×

সাময়িকী

দৃশ্যকলার একলা পথিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৯:৫২ পিএম

দৃশ্যকলার একলা পথিক

ছবি আঁকায় মগ্ন মুর্তজা বশীর।

ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়েছেন ১৯৫৪ সালে, জয়নুল-কামরুলের কাছ থেকে যেটি অর্জন করেছেন তার মধ্যে ছিল প্রখর শক্তিশালী ড্রয়িং এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি। শিল্প-ইতিহাস ও নন্দনতত্ত্বের প্রতি তাঁর আগ্রহ আজীবন অটুট থেকেছে। এটি তাঁকে সৃজনকর্মেও একটি ইতিহাস-সচেতন অনুসন্ধানীর দৃষ্টি দান করেছে।

পরিণত বয়সে চলে গেলেন আমাদের দৃশ্যকলা জগতের পঞ্চাশের দশকের শেষ প্রতিনিধি মুর্তজা বশীর। সমাপ্তি ঘটলো আমাদের চারুশিল্প ইতিহাসের একটি সুবর্ণ অধ্যায়ের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক সহকর্মী হিসেবে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর শিল্পভাবনা ও জীবনদর্শনকে জানবার সুযোগ ঘটেছিল। এই ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষাপটে একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের একজন মানুষ হিসেবে মুর্তজা বশীর সম্পর্কে আমার ধারণা খানিকটা ব্যক্ত করতে পারি।

তাঁকে দেখেছি কিছুটা দুর্বিনীত, অননুমেয় মেজাজের, আত্মসচেতন, কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক রূপে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল তুঙ্গ স্পর্শ করবার অপরিসীম আকাক্সক্ষা, সদা-সক্রিয় উন্মুখ মন। তাঁর শিল্পকলার জগৎ গড়ে উঠেছে এ উভয়বিধ মানসিকতার সংশ্লেষ ও সংঘাতে। বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিসরে মুর্তজা বশীর এখন অপরিহার্য ও অবশ্য-উল্লেখ্য নাম। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর সদ্য বিকাশমান এই অঞ্চলের দ্বিধাগ্রস্ত শিল্পকলাকে যাঁরা পর্যাপ্ত আস্থা ও উপাদান যুগিয়েছেন তিনি অবশ্যই তাঁদের অন্যতম। দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন শাখায় যেমন বিচরণ করেছেন তিনি তেমনি শিল্পকলার অন্য দুটি মাধ্যম, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও, রেখেছেন সৃজন-প্রতিভার স্বাক্ষর।

ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়েছেন ১৯৫৪ সালে, জয়নুল-কামরুলের কাছ থেকে যেটি অর্জন করেছেন তার মধ্যে ছিল প্রখর শক্তিশালী ড্রয়িং এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি। শিল্প-ইতিহাস ও নন্দনতত্তে্বর প্রতি তাঁর আগ্রহ আজীবন অটুট থেকেছে। এটি তাঁকে সৃজনকর্মেও একটি ইতিহাস-সচেতন অনুসন্ধানীর দৃষ্টি দান করেছে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮-তে শিক্ষা লাভ করেছেন ইতালিতে। পাশ্চাত্য শিক্ষা তাঁকে দান করেছে চিত্রে দ্বিমাত্রিকতা সম্পর্কে, চিত্রের গঠন ও জ্যামিতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান, বিষয়কে ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা থেকে দ্বিমাত্রিক চিত্রতলে সংহত করবার কৌশল ও শৈলী। মোজাইক ও ছাপচিত্র শিখেছেন প্যারিসে ১৯৭১-১৯৭৩ সময়ে।

প্রথমদিকে পরস্পর-ছেদযুক্ত রেখা দ্বারা চিত্রতলে একটি দৃঢ় কাঠামো নির্মাণ ও বিভিন্ন গতিপথ নির্দেশের দ্বারা দর্শকের দৃষ্টিকে চালিত করার দিকে তাঁর প্রয়াস লক্ষ করা যায়। জ্যামিতি ও গঠনের প্রতি এই পরিকল্পিত মনোযোগ তাঁর সৃষ্টির প্রাণহরণ করতে পারেনি। খুব সম্ভবত এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এদের অতি শক্তিশালী ও মনোহর ড্রয়িং। ১৯৬৯ হতে ১৯৭০ পর্যন্ত মুর্তজা বশীর যাপন করেছেন এক যাযাবর শিল্পীর জীবন। এক অস্থির জীবন-তৃষ্ণায় তিনি এ সময়ে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢাকা, করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিণ্ডি, সারগোদা। সংস্পর্শে এসেছেন শিল্প-সাহিত্যজগতের তাবৎ খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের। নিজেও সৃজনশীলতার একটি ক্ষেত্র থেকে আর একটি ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এ সময়ে তিনি যুক্ত হয়েছেন ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে, নাটকের মঞ্চ-নির্দেশনার সঙ্গে, সর্বোপরি রচনা করেছেন গল্পগ্রন্থ যা তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই চিহ্নিত করেছে এক শক্তিমান গদ্যলেখক হিসেবে। চিত্রকর হিসেবেও এই সময়ে তিনি অতিক্রম করেছেন তাঁর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য পর্যায়।

