×

মুক্তচিন্তা

কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২০, ০৮:৩০ পিএম

ভয়াবহ বেপরোয়া রূপে সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং কালচার। কিশোর গ্যাং দ্বারা পরিচালিত অপরাধ যেন একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিতে যাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে-বন্দরে উঠতি বয়সের ছেলেরা একত্রিত হয়ে চালিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের অসামাজিক তৎপরতা। বিভিন্ন নামে এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং। কখনো পাড়া, মহল্লায় স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব কিশোর গ্যাং। আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন ও বিপণনের স্বার্থে ওদের গ্রুপে গ্রুপে মারামারি-খুনাখুনি লেগেই আছে। তারা ঘটাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের মতো কর্মকাণ্ড। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে রয়েছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। মুঠোফোন ব্যবহার করে এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে। যে বয়সে বই নিয়ে কিশোরদের স্কুলে যাওয়ার কথা ঠিক সেই বয়সে ছুরি, চাকু হাতে কিশোররা হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে উঠতি বয়সের কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজ ব্যবস্থায়।

গত ১৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানী এলাকায় কিশোর গ্যাং দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে স্থানীয় দুই কিশোর ১৮ বছরের কলেজছাত্র নিহাদ ও ১৫ বছরের নবম শ্রেণির স্কুলছাত্র জিসান শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দিলে তাদের মৃত্যু ঘটে। সারাদেশে গ্যাং কালচারের অস্তিত্ব থাকলেও ঢাকায় এর দাপট বেশি। রাজধানীতে ৬২টি কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ৪২ গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ এবং এদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। একটি সূত্রমতে, গত ১০-১১ বছরে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকাণ্ড বেশিরভাগই কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদারের নেতৃত্বে এরা বড় ধরনের চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং এবং মাদক বিক্রির মতো কাজে যুক্ত হচ্ছে। অস্ত্র বহনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের কিশোরদের লিপ্ত থাকার নজির রয়েছে। এর পেছনে কখনো কাজ করে এক শ্রেণির শক্তিশালী সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্র।

অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্তের। ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযত্ন, অবহেলার মধ্য দিয়ে। পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আজকাল অর্থবিত্ত নির্বিশেষে মা-বাবা, অভিভাবক কিশোর সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখেন না। পরিবারের প্রায় সবাই জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এত ব্যস্ত থাকেন যে ঘরে তাদের সন্তানের দেখভালের যথেষ্ট সময়ই পান না। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারে ব্যস্ত কিশোর সময় কাটায় এক পরিবার-বিচ্ছিন্ন জগতে। এছাড়া শরীর চর্চা, খেলাধুলার কোনো সময় বা সুযোগ নেই আজকের সর্বস্তরের কিশোর-তরুণদের। কোনো বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ নেই ওদের। কৈশোরে মনোজগতের বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা ধাবিত হয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়। কখনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অর্থের প্রলোভনে কিশোর-তরুণদের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফায়দা লুটতে ব্যবহার করা হয় কিশোর গ্যাং। পর্দার আড়ালে থেকে যারা এসব কাজ করেন তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর গ্যাংয়ের অপরাধী কিশোর কখনোই অপরাধ জগতের পঙ্কিল পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। অকালে জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে হয়তো একসময় এর পরিসমাপ্তি ঘটে।

এজন্য সর্বস্তরের শিশুর জন্য সুশিক্ষা দানের ব্যবস্থা নিতে হবে। নিম্নবিত্তের শিশুদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রতিটি নিম্নবিত্তের কিশোরের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিদান নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন সুবিধা দিতে হবে। ছিন্নমূল কিশোরদের করতে হবে পুনর্বাসন। অপরাধ চক্রে জড়িয়ে যাওয়া কিশোরদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি ওদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উন্নত চিন্তা-চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণসহ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। কিশোর গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

মালিবাগ, ঢাকা।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App