×

সাহিত্য

স্থবির দেশের পাঁচ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২০, ১০:২৪ এএম

স্থবির দেশের পাঁচ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

মনিপুরী থিয়েটারের ‘কহে বিরাঙ্গনা’ নাটকে। ছবি: ভোরের কাগজ।

স্থবির দেশের পাঁচ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

গোলাম কুদ্দুছ

স্থবির দেশের পাঁচ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

তৌফিক হাসান ময়না

স্থবির দেশের পাঁচ জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গন

সাদেকুর রহমান সুজন

করোনার কারণে এখনও স্থবির সংস্কৃতির শহর ঢাকাসহ দেশের ৬ জেলা। গত পাঁচ মাসে সরকারি কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার যে ধারা, তা পুরোপুরি পালটে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টিরও আহ্বান জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

তারা বলেন, এখন এমন অনুষ্ঠানের চল শুরু হয়েছে, যা সেই অনুষ্ঠানে না গিয়েও দর্শকরা বলে দিতে পারে কী হবে সেখানে। মানুষের মধ্যে সেই আগ্রহ, সেই চমকটাও সৃষ্টি করতে পারছেন না সংস্কৃতিকর্মীরা। সাংস্কৃতিক জোট, নাট্য ফেডারেশনের মতো সংগঠনগুলোও বছরের পর বছর ধরে রুটিন ওয়ার্কের মতো একই ধারায় একই নাটক পরিবেশন করছে, তাই মানুষ আর এসব গ্রহণ করছে না।

[caption id="attachment_238631" align="aligncenter" width="700"] তৌফিক হাসান ময়না[/caption]

জানতে চাইলে বগুড়া থিয়েটারের পরিচালক তৌফিক হাসান ময়না ভোরের কাগজকে বলেন, বগুড়া হচ্ছে হটস্পট। এর মধ্যে দলের অনেক কর্মীও করোনাক্রান্ত হয়েছেন। এখনও পরিবেশ অনুকূলে নেই। তাই ভার্চুয়ালি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি টুকটাক নাটকের মহড়াও শুরু করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১৫ আগস্টের প্রোগ্রাম করেছি।

[caption id="attachment_238632" align="aligncenter" width="700"] সাদেকুর রহমান সুজন[/caption]

বগুড়ার সংশপ্তক থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান সুজন বলেন, মফস্বলে অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে, অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাজ করি। কিন্তু গত মার্চ থেকে আমাদের সব কর্মকাণ্ডই বন্ধ, একেবারেই স্থবির। আগামি নভেম্বরের আগে শুরু করাও যাবে না। তবে প্রযোজনা চলমান আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শো করবো।

বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ বলেন, করোনার অভিঘাত থমকে দিয়েছে বরিশালের সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামি সেপ্টেম্বরে কাজ শুরু করার ইচ্ছে আছে। তবে ভার্চুয়ালি নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি

রাজশাহীতে প্রায় পাঁচ দশক ধরে নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত মলয় ভৌমিক। ১৯৭৪ সাল থেকে মঞ্চের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন অনুশীলন নাট্যদলের প্রধান উপদেষ্টা। জানালেন, কোভিডের আগে দুটো প্রোডাকশন রেডি করেছিলেন। যা প্রদর্শনী করার কথা ছিল। কিন্তু করোনা থামিয়ে দিয়েছে। তবে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তারা যে যার বাড়ি থেকে ভার্চুয়ালি শ্রুতি নাটক করছেন। ইতোমধ্যে দুটো প্রচারও হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আরো দুটো প্রচার হবে।

মলয় ভৌমিক আরো বলেন, আমরা যেহেতু মঞ্চ নাটকের দল, আমাদের নিয়মিত মহড়া হতো, নিয়মিত প্রদর্শনী হতো। এখন যেহেতু সরাসরি মঞ্চের কাজ করতে পারছি না তাই নিজেরা যাতে নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়ি এজন্যই এসব কাজ করছি। এই সংগঠক বলেন, মূলত স্ট্রিমইয়ার্ড বা জুমে তো আর কালচারাল এক্টিভিটিজ হয় না। দুইজন দুই শহর থেকে কথা বললে দুইজনের কথার মধ্যে সময়ের যে গ্যাপ নাটকের গতি মার খায়। এতে হয়তো টক শো করা যায়।

