×

সাময়িকী

বাবলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৭:৪৯ পিএম

বাবলি

স্যার, এটা ঠিক আপনি অংকের সাগর- কবিতা-টবিতা কি পড়েন? কখনো কবিতা লিখেছেন? মিষ্টি প্রেমের কবিতা? আমাদের এলাকায় দু’জন কবির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে : কবি মোহাম্মদ শাহজাহান এবং কবি হবিবুল বাহার। দু’জনের একজন শুদ্ধভাষার কবি অন্যজন পল্লীকবি- কবিয়াল হবিবুল বাহার। তবে শুদ্ধভাষার কবি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মতো একজন সার্টিফিকেট জোগাড় করা, অন্যজন কবিতা জোগাড় করা। তবে সার্টিফিকেট জোগাড় করার কাজটা সহজ ছিল। কবিতা জোগাড় করতে গেলে নিজের ভেতর কিছু কবিত্ব থাকতে হয়- নতুবা কোন লাইনগুলো তার দরকার বুঝবে কেমন করে। মোহাম্মদ শাহজাহান আলেয়া নামের যে মেয়েটিকে ভালোবাসতেন তাকে আলেয়ার মতো ফসকে যেতে না দিয়ে নাম বদলে ফেললেন। তার নাম রাখলেন মমতাজ। তারপর মমতাজকে নিয়ে যে কবিতা লিখলেন তাতো আমাদের ঘরে ঘরে লাল-নীল সুতোয় কুর্শি কাঁটায় কাপড়ে লেখা; বাধাই হয়ে বেড়ায়, দেয়ালে ও বাসরঘরে ঝুলছে : তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ কি তার প্রাণ অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরে শাহজাহান। এই কবিতা পেয়ে আলেয়া ওরফে মমতাজ মোহাম্মদ শাহজাহানের কাব্য প্রতিভায় যত মুগ্ধই হোক না কেন, আমাদের পুরনো ক্লাজ টেনের উঠতি কবি আহসানউল্লাহ সরকার জনে জনে বলে বেড়িয়েছে এটা চোরাই কবিতা, এ কবিতা মোহাম্মদ শাহজাহানের লেখা নয়। এ কবিতার লাইনগুলো কাজী নজরুল ইসলামের বই থেকে মেরে দেওয়া। আহসানউল্লাহ উপজেলা সদরে গিয়ে সেখানকার ভালো মেশিনে নজরুলের নারী কবিতার চল্লিশ কপি ফটোকপি করে এই দুটি লাইন মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে বিতরণ করেছে। কেউ বলেছে, তাই নাকি, শালা তো দেখছি আস্ত চোর; কেউ বলেছে চোর হলেও চেয়ারম্যান-মেম্বারের চেয়ে তো ভালো- গরিবের চাল-গম তো আর চুরি করে না, কেউ কাগজ হাতে নিয়ে ছিঁড়ে চার টুকরো করে তারই উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছে, তোর নিজের পড়াশোনা নেই? তবে তার তৎপরতায় ব্যথিত হয়েছেন কবি মোহাম্মদ শাহজাহান। তিনি তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে চল্লিশ কপি ফটোকপির খরচের টাকা ফিরিয়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি আলেয়া ওরফে মমতাজের দৃষ্টিতে না আনার অনুরোধ করেন। আহসানউল্লাহ সরকার তাতে আরো উৎসাহিত হয়ে একজন কবিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার করতে মূল কাব্যগ্রন্থ ও একটি ফটোকপিসহ তার কাছে হাজির হয়। নব্য মমতাজ মহল এই চৌর্যবৃত্তি দেখে হতবাক