন ভুলে না যাই একুশে আগস্ট সাকসেসফুল হলে এদ্দিনে এ দেশ হয়তো আফগানিস্তানের খাতায় নাম লেখাতো। মানুষ বাস করত বাংলাস্তানে। সে কারণেই শোক শক্তি হওয়ার দরকার। কিন্তু হয়নি। আওয়ামী লীগে এখন হাইব্রিড আর উটকো লোকের ভিড়। দেশে যেদিকে তাকাবেন শুধু বন্দনা আর স্তুতি। এগুলো যে কত ঠুনকো আর মেকি সেটা সবাই বোঝেন। তার ভেতরে চলছে চুরি ডাকাতি আর সব নারকীয় ঘটনা। যেগুলোর আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে দলের পরিচয়। দলীয় পরিচয়ের এই ইমেজ কি মানুষকে বিব্রত ও বিরক্ত করে তোলেনি? সাধারণ মানুষ যদি পাশে না থাকে দুর্দিনে কে দাঁড়াবে? আজ যে আনন্দ উল্লাস ভোগ আর পাওয়ার তার পেছনে যেসব মানুষের শ্রম ত্যাগ আর নিষ্ঠা তারা হারিয়ে গেছে। তার বদলে এখন খাই খাই পার্টির জয়জয়কার। এই জায়গা শুদ্ধ করে শোককে শক্তিতে পরিণত করা কঠিন। মিডিয়ার প্রচার আর স্তুতি ও স্তাবকতা সরিয়ে আসল কাজ শুরু করা প্রয়োজন। তা না হলে ভবিষ্যৎ ছেড়ে কথা বলবে না।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App