×

সাময়িকী

আব্বুর জীবনযাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৯:২৬ পিএম

আব্বুর জীবনযাপন

মুর্তজা বশীর ও তাঁর মেয়ে মুনিজা বশীর

দাঁড়ান, সাক্ষাৎকারের সময় সকাল ১০টা থেকে ১১টা, বিকাল ৪টা থেকে ৫টা’... লেখাটা পড়লে মনে হবে কোনো ডাক্তারের চেম্বারে রোগী দেখার সময়সূচি। আসলে তা নয়, আমাদের চট্টেশ্বরী রোডের এনেসেল ম্যানসনের ফ্ল্যাট নং ৫-এ আব্বুর রুমের দরজায় এই কথাটিই লেখা ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে আব্বু খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতেন। ওনার মধ্যে এক ধরনের সম্মোহনী শক্তি ছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উনি বলে যেতেন আর অন্যরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো। আমরা তিন ভাই-বোন সবসময় আব্বুর পছন্দটাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমার খুব শখ ছিল ফাইন আর্টস পড়বো, ছবিও আঁকতাম মোটামুটি ভালোই আঁকতাম। চুরি করে আব্বুর ক্যানভাসে অনেক ছবি এঁকেছি। কিন্তু আব্বু বললেন, বিবিএ পড়ো। বললেন, আর্টিস্টের জীবন অনেক কষ্টের, অনেক struggle করতে হয়। আমি পিতা হয়ে সন্তানের কষ্ট দেখতে পারবো না। ব্যস, আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল। আমি ব্যাংকার হয়ে গেলাম। আব্বু ছিলেন আমাদের বন্ধুর মতো। আত্মকেন্দ্রিক, প্রচারবিমুখ আব্বু সবসময় তাঁর পরিবারকে সময় দিয়েছেন শতভাগ। আব্বু নিয়মিত ছবি আঁকতেন না। কিন্তু একবার যদি আঁকা শুরু করতেন, তাহলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে এঁকেই যেতেন। বলতেন, ছবি আঁকা কি রান্না করা? ইচ্ছে করলেই আঁকা যায় না। মন থেকে আসতে হয়। তাঁর ছিল অনুসন্ধিৎসু মন, জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। আমাদের বাসায় আব্বুর বিশাল লাইব্রেরি আছে। আলমারিতে থরে থরে সাজানো বই। আব্বুর শখের কমতি ছিল না। পুরাতন মুদ্রা, কারেন্সি নোট, স্ট্যাম্প, দিয়াশলাইয়ের বক্সের দুর্লভ কালেকশন আছে আব্বুর। ভীষণ রকমের আত্মনির্ভরশীল ছিলেন তিনি। আমার মনে পড়ে ছোটকালে আমরা যখন রমজানের লম্বা ছুটিতে ঢাকা যেতাম, তখন কখনই আম্মাকে দেখিনি আব্বুর জন্য রান্না করে রেখে যেতে। তিনি নিজেই রান্না করে খেয়ে নিতেন। আম্মাকে কখনো দেখিনি আব্বুর কাপড়ের আলমারি কিংবা বইপত্র গুছিয়ে দিতে, আব্বু পছন্দ করতেন না। নিজের সব কিছু তিনি নিজেই গোছাতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনি ওনার নিজের ওষুধ নিজেই গুছিয়েছেন। কখন কোন ওষুধ খেতে হবে, ডোজ কি ওনার সব মুখস্ত ছিল। প্রতি সপ্তাহে ওষুধের ছোট বক্সে উনি সারাদিনের ওষুধ গুছিয়ে রাখতেন। প্রতিবেলার ওষুধ উনি সময় করে খেতেন। সংসারের খুব ছোট জিনিস ওনার নজর এড়াতো না। আমার বিয়ের আগে আমার টুথব্রাশ নষ্ট হওয়ার আগে উনি ব্রাশ হোল্ডারে নতুন ব্রাশ রেখে দিতেন। বিয়ের পর এই অভ্যাসটা গড়তে আমার বেশ সময় লেগেছিল। ছোট ছোট নগণ্য যে কোনো জিনিস ওনার কাছে মূল্যবান ছিল। ওষুধের টিউবের মুখ, শেষ হয়ে যাওয়া টুথপেস্টের ক্যাপ, দড়ি, উনি সযতনে রেখে দিতেন, বলতেন কখন কি কাজে লাগে বলা তো যায় না। তিনি ছিলেন একজন প্রেমময় স্বামী আর দায়িত্বশীল পিতা। ২০১৪ থেকে শুরু করে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমার অসুস্থ আম্মাকে তিনি ক্লান্তিহীনভাবে সেবা করে গিয়েছেন। আম্মার মৃত্যুর পর প্রতি শুক্রবার উনি আম্মার কবর জেয়ারত করতে বনানী কবরস্থানে যেতেন। কিন্তু বর্তমানে করোনার জন্য উনি যেতে পারতেন না বলে ওনার আক্ষেপের শেষ ছিল না। আমাদের তিন ভাই বোনের জন্মদিন, জামাতা, পুত্রবধূ, নাতিদের জন্মদিন, আমাদের বিয়ে বার্ষিকী, ঈদ সবকিছুতে আব্বু সবাইকে ২ হাজার টাকা করে দিতেন। ফেসবুকে সুন্দর করে শুভেচ্ছা জানাতেন। যখন ফেসবুক ছিল না তখন কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতেন। আমি যতবার ঢাকায় যেতাম ততবার আমাকে, আমার ছেলেদের ১০০০ টাকা করে দিতেন। আমি যদি টাকা না নিতে চাইতাম, তখন বলতেন, যতদিন পারি দেই, আমি মরে গেলে তো আর পাবি না। আব্বুর পাখি খুব পছন্দ ছিল। আমরা যখন এনেসেল ম্যানসনের বাসায় থাকতাম, তখন আব্বু টিয়া পাখি, ময়না পাখি, কবুতর পালতো। আব্বু বলতো, আমি মানুষ হয়ে না জন্মে পাখি হয়ে জন্মালে ভালো হতো। আমি উড়তে চাই, কিন্তু আমার ডানা নেই। আমার পাখি হতে চাওয়া আব্বু, জন্মদিনের দুদিন আগে ১৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে সত্যি সত্যি উড়ে চলে গেল। আব্বুর এভাবে চলে যাওয়াটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেননা, তিনি অসুস্থ ছিলেন, অনেক অসুস্থ, কিন্তু তাঁর মনোবল তাঁকে সবসময় উজ্জীবিত রাখতো। এর আগে বহুবার তিনি হসপিটালে গেছেন, সপ্তাহ খানেক পর আবার ফিরে এসেছেন। ভেবেছিলাম, এবারো তাই হবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি চিরতরে চলে গেলেন। আপনারা সবাই আমার আব্বুর জন্য দোয়া করবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App