×

মুক্তচিন্তা

চীনের জাতীয়তাবাদী তৎপরতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২০, ১০:০৫ পিএম

যে চীন একদিন রাশিয়ার সংশোধনবাদী-প্রবণতার নিন্দায় পঞ্চমুখ ছিল সেই রাষ্ট্রই এখন দেখা যাচ্ছে একনায়কত্ব কায়েম করার ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণা সরবরাহ করে চলেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এমন বন্দোবস্ত করে দিয়েছে যাতে রাষ্ট্রপ্রধান শি জিন পিং আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন; রাশিয়ার পুতিনও সেই মতলবেই ছিলেন, তিনিও একই আয়োজন করিয়ে নিয়েছেন। চীন অগ্রগামী, রাশিয়া পরবর্তী; পথ অভিন্ন।

চীনের জাতীয়তাবাদী তৎপরতা এখন তাকে আমেরিকার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা ধরেই নিয়েছিল যে বিশ্ব থাকবে তাদের কব্জাতে, কিন্তু এখন চীন তার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে এখন একাধারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতা এবং সেরা কৌতুকাভিনেতা হিসেবে দাবি করতে পারেন। ওদিকে আবার তার লজ্জা-শরমের কোনো বালাই নেই; দু’কানই যখন কাটা গেছে তখন হারাবার আর কী আছে? আগামী নির্বাচনেও যে তিনি জিতবার আশা রাখেন তার কারণ তার সঙ্গে কট্টর জাতীয়তাবাদীরা (অর্থাৎ বর্ণবাদীরা) আছে, আছে ধনকুবেররাও।

আমেরিকা একদিন গণতন্ত্রের পতাকা উচ্চে তুলে ধরেছিল। ফরাসি বিপ্লবেরও ১৩ বছর আগে ইংল্যান্ডের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিষ্ঠাতা পিতারা’ যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি রচনা করেছিলেন তাতে স্বাধীনতা ও সাম্য উভয়ের জন্যই অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু সংবিধান যখন রচিত হলো তখন নানা রকমের দরকষাকষির ভেতরে পড়ে সাম্যের অঙ্গীকারটি প্রায় অদৃশ্যই হয়ে যায়; সংবিধানে দাসব্যবস্থা উচ্ছেদের কথা বলা হয়নি এবং ভোটাধিকার কেবল সম্পত্তির পুরুষ মালিকদের জন্যই সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ৮৭ বছর পরে আব্রাহাম লিংকন তার বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যকে যুক্ত করে গণতন্ত্রের একটি সংজ্ঞা ও স্বপ্ন দাঁড় করিয়েছিলেন; যার ভিত্তি ছিল জনগণ। তিনি বলেছিলেন আমেরিকানদের অঙ্গীকার হবে এটা দেখা যে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের পক্ষের সরকার যাতে পৃথিবী থেকে কখনোই বিলুপ্ত না হয়। অমন একটি আদর্শ-সরকার কিন্তু আমেরিকাতে কখনোই প্রতিষ্ঠা পায়নি। এবং গেটিসবার্গ বক্তৃতা প্রদানের দুই বছরের মাথাতেই লিংকন নিজেই প্রতিপক্ষের এক লোকের গুলিতে প্রাণ হারান। পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। আমেরিকা সাম্যের লক্ষ্যকে ধাপে ধাপে এবং সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেছে। সে পুঁজিবাদী হয়ে উঠেছে, পুঁজিবাদী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী হয়েছে এবং নিজের দেশে তো অবশ্যই পৃথিবীর যেখানেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে তার ওপর ক্ষিপ্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেছে, জাপান পরাভূত, তখন জাপানের দুটি শহরের ওপর আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করে দিয়েছে আরো অনেককে। উদ্দেশ্য পৃথিবীকে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে, ভয় দেখানো; জানিয়ে দেয়া যে আমাদের হাতে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যার সাহায্যে এখন থেকে আমরা বিশ্বকে শাসন করব। উৎসাহিত করেছে অস্ত্রনির্মাতা ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের, যার ওপরে আমেরিকার সমৃদ্ধির অনেকটাই নির্ভরশীল। সন্ত্রস্ত রাখতে চেয়েছে রাশিয়াকে, কারণ সে দেশ তখন সমাজতন্ত্রী; অথচ সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া না থাকলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের ক্ষমতা ছিল না হিটলারকে হটায়। আণবিক বোমা পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার ভেতর যে বিস্ফোরক শক্তি রয়েছে তার দ্বারা তৈরি। এই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা এটাতে ব্যবহৃত করোনা ভাইরাস তো দেখা যাচ্ছে আণবিক বোমারই উন্নত সংস্করণ। ক্ষুদ্র, অদৃশ্য এবং অসম্ভব রকমের শক্তিশালী। নিখরচায় মানুষ ধ্বংস করতে ওস্তাদ। না, আমেরিকার কাছ থেকে সে আসেনি, এসেছে আমেরিকারই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্ব›দ্বী চীনের কাছ থেকে। একদা যে সমাজতন্ত্রী ছিল, কিন্তু এখন যে আমেরিকাকেও পেছনে ফেলতে চায় পুঁজিবাদী তৎপরতায়। আণবিক বোমার জন্ম যেখানে করোনা ভাইরাসের জন্মও সেখানেই, পুঁজিবাদে। অচিরেই আমেরিকায় রাষ্ট্রগত পরিবর্তন আসবে এটা দুরাশা। সামনে নির্বাচন; তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি না জিতেন তাহলে জিতবেনটা কে? জিতবেন জো বাইডেন। জো বাইডেন একটা প্রতিশ্রুতি এই করোনা বিপর্যয়ের ভেতরেই দিয়ে ফেলেছেন; নির্বাচিত হলে ঠিক পরের দিনই তিনি আমেরিকাকে পুনরায় যুক্ত করবেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে। মনে হচ্ছে বৈপ্লবিক, কিন্তু আসলে তো পঙ্গু একটি প্রতিষ্ঠানে প্রত্যাবর্তন মাত্র। কিন্তু ট্রাম্প সাহেব ঘটনাকে এমন জায়গাতে নিয়ে গেছেন যে পূর্বাবস্থায় গমনকেই মনে হচ্ছে মস্ত এক অগ্রগমন।