হবার বদলে আহসানউল্লাহকে বলল, পারলে তুইও চুরি করে আমার নামে এর চেয়ে ভালো চারটা লাইন লিখে নিয়ে আয়। দেখি তুই কেমন কেমন কবি! কবিদের দুঃখ দিতে নেই- এটা জেনেও মমতাজ কবি আহসানউল্লাহ সরকারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে যথেষ্ট দুঃখ দিয়েছে। তার চেয়ে বেশি দুঃখ দিয়েছে কবি মোহাম্মদ শাহজাহানকে। কবিতার ক-ও জানেনা কৃষি বিভাগের এমন একজন ব্ল্যাক সুপারভাইজানকে বিয়ে করে। ভালোবাসা ও বিচ্ছেদ দুটোতে কবির প্রেরণা। সাধারণ বইপত্রে পাওয়া যাবে না এমন কয়েকটি বিরহের চোরাই পঙ্ক্তি তার নামে প্রচারিত হতে থাকে : হয়তো তোমার দেশে আজ এসেছে মাধবী রাতি তুমি জোছনায় জাগিছ নিশি সাথে লয়ে নতুন সাথী সেথা মোর দ্বীপ নেভা রাতে নিদ নাহি দুটি আঁখি পাতে প্রেম সে যে মরীচিকা হয়ে, এ জীবনে এই শুধু জানি। অনেক পরে আবিষ্কার করা হয় যে এগুলো মান্না দে’র গাওয়া গানের পঙ্ক্তি। কবিদের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা আমি জানি না- ছ্যাঁকা খাওয়ার পরও কবিদের কারো শিক্ষা হয় না। আবার প্রেমে পড়ার জন্য তারা আক্ পাক্ করতে থাকে এবং এক সময় একটি মেয়ে ধরাও দেয়। কবি মোহাম্মদ শাহজাহানের সাথে বড় বোন আলেয়ার বিশ্বাসঘাতকতার পাপ কিছুটা লাঘব করতে ছোট বোন সাহারা কবির ডাকে সাড়া দেয়। কবি যথারীতি তার নাম বদলে রাখে নূরজাহান এবং পাঠিয়ে দেয় তার লেখা নূরজাহান বন্দনা : নূরজাহান নূরজাহান সিন্ধু নদীতে ভেসে এলে মেঘলামতীর দেশে ইরানী গুলিস্তান। কবি আহসানউল্লাহ সরকার আবারও চল্লিশটা ফটোকপি এই পঙ্ক্তিমালা বিতরণ করে এবং জানায়, এগুলো নজরুল নীতির লাইন। মোহাম্মদ শাহজাহান লাইনগুলো নির্লজ্জের মতো মেরে দিয়েছে। ধ্যাৎ লজ্জা থাকলে আবার কেউ কবিতা লিখত নাকি? অবশ্য আমাকে নিয়ে কেউ কখনো কবিতা লিখেনি। লিখলে হয়তো এতটা কড়া কথা বলতাম না। কবি হবিবুল বাহার আমাদের লোকাল পোয়েট- বাংলায় যাকে বলা যায় স্থানীয় কবি। স্থানীয় কবিরা শুরুতে লাজুক থাকলেও একবার লজ্জা ভাঙার পর রীতিমতো বেহারায় পরিণত হয়। আমাদের হবিবুল বাহার কবিতায় প্লটের খোঁজে এবাড়ি ওবাড়ি ঢুঁ মারে, এটা ওটা যাই পায় চোখের নিমিষে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলে। এরকম চোরাই মালসহ দু’একবার ধরাও পড়েছে, ছাড়াও পেয়েছে। কিন্তু যেবার তার পকেট থেকে গোলাপী রঙের ব্র্যাসিয়ার উদ্ধার করা হয় তাকে গণপিটুনি দিয়ে ‘আর কখনো চুরি কবির না’Ñ এই দাসখত আদায় না করে ‘জীবনে আর কখনো কবিতা লিখিব না’ এই দাসখত আদায় হলো। গার্লস স্কুলের দেয়ালে সদ্য স্কুল ছুটি হওয়া ছাত্রীদের সামনে আমাদের মহল্লার বিচারকরা তাকে দিয়ে একশতবার লিখিয়ে নিয়েছে, ‘জীবনে আর কখনো কবিতা লিখিব না’। কিন্তু অন্যান্য কবি ও কবিদের প্রেমিকার মতো হবিবুল বাহারও কথা রাখেনি। তার কবিতা রচনার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেকের হাত-পা ধরেছেন। তাদের ক্ষমতা কম থাকায় তিনি স্থানীয় মাস্তান শাকির আলীর শরণাপন্ন হন। