×

মুক্তচিন্তা

প্রাণঘাতী ভাইরাসের নাম দুর্নীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২০, ০৮:৩৩ পিএম

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য নিজ সম্পর্কে নিজেই লিখিত বিশেষণে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। খুব হাস্যকর ঠেকেছে বিষয়টি। লজ্জাও পেয়েছি। আজকাল অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরাও নিজ সম্পর্কে সচেতনভাবে সত্য কথা বলার চেষ্টা করে। সেখানে সাবেক মহাপরিচালকের নিজ সম্পর্কে বিশেষণের বহর দেখে অপরিপক্ব মনস্কধারী মনে হয়েছে। নিজের গুণগান এমন কণ্ঠে বড্ড বেসুরা লেগেছে।

একশ বছর পরপর প্রাণঘাতী ভাইরাস মানবজাতিকে বিনাশ করতে পৃথিবীতে দেখা দেয়। বিভিন্ন পরিচয়ে, বৈশিষ্ট্যে এসব ভাইরাসের আগমন ঘটে। প্লেগ ভাইরাসের একশ বছর পর এসেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস এবং এখন গোটা বিশ^ এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে তটস্থ, বিপন্ন। ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ব্যতিব্যস্ত উন্নত, উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশ। উন্নত অনেক দেশ দম্ভ ও অহমিকা এবং বড়ত্বের কারণে আশানুরূপভাবে সংক্রমণ রোধ করতে না পারলেও উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশ মেধা ও বুদ্ধির যথাযথ প্রয়োগে সীমিত সামর্থ্যে সংক্রমণ বেশ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। আপাততদৃষ্টিতে সেটাই মনে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রাণঘাতী করোনা বাংলাদেশে এসে বেসামালভাবে তার সংক্রমণ ঘটিয়েছে। করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করার বহু রকম পূর্ব প্রস্তুতির কথা শোনা গেলেও আদতে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। কারণটা এখন নাবালক থেকে সাবালক, সবাই সমবেত ও সমস্বরে বলে দিতে পারেন। আর সেটা হলো দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতি।

বাংলাদেশের বড় একটা সমস্যা হলো এই দুর্নীতি। জাতির অস্তিত্বকে বিনাশ, বিপন্ন করতে সমস্যাটাই যথেষ্ট। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অবতারণা, তার ওপর থাবা বসিয়ে চলছে অবিরত এই দুর্নীতি। করোনা নয় বাংলাদেশে দুর্নীতিই মূলত প্রাণঘাতী একটা কঠিন ভাইরাস। যে ভাইরাস ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পাল্টায়, বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে চলে এবং সংক্রমিত হয় অবলীলায়। ফলে দেশের সরকারপ্রধানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিতেও এর উৎপত্তি ও সংক্রমণ রোধ হয় না, নির্মূল হয় না। দুর্র্নীতি নির্মূলের উপযুক্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় না। করোনার মতো ভাইরাসের সঙ্গে দুর্নীতি ভাইরাসের মৌলিক পার্থক্য এভাবে করা যায়, প্রথমত করোনারা অদৃশ্য এক অণুজীব, আর দুর্নীতি কখনো অদৃশ্য কখনো বা দৃশ্যমান বৃহৎজীব। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনার মতো ভাইরাস ব্যাপক সংক্রমণে মানবদেহের ক্ষতিসাধন করে মৃত্যুর সম্ভাবনা ঘটায়। যেখানে কোনো আইনবিধি, শাসনের তোয়াক্কা না করে দুর্নীতি নামক প্রাণঘাতী ভাইরাসটি মানুষের মানসিক সুস্থতাকে ধ্বংস করে অপরের মৃত্যুর সম্ভাবনা নিশ্চিত করে। যার নির্মম শিকার হয় সমাজ ও সাধারণ জনগণ এবং যেখানে মর্মান্তিক মৃত্যুর সংখ্যা সীমা ছাড়ায়। জাতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত করোনার মতো ভাইরাস একশ বছর পরপর দেখা দেয়। আর দুর্নীতি থাকে বছরের পর বছর এবং তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশেষ কুচক্রী মহলের নিয়ন্ত্রণে। চতুর্থত করোনার চেয়েও দুর্নীতি বেশি শক্তিশালী। মানবজাতির মৃত্যুতেই করোনার পরিসমাপ্তি। কিন্তু দুর্নীতির পেছনে থাকে প্রচণ্ড স্বার্থ ও লোভ। যার পরিসমাপ্তি বলে কোনো কিছু নেই। উপরন্তু এই লোভ মানবজাতির মৃত্যুতেও ক্ষান্ত হয় না। লোভের ঘাটতি হয় না।