চট্টগ্রামের নান্দীমুখ নাট্যদলের প্রধান অভিজিৎ সেনগুপ্ত বলেন, এই বছর নান্দীমুখের ২০ বছর পূর্ণ হলো। নানা আয়োজনে এ পূর্তি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সব আয়োজন ভেস্তে গেল। আগে জীবন, তারপর থিয়েটার। তাই আমরা সময়টাকে পর্যবেক্ষণ করছি।

সিলেটের মনিপুরী থিয়েটারের দলপ্রধান শুভাশিস সিনহা বলেন, একদিকে করোনার ধাক্কায় নাজেহাল; অন্যদিকে ঝড়বৃষ্টির দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে এই সময়টায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অফই থাকে। পহেলা বৈশাখ থেকে হ্রাসলীলা ব্যাপক সরগরম থাকে। কিন্তু করোনার কারণে সব থমকে আছে। কবে স্বাভাবিক হবে তাও বুঝতে পারছি না। তবে ভার্চুয়ালি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।

রুদ্র নাট্য দল, বাগেরহাটের জ্যেষ্ঠ কর্মী তপন কুমার দাস বলেন, আমাদের দলে ১০/১২ বছর থেকে ৪০ বছর বয়সী কর্মী রয়েছে। যাদের কারণে নাটকের কর্মকাণ্ড পুরোপুরিই বন্ধ রেখেছি। তবে নাট্য কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি মাস্ক বিতরণও করছি। এ ছাড়া দলের কর্মীদের নিয়ে ভার্চুয়ালি আবৃত্তি, গান, নৃত্যসহ নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। তবে, পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষায় আছি।

জেলার পাশাপাশি রাজধানীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডগুলো কিছু নির্দিষ্ট এলাকাকে কেন্দ্র করে হতে দেখা গেলেও শহীদ মিনার, টিএসসি, শাহবাগ, শিল্পকলা একাডেমি আর মহিলা সমিতিসহ রাজধানীর কোথাও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কোনো উদ্যোগ নজরে পড়ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জানান, করোনার কারণে সংস্কৃতিকর্মীদের কেউ কেউ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে দলকেন্দ্রিক আয়োজনের বাইরে টিভিসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ ছাড়া যারা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দিকপাল, তারা অন্যের কথা না ভেবে টিভি নাটকে অভিনয়, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ ও ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যেই মঞ্চ থেকে তাদের উত্থান, সেই ক্ষেত্রটি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছেন। এমনকি করোনার কারণে কর্মীদের বেহাল দশায়ও তাদের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। এটা দুঃখজনক।

এ প্রসঙ্গে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, করোনার অভিঘাতে জাতীয় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাঙালি সংস্কৃতি বর্তমানে ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে রয়েছে। প্রথমটি করোনা। দ্বিতীয়ত মৌলবাদ। এ কারণে অনেকেই সংস্কৃতিচর্চা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং আমাদের তরুণদের পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি অন্ধ অনুকরণ। এসবের কারণে বাঙালির আদি সংস্কৃতির চর্চা এমনিতেই অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে তা যেন আরো স্থবির হয়ে পড়ল। তিনি বলেন, এই ত্রিমুখী ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় সব এলাকাতেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আবার উঠে দাঁড়াক এই আশা।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, করোনার কারণে এখন সবকিছুই তো স্থবির। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, পেনডামিকের পরে নতুনভাবে ভাবতে হবে। এলাকার স্কুল-কলেজ, ক্লাব-সংগঠনকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহী করে তোলার সামগ্রিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তা না হলে উৎসবের আয়োজন বড় অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বড় সাংস্কৃতিক অভিঘাত সৃষ্টি করবে না।

[caption id="attachment_238630" align="aligncenter" width="1280"] গোলাম কুদ্দুছ[/caption]

এ প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, করোনায় ঢাকাসহ সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া অবধি কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নয়। আগে জীবন তারপরেই সংস্কৃতি। মানুষ না বাঁচলে সংস্কৃতি কার জন্য? মানুষের জীবনকে প্রাধাণ্য দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, করোনায় বাইরের পৃথিবী বন্ধ হলেও বাসায় বসে গান, ছবি আঁকা, লেখালেখিসহ সব সৃজনশীলতার চর্চা করে যাচ্ছে মানুষ। করোনাকালের এইসব লেখা আগামিতে মঞ্চ কাঁপাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App