শোনা যাচ্ছে আগামী নির্বাচনে ব্যক্তিগত আক্রমণটাই দাঁড়াবে প্রতিদ্বন্দ্ধিতার ক্ষেত্রে প্রধান রণধ্বনি। সম্ভ্রম বলতে ট্রাম্প সাহেবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তিনি তাই নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বাইডেনের ওপর। ব্যক্তিগত চরিত্রে বাইডেন সাহেবও যে পূতপবিত্র এমন নয়; যৌন অসদাচরণের অভিযোগ তার বিরুদ্ধেও উঠেছে, ট্রাম্পের নির্দয় আক্রমণের মুখে অভিযোগ হয়তো আরো স্থ‚ল রূপ পরিগ্রহ করবে। তবে এ ব্যাপারে আমেরিকানদের পুঁজিবাদী নৈতিকতার মান এখন আর এমন নয় যে দুই প্রতিদ্ব›দ্বীর কেউই ওই উন্মোচনে বিড়ম্বিত হবেন। অমন বিখ্যাত যে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তারও তো বেশ ভালোই সুনাম ছিল প্রেমিক হিসেবে। আর বিল ক্লিনটন সাহেব তো কলির কেষ্টর মতোই দুর্দান্ত ছিলেন। এরা কেউই বিব্রত হননি। অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশ কোরিয়া; সে দেশের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এক ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল যৌন অসদাচরণের। সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করে ফেলেছেন বলে জানা যাচ্ছে। অতিশয় উন্নত ও তুলনায় কম উন্নতর মধ্যে ব্যবধান থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে নৈতিক সদাচারণের বেলাতে সেটা পরিমাণগতই, গুণগত নয়। খোদ নৈতিকতাই যখন নেই তখন যৌন নৈতিকতার আর দোষ কী।

ফলে দেখা যাচ্ছে গলা তুলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা এবং তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ধরে রাখার প্রত্যয় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে চীনের বৈশিষ্ট্য দানের সংকল্পও ব্যক্ত করা হচ্ছে। সমাজতন্ত্রকে জাতীয় বৈশিষ্ট্য দেয়ার অভিপ্রায় যদি কারো জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তাদের দোষ দেয়া যাবে না। হিটলার এবং মুসোলিনিও নিজেদের সমাজতন্ত্রীই বলতেন এবং সেই সমাজতন্ত্রও ছিল তাদের নিজেদের দেশের মতো করেই গড়ে তোলা, অর্থাৎ কিনা জাতীয়তাবাদী। চীনের আকাক্সক্ষাটা হলো জাতীয়তাবাদী রূপেই তারা আধুনিক, অর্থাৎ পুঁজিবাদী হবে। ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র যে পুঁজিবাদের তুলনাতেও আধুনিক, সে যে পুঁজিবাদের আগে নয়-পরেই এসেছে, সেই সরল সত্যটাকে তারা ভুলে বসেছে। ইচ্ছা করেই।

