×

রাজনীতি

আপা দাঁড়ান, আমি ছবি তুলতে পারিনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২০, ১২:০২ পিএম

আপা দাঁড়ান, আমি ছবি তুলতে পারিনি

এস এম গোর্কি

‘আপা একটু দাঁড়ান, আমি ভালো ছবি তুলতে পারিনি’। আপা বললেন, ‘তোদের আর ছবি তোলা শেষ হয় না! আচ্ছা, তোল’। আপা দাঁড়ানোর ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথম গ্রেনেডটি চার্জ হয়। ছবি তোলার আর সময় আমরা পাইনি। ভেবেছিলাম ককটেল হামলা হবে হয়তো।

কারণ তখন পর্যন্ত গ্রেনেড সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু আমাদের সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে মুহুর্মুহু গ্রেনেড চার্জ করা হয়। বিকট আওয়াজ। চারদিকে রক্তাক্ত-আহত-ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার। সবাই বুঝতে পারলাম, টার্গেট আমাদের আপা। দলের নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আপাকে গাড়িতে তুললেন। কিন্তু ভয়ঙ্কর হামলায় শুধু বোমাই ফুটছিল না, সেইসঙ্গে গুলিও করা হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুব। রক্তাক্ত হামলায় প্রাণ হারান ২৪ জন। ভোরের কাগজের সঙ্গে এভাবেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার নির্মম স্মৃতিচারণ তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিনিয়র ফটোগ্রাফার এস এম গোর্কি।

ওই সময় দৈনিক যুগান্তরের প্রধান ফটোসাংবাদিক ছিলেন এস এম গোর্কি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস-জঙ্গি-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শান্তি সমাবেশ ও মিছিলের অনুষ্ঠান কভার করার জন্য তাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয় অফিস। মিছিলপূর্ব সমাবেশে ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চের সিঁড়ির কাছেই ছিলেন তিনি। পরে ছবি নেয়ার জন্য মঞ্চে উঠেন। গ্রেনেড হামলার আগ মুহূর্তে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার খুব কাছে থেকে ছবি তুলছিলেন। খুব কাছে থেকে দেখেছেন সেদিনের বীভৎসতা। ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন এই ফটোসাংবাদিক। বললেন, আমরা মঞ্চের উপরে। আইভি রহমান শেখ হাসিনাকে হাত ধরে নামাবেন বলে নিচে দাঁড়িয়ে। তিনি আর হাত ধরার সুযোগ পাননি। এর আগেই বিকট শব্দ। প্রথম শব্দ শোনার পরপরই সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, মায়া ভাই, ব্যক্তিগত নিরাপত্তকর্মী মামুন ভাইসহ অসংখ্য নেতাকর্মী আপাকে মানবব্যূহ করে রক্ষা করে। সম্ভবত, প্রথম গ্রেনেডটি ট্রাকের ডালায় লেগেছিল বলেই আপা বাঁচলেন। সেটি ট্রাকের উপরে পড়লে আমরা সবাই মারা যেতাম।’

সেদিন শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ গাড়িটি মঞ্চের খুব কাছেই ছিল। গাড়ির বডিতে, গ্লাসে, টায়ারে গুলি লাগলেও বুলেটপ্রুফ হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। গোর্কি বলেন, ‘মঞ্চের সামনে তখন রক্তবন্যা। শত শত মানুষ শুয়ে আছে। কে নিহত আর কে আহত বোঝার উপায় নেই। আমিও রক্তাক্ত। রক্তে সব শরীর ভিজে গেছে। পুলিশের প্রোটেকশনে আমাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে সাধারণ পুলিশের গাড়ি মনে করে জনগণ তখন ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। উপায় না দেখে চালক পল্টন মোড়ের দিকে যায়। ততক্ষণে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি আইল্যান্ডের উপরে উঠে গেছে। বর্তমানে এশিয়ান টিভির ক্যামেরাম্যান জেমস আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করি। সে দৌড়াতে দৌড়াতে ঢাকা মেডিকেলে আসে। আমি হুইল চেয়ারে রক্তাক্ত অবস্থায় বসা। তখন একের পর এক আহতরা আসতে শুরু করেছে। ঢামেক যেন এক মৃত্যুপুরী। সেখানে আমার চিকিৎসা হয়নি। জেমস আমাকে শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেও জায়গা হয় না।

আওয়ামী লীগ নেতা সুভাষ সিংহ রায় ফোন করে জানান, আমার জন্য ধানমন্ডির ৫ নম্বরে সাউথ এশিয়ান হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হয়েছে। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্স-রে করে সাউথ এশিয়ান হাসপাতালে যাই। সেখানে পূর্ব-পরিচিত ডা. অধ্যাপক কাজী শহিদুল ইসলাম আমার চিকিৎসা করেন। তবুও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের সঙ্গেই তার বসবাস। সারা শরীরেই স্প্লিন্টার। এখনো অর্ধ শতাধিক স্প্লিন্টার তার শরীরে। মাঝে মাঝে তীব্র যন্ত্রণা হয়। জ্বালা-পোড়া করে। চুলকায়। বললেন, আমার তৎকালীন কর্মস্থল যুগান্তর ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার সহযোগিতা করেছেন। শেখ হাসিনা উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন প্রয়োজন নেই। ঢাকাতেই অপারেশন করে আরো অর্ধ শতাধিক স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে। এখনো অর্ধশত স্প্লিন্টার শরীরে আছে বলে ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। তবে তা শরীরের জন্য মারাত্মক কোনো ঝুঁকি নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ভয়ঙ্কর দিনের দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। সেই সঙ্গে ভয়াবহ শব্দভীতি কাজ করে। বললেন, ‘ভয়াবহ ঘটনা মনে পড়লে আবেগ সংবরণ করতে পারি না। যে কোনো আওয়াজে আঁতকে ওঠি। তবুও রক্তাক্ত হামলায় বেঁচে আছি এটিই হাজার শুকরিয়া।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App