×

মুক্তচিন্তা

বন্যা-উত্তর কৃষকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২০, ০৫:২৩ পিএম

বন্যা-উত্তর কৃষকের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

ফাইল ছবি

এবারের বন্যা অন্য বছরের বন্যার চেয়ে একটু ভিন্ন প্রকৃতির। করোনা মহামারি চলাবস্থায় আম্ফানোত্তর এই বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। দেশের কৃষক, মৎস্য চাষি, পোল্ট্রি ও দুগ্ধ চাষিরা করোনা ও আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যখন হিমশিম খাচ্ছেন, পানির দামে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করে যখন সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন, মহাজনের ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, তখন বন্যার মতো দুর্যোগ এসে কৃষক, মৎস্য চাষি, দুগ্ধ এবং পোল্ট্রি খামারিদের ফেলেছে মহাবিপদে।

এ বছর বন্যা হয় তিন ধাপে। বন্যা প্রথম শুরু হয় ২৬ জুন। প্রথম ধাপে ১০টি জেলায় এবং দ্বিতীয় ধাপে আরো ৮টি জেলায় বন্যার বিস্তার ঘটে। সব মিলিয়ে দেশের ৩৭টি জেলার নিম্নাঞ্চল তিন ধাপে প্লাবিত হয়। বন্য-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন কর্মসূচিগুলো যেন ভালো হয়, খুব কার্যকরী হয় এবং সময়ানুবর্তী হয় সে বিষয়ে সবাইকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমির ফসল। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। সব মিলিয়ে ৩৭ জেলায় তিন দফা বন্যায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৫১। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সবাইকে প্রণোদনার আওতায় আনার ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গত ১৯ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বন্যার এ ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ধান। উপদ্রুত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত আউশ ধানের জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ২১৩ হেক্টর এবং টাকার অঙ্কে ৩৩৪ কোটি। এছাড়া ৭০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমির ৩৮০ কোটি টাকা মূল্যের আমন ধান ও ৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমির আমন বীজতলা বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর বাইরে ২৩৫ কোটি টাকার সবজি ও ২১১ কোটি টাকার পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন চিনিকল এলাকায় আখ ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বন্যায়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যাতে ক্ষতি পুষিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্য ব্যাপক প্রণোদনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।

ইতোমধ্যে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩১ জন ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। সংক্রামক রোগ-ব্যাধি থেকে মানুষজন বাঁচাতে হলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নলক‚প ও ল্যাট্রিনগুলো জরুরিভিত্তিতে মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। মেরামত করতে হবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যায় অনেক কৃষকের পাওয়ার টিলার, অগভীর নলক‚পসহ বিনষ্ট হয়ে গেছে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি। এসব কৃষি যন্ত্রপাতি জরুরিভিত্তিতে মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যার ফলে অধিকাংশ কৃষক অভাবে পড়ে গৃহপালিত পশুপাখি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাদের বিনামূল্যে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলের বাচ্চা ও খাবার সরবরাহ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা, টিকা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। বন্যার পরপরই কৃষকদের দানাশস্যের অভাব পূরণের জন্য ভুট্টা, সরিষা, মাষকলাই ও মুগ ডাল চাষের ওপর জোর দিতে হবে। বন্যা উপদ্রুত এলাকার কৃষক ভাইদের প্রণোদনার আওতায় শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষিঋণ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি গ্রামে ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ক্যাম্প খুলতে হবে।

এবারের বন্যায় বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমির পাশাপাশি মাছের ঘের ও পুকুরের বড় ক্ষতি হয়েছে। দেশের ধান, পাট ও সবজি চাষিদের ক্ষতি পোষাতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মাছ চাষিদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত তেমন উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মাছ চাষিদেরও পুনর্বাসনে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্ত পোল্টি চাষিদেরও পুনর্বাসন করা।

করোনা ঝুঁকির সময় কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে হাওরাঞ্চলসহ সারাদেশের কৃষক সময়মতো নির্বিঘ্নে বোরো ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বন্যা-উত্তর কৃষি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার ঠিক একইভাবে সবাই সক্রিয় হলে বন্যা বিধ্বস্ত মৃত মাঠ আবার ভরে উঠবে সোনালি ফসলে এবং কৃষকের মুখেও ফুটবে পরিতৃপ্তির হাসি।

সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App