১৯৬০ সাল থেকে লাহোরে বসে আঁকা তাঁর ছবিতে দেখি সব প্রচলিত সৌন্দর্যবোধকে দলিত করে একটি প্রচণ্ড ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে ক্যানভাসে মূর্ত করবার আকুতি। জ্যামিতিক পরিমাপ ও পরিশীলিত ড্রয়িংয়ের জায়গায় ক্ষুব্ধ ও কম্পমান ভঙ্গুর রেখা, প্রশান্ত ও স্নিগ্ধ রঙের স্থলে পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত চিৎকৃত রঙ, মসৃণ ক্যানভাসের বদলে পুঞ্জ পুঞ্জ টেক্সচার। সমস্তটা মিলে এক ভয়াবহ সময়ের ছিন্ন মুখোশের তলায় লুকানো ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের চেহারা। ১৯৬৭-৭২ সময়কালে আঁকা তাঁর দেয়াল শীর্ষক চিত্রমালায় প্রতীকায়িত হয়েছে বন্দি মানুষের চারদিকে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর। নিষেধের ঘেরাটোপে আবদ্ধ মানুষের আত্মার আকুতি প্রতিফলিত হয়েছে ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালের দাঁত বের করা ইটে, খসে যাওয়া পলেস্তরায়, শ্যাওলা ধরা মলিনতায়, অমসৃণ টেক্সচারের কর্কশ অনুভবে। মুর্তজা বশীরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিরিজ কাজ হচ্ছে ১৯৭৫ থেকে আঁকা এপিটাফ ফর দি মারটায়ার্স- মুক্তিযুদ্ধে নিহত নাম না জানা শহীদদের উদ্দেশে নিবেদিত চিত্রমালা। সাদা পটভ‚মিতে বিভিন্ন আকৃতির ভাসমান ফর্ম, ভিতরের আকৃতিসমূহ বিভিন্ন মোলায়েম রঙের সূক্ষ্মপর্দায় পরস্পর-বিলীয়মান। এখানে আকৃতি ও রঙের ব্যবহার নম্র ও কমনীয়, সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে টেক্সচার।

পরবর্তীকালে তাঁর মধ্যে শিল্পকলায় দেশজ প্রেক্ষাপটকে প্রকাশের যে আকুতি পরিদৃশ্যমান হচ্ছিল, ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তাঁর যে গবেষক-প্রতিম আগ্রহ, এবং বিষয় হিসেরে পুনরায় মূর্ত মানবের যে আবির্ভাব তাঁর ক্যানভাসে দেখা দিতে শুরু করেছিল- মনে হয় এগুলিই সংহত রূপ লাভ করে মুর্তজা বশীরের হাতে নতুন পরিপ্রেক্ষিত লাভ করবার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। যে কর্মস্পৃহা এবং অভিনব পথে যাত্রার আগ্রহ মুর্তজা বশীরের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সে বৈশিষ্ট্যই তাঁকে নতুন একটি সৃজনশৈলী নির্মাণে সক্ষম করে তুলবে এমনটি আশা করা গিয়েছিল, মৃত্যু এসে সে প্রত্যাশায় যবনিকা টেনে দিল। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দেয়ালচিত্র করেছেন মুর্তজা বশীর। এর মধ্যে ১৯৬৯-এ ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবনে তেলরঙে করা মুদ্রার বিবর্তন এবং ১৯৭৪-এ রাজশাহী-বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ঝামাইটের টুকরোয় করা মোজাইক শহীদ বৃক্ষ শৈল্পিক সৌন্দর্যে আর দেশীয় উপকরণ ব্যবহারের অভিনবত্বে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।

মৃত্যুর আগে মাস ছয়েক আগে যখন শেষ দেখা হয়েছিল তখনো ৮৭ বছরের মানুষটি, যিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া চলতে পারেন না, ছবি আঁকা নিয়ে তাঁর নানান ভাবনা ও প্রস্তুতির কথা বলছিলেন। এরকম ইতিবাচক মানসিক শক্তির অধিকারী মানুষ আমি আর দেখিনি। তাঁর বিদায়ে আমাদের দৃশ্যকলার জগৎ অনেকটাই বর্ণ হারালো। প্রয়াত শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App