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যায় কি না তা বিবেচনার জন্য শাকির আলী তাকে নিয়ে একটি কবিতা রচনার হুকুম দিলে সরকার ভজা কবিদের মতো তখনই কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই কবিতা লেখা শেষ করে এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে গাঁটের পয়সা খরচ করে লেমিনেটেড করে তা শাকির আলীকে উপহার দেয়। থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে দেশের প্রধানমন্ত্রী বহু মানুষের সাথে তার জানাশোনা। এমনই তার কাব্যগুণ ফরমাস পেলে যাকে তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারে। আহা শাকির আলী খালি খালি লোকে মন্দ কয় লোকের কথা মিথ্যা কেবল সত্য কিছু নয় আহা শাকির আলী আহা শাকির আলী তালিবালি বোঝে নারী মন তাহার জন্য দেওয়ানা ওসি সাবের বোন আহা শাকির আলী আহা তাহার ভক্ত, অনুরক্ত কবি হবিবুল বাহার তাহার কাব্যচর্চার নিষেধাজ্ঞা করুন প্রত্যাহার আহা শাকির আলী। খুব ভালো কবিতা তাই না? সুর করে পড়তে পারলে আরো ভালো লাগে। তবে এই কবিতা প্রচারিত হবার পর ওসি সাহেব শাকির আলীকে দুদিন হাজতে ভরে রেখে তার বোনের নামে অপবাদ দেবার রাগ মিটিয়েছেন। হাজতমুক্ত হয়ে শাকির আলী বলেছে, প্রচুর পেটালেও তার কানে ধরেনি। কানে না ধরলে সম্মান, অক্ষুণ্ণই রয়ে যায়। তার উপর এই নির্যাতনের সংবাদ ওসি সাহেবের বোন রাহেলার কানেও পৌঁছার কথা। ওসি সাহেব চিরিরবন্দর বদলি হলেন। বিদায়ের সময় যখন তার গাড়ি ছেড়ে দেয় দেয় অবস্থা দেখা গেল তার বোন নিরুদ্দেশ। তবে একটা চিরকুট পাওয়া গেল, ‘ভাইজান, স্মরণ রাখিবেন নির্যাতন ভালোবাসা দমাইয়া রাখিতে পারে না। আমি শাকির আলীর সাথেই বাকি জীবন কাটাইব। কিন্তু আপনি যদি আমাদের বিচ্ছিন্ন করার কোনো ষড়যন্ত্র করেন, তাহা হইলে পাইবেন আমার মৃতদেহ। বিষও সঙ্গে রাখিয়াছি।’ অগত্যা অবাধ্য বোনকে স্থানীয় মাস্তানের জিম্মায় রেখে তিনি চিরিরবন্দর রওনা হলেন। কবি হবিবুল বাহার শাকির আলীর অনুমতি পেয়ে ‘প্রেমের হইল জয়’ নামের আরও একটি কবিতা লিখে ফেলল। তাতে বলা হয়েছে ওসি’র ডান্ডাবেড়ি কামান বন্দুক সব ফেল মেরেছে পাস করেছে প্রেম। কবি হবিবুল বাহার মূলত কবিই, চোর নয়- চোর হলে দামি জিনিস তুলে নিত- এ যাবত যা চুরি করেছে এর মধ্যে ব্র্যাসিয়ারটাই সবচেয়ে বেশি দামি। আমাদের হেড স্যার বলেছেন, এটা একটা রোগ- নাম ক্লিপটোম্যানিয়া। মানে চুরি করার বাতিক। এটা রাজনীতিবিদদের বরং বেশি থাকে, কবিদের বাতিক কমই। ‘গার্লস স্কুলের অংক স্যার’ও তার কবিতায় শিরোনাম হয়েছে। অংকের সাথে পংক ও কলঙ্কের মিল দেয়া হয়েছে। পরে কোনো সময় পুরো কবিতাটাই শুনিয়ে দেব।