মাও-এর কালে চীন ছিল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রভ‚মি। আমাদের দেশেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্তদের মধ্যে যারা অধিক অগ্রসর, উগ্র বলেই কথিত, তারা নিজেদের চীনপন্থি বলতে ভালো বাসতেন। কিন্তু ‘স্বদেশি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কমিউনিস্ট চীন’ এখন আর আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, তাদের সব চিন্তা এখন নিজেদের নিয়েই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আধুনিক চীনা পার্টির একটা বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। পার্টি বলছে তাদের নীতিটা হচ্ছে, ‘জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষা করা এবং জাতীয় অর্থনীতি বিকশিত করার ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে নিপীড়িত জাতিগুলো ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমর্থন করে যাওয়া’। এর অর্থ দাঁড়ায় কোনো পক্ষপাতিত্ব নয়, কে কমিউনিস্ট, কে নয় এই বিবেচনা অপ্রয়োজনীয়, অকমিউনিস্ট জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গেও তাদের সুসম্পর্ক থাকবে। আর অকমিউনিস্ট জাতীয়তাবাদী মানেই তো পুঁজিবাদী। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন সেটাই করছে, তথাকথিত নিপীড়িত জাতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসক দলকে এবং বামপন্থি দলকে সমান চোখেই দেখছে, বাম-ডানের পার্থক্য নেই। সাপও বন্ধু এবং সাপের গ্রাসে পড়া ব্যাঙও বন্ধু।

ওদিকে আবার চীনের জাতীয়তাবাদী তৎপরতা তাকে রীতিমতো আগ্রাসী করে তুলেছে। অন্য দেশের রাজনীতিতে চীন ছলে-বলে-কৌশলে হস্তক্ষেপ করছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছিল ১৯৬২ সালে; তখন মাও সে তুং জীবিত, সংঘর্ষটি মিটমাটে শেষ হয়েছিল। ২০২০ সালে এসে সেই সংঘর্ষ আবার বেধেছে। কিন্তু এবার চীনের প্রস্তুতি অনেক বড় রকমের। সীমান্তে তারা নানাবিধ স্থাপনা গড়ে তুলেছে; লম্বা মহাসড়ক তৈরি করেছে। নতুন অবস্থান থেকে যে সরবে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। হংকংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে চীনের এত দিনকার নীতি ছিল ‘এক দেশে দুই ব্যবস্থা’; অর্থাৎ চীনের সমাজতন্ত্র এবং হংকংয়ের পুঁজিবাদ সহঅবস্থান করবে, অসুবিধা নেই। এখন চীন যেহেতু আর সমাজতন্ত্রী নেই তাই পুঁজিবাদের অধীনেই হংকংকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়ার আইনি ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টায় রয়েছে। ভুক্তভোগীদের জন্য চীনের জাতীয়তাবাদী প্রবণতা যে কেমন মর্মান্তিক ক্ষতি ও দুঃখের কারণ হতে পারে সেটা তো আমরা ১৯৭১-এ নিজেরাই টের পেয়ে গেছি। পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে তারা টুঁ শব্দটি করেনি, কারণ পাকিস্তান তখন তাদের গোপনে সাহায্য করছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সহযোগিতার হস্ত প্রসারণের ব্যাপারে। এরপরে মিয়ানমার যখন ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিজেদের মাতৃভ‚মি থেকে উৎপাটিত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিল চীন তখন কাজটির নিন্দা করা দূরে থাক নীরবে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষকে সমর্থনই দিয়েছে। কারণটা অন্যকিছু নয়, মিয়ানমারের কাছ থেকে তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যে চীন একদিন রাশিয়ার সংশোধনবাদী-প্রবণতার নিন্দায় পঞ্চমুখ ছিল সেই রাষ্ট্রই এখন দেখা যাচ্ছে একনায়কত্ব কায়েম করার ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণা সরবরাহ করে চলেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এমন বন্দোবস্ত করে দিয়েছে যাতে রাষ্ট্রপ্রধান শি জিন পিং আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে পারেন; রাশিয়ার পুতিনও সেই মতলবেই ছিলেন, তিনিও একই আয়োজন করিয়ে নিয়েছেন। চীন অগ্রগামী, রাশিয়া পরবর্তী; পথ অভিন্ন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App