সহজ করে বললে দুর্নীতি সংবিধান সম্মত নয় এমন এক নেতিবাচক আচরণ এবং প্রক্রিয়া। কারা করেন, করছেন এমন আচরণ? তিনি, যিনি দেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, সংবিধান মানেন না, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করেন, এককথায় তিনিই দুর্নীতি করেছেন এবং করে থাকছেন। সোজাসাপ্টা তিনি দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতির উৎপত্তি কিন্তু কোনো খোলা, পতিত জমিতে নয়। আগাছা কিংবা পরগাছাও নয়। দুর্নীতির ছোট-বড় ইতিহাস ঘাঁটলে বেশ পরিষ্কার যে বিষয়টা দেখা যায় তাহলো দুর্নীতিবাজ যেখানে-সেখানে জন্ম নেয় না, তৈরি হয় না। তার উৎপত্তি বা জন্ম যাই-ই বলি না কেন, তার জন্য প্রয়োজন ‘বিশেষ’ জায়গা এবং ‘বিশেষ প্রক্রিয়া’। সব সরকার আমলেই এই ‘বিশেষ’ জায়গা বা প্রক্রিয়া চলমান ছিল এবং আছে। জোর গলায় দাবি করলে হবে না যে, কোনো রাজনৈতিক সরকার আমলে দুর্নীতি ছিল না। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, সেক্টরে কাজ করার জন্য কর্মচারী, কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ, নীতিমালা থাকে। যারা কাজ করেন তাদের সেইসব বিধি-নিষেধ, নীতিমালা মেনে কাজ করতে হয়। নীতিমালা ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে। কাজটি নিশ্চিত করেন সেই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আবার সব প্রতিষ্ঠানকে চলতে হয় সরকারের অনুমোদন ও নিবন্ধনে, নিয়মিত সুপারভিশনে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের সংবিধানসম্মতভাবে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নিশ্চিত করতে হয় যে, প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের ও জনগণের কল্যাণে কাজ করছে কিনা, কাজ হচ্ছে কিনা। খুব পরিষ্কার যে, দুর্নীতির উৎপত্তি উভয় সেক্টর থেকে এবং তা ক্ষমতাসীন কোনো কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় বা সম্পৃক্ততায়। কারণ এই প্রক্রিয়ার জন্য সাহস ও শক্তি লাগে। যার জোগান আসে ক্ষমতাসীন বলয় থেকে। এভাবে উভয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা, শৃঙ্খলার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে একটা ‘বিশেষ প্রক্রিয়ার’ সৃষ্টি হয়। অতপর এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় দলে দলে অনেকেই যোগ দেন মৌমাছির মৌচাকের মধু আহরণের মতো। মধু আহরণের নেশা অদম্য হয়, সংক্রমণে বেপরোয়া হয়। দুর্নীতিবাজের সংখ্যা বাড়ে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের আইন, বিচার ব্যবস্থার ভেতর থেকেও কেউ কেউ বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। তাদের ব্যক্তিত্বের বৈকল্য, অনৈতিক কর্মকাণ্ডও দুর্নীতির সংক্রমণে সহায়কের ভ‚মিকা পালন করে।

চুরি করার সুযোগ থাকলে কেউ কেউ শুধু চুরিই করে না, নতুন চোরেরও উত্থান ঘটে। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে দ্বিতীয় অংশের মানুষের সংখ্যা বাড়ে। ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, দায়িত্বশীলদের অব্যবস্থাপনায় সংক্রমিত হয়। আর এই ভাইরাস আবিভর্‚ত হয় অপরাজনীতির চর্চায়। এই ভাইরাসটিই জাতির অস্তিত্বকে বিনাশ করে চলেছে। চোখে দেখা গেলেও অনেকে না দেখার ভান করে থেকেছেন, থাকছেন। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য। দেশে আলোড়িত, আলোচিত প্রায় সব দুর্নীতির ঘটনার পেছনে দেখা যায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততা, ছত্রছায়া ও যোগসূত্রতা এবং এটা শুধু বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন দলের বেলায় প্রয়োজ্য নয়, বরং সব রাজনৈতিক সরকার আমলে দুর্নীতির নেপথ্যের গল্প এমনই।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য নিজ সম্পর্কে নিজেই লিখিত বিশেষণে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। খুব হাস্যকর ঠেকেছে বিষয়টি। লজ্জাও পেয়েছি। আজকাল অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরাও নিজ সম্পর্কে সচেতনভাবে সত্য কথা বলার চেষ্টা করে। সেখানে সাবেক মহাপরিচালকের নিজ সম্পর্কে বিশেষণের বহর দেখে অপরিপক্ব মনস্কধারী মনে হয়েছে। নিজের গুণগান এমন কণ্ঠে বড্ড বেসুরা লেগেছে। যদি তিনি তার কাজ দিয়েই অন্যের কাছ থেকে বিশেষণ আদায় করে নিতে পারতেন তাহলে তার সম্পর্কের গুণগান নিঃসন্দেহে সুরেলা লাগত। পরিশেষে আবারো বলি, করোনা ভাইরাসের চেয়েও দুর্নীতি হলো শক্তিশালী প্রাণঘাতী ভাইরাস। দুর্নীতির শিকড় উৎপাটন করা না গেলে করোনার মতো ভাইরাস কখনোই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App