কবিদের কথা আপাতত থাক। গত দু’বছরে আমরা তিনজন অংক স্যারকে হারিয়েছি। কাইয়ুম স্যার সবচেয়ে বেশি- এক বছর তিন মাস টিকেছিলেন। ওসমান গনি স্যার সাড়ে সাত মাস আর আহসানুল হক স্যার মাত্র দেড় মাস। আগে ওসমান গনি স্যারের কথা বলি। দেখতে অনেকটা আমীর খানের মতো বোকা বোকা। স্যার আমাদের মানে পুরাতন দশম শ্রেণির থার্ড গার্ল কুসুমকলিকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। কুসুমকলির দিকে বাংলা স্যারেরও নজর ছিল। তিনি তাকে প্রাচীন বাংলা প্রেমের কবিতা নামের একটি দেড়শ পৃষ্ঠার বই উপহারও দিয়েছেন। এমনকি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ধবধবে সাদা টি-শার্ট পরেও স্কুলে এসেছেন। কাজ হয়নি। সংখ্যার কাছে অক্ষর শব্দ বাক্য হার মানে। নিরুদ্দিষ্ট ওসমান গনি স্যারের আর হদিস মেলেনি। কানে অনেক কথা এসেছে। শ্যুটার বাচ্চু কাউকে ছেড়ে দেবার লোক নন। শুট করে আকাশে গোত্তা মারা উড়ন্ত পাখি নামিয়ে আনতে পারেন। টার্গেট একবার বলে দিলেই হয় আর ফিফটি পার্সেন্ট অ্যাডভান্স। কর্ম হাসিল। এ জন্য সবাই ডাকে শ্যুটার বাচ্চু। যেসব কথা কানে এসেছে তার কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে আমি বলতে পারব না। কিন্তু যে সত্যটি জোর দিয়ে বলতে পারব তা হচ্ছে ওসমান গনি স্যার নেই, নেই আমার ক্লাসমেট, আমাদের থার্ড গার্ল কোকিলকণ্ঠী কুসুমকলিও। শুনেছি স্যার যখন কুসুমকে নিয়ে পালাচ্ছেন শ্যুটার বাচ্চুর চেলারা মাঝপথে ধরে ফেলে। মেয়েকে জনমের শিক্ষা দেবার জন্য বাচ্চু মিয়া মেয়ের সামনে ওসমান গনিকে সদ্য খোঁড়া একটি গর্তে ফেলে দেন। বন্দুকের মুখে সেই গর্তে মাটি ফেলতে কুসুমকেই বাধ্য করেন। চারদিক থেকে মাটি পড়ছে, একটা দুটো করে অশ্রুভেজা মাটির টুকরো কুসুমও ফেলছে, শরীরের অর্ধেক তখন মাটির নিচে। তিনি ফ্যালফ্যাল করে কুসুমকলির দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ কুসুম সেই গর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লে ওসমান গনি স্যারই তাকে ঠেলে উপরে উঠাতে চেষ্টা করেন। চেলারা তার হাত ধরে হেঁচকা টানে যখন উপরে তোলে, কুসুম তখন অজ্ঞান। ওসমান গনি স্যারের মাটিচাপা পড়ার মর্মবিদারক শেষ দৃশ্য তার আর দেখা হয়নি। মাটিচাপা পড়া ওসমান গনি পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার সঙ্গে সমাহিত হয় জটিল সব পাটিগণিত ও অ্যালজেব্রা করার কৌশল, শব্দের বদলে অংক দিয়ে ছাত্রীর মন জয় করার দুর্লভ গুণ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App