×

সাময়িকী

অভিনব যাত্রিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৯:৩৭ পিএম

অভিনব যাত্রিক

বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে মুর্তজা বশীর সবচে’ বেশিবার নিজেকে এঁকেছেন। স্বরূপ অন্বেষার জন্য আত্মপ্রতিকৃতি রচনার এমন নিদর্শন আরও দেখা যায় রেমব্রান্ডট, ভ্যানগগ ও ফ্রিদা কালোর শিল্পসাধনায়। কেন মুর্তজা বশীর বছর কয়েক পর পরই নিজেকে এঁকেছেন? এর সহজ উত্তর হয়তো হবে কালের পটে জীবনের কী বিবর্তন হলো তা চিত্রপটে এঁকে নিজেকে জানা, বোঝা। কেন জীবনের বৃত্তান্ত অবয়ব-মানচিত্রেই সবচে’ বেশি পরিস্ফুট। শিল্পী বশীর বারবার নিজেকে ভেঙেছেন। অভিনবত্ব যুক্ত করতে চেয়েছেন শিল্পরচনায়। তাই আমরা তাঁর কাজে একই ভাষার শোধন-বিশোধন দেখি না। বিষয় ও ভাষা পরিবর্তন করে সৃজনের অভিযানে গিয়ে নতুন দেশ আবিষ্কারই ছিল তার দীর্ঘ শিল্পীজীবনের সাধনা। এই মনোভঙ্গিই কাজ করেছে বুঝি শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি রচনায়ও। সর্বধর্মে শ্রদ্ধাশীল জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর পিতা। বাঙালির সংস্কৃতির মধ্যে অহিংস চেতনাই যে মূল চালিকাশক্তি এ কথা পরম জেনে যারা অকুণ্ঠে সোচ্চার হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তাই পরিবারের পরিধির মধ্যে সংকীর্ণতার অন্ধকার বাসা বাঁধতে পারেনি। তবে এ পরিবারে কেউই ছবি আঁকতেন না। মুর্তজা বশীরের মধ্যেও শৈশব-কৈশোরে ছবি আঁকার আগ্রহ লক্ষ করা যায়নি। তবে রাজনৈতিক আদর্শ তাকে অধীর করে তোলে জীবনের তরুণ দিনে। সাম্যবাদী রাজনীতির আদর্শ তাঁকে বিপ্লবীর মতো সাহসী করে তোলে। তিনি দেয়ালে প্রতিবাদের বাণী লেখেন; পোস্টার সাঁটান। গ্রেপ্তার হন এবং পুলিশি নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাঁকে। ওই চৈতন্যের ধারে তাঁর এতটুকু মরচে ধরেনি যখন তিনি শিল্পী হওয়ার তাগিদে আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন। শিক্ষার্থী জীবনে তিনি প্রান্তজনের জীবন আঁকার মধ্য দিয়ে নিজের সাম্যবাদী চেতনা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। মুর্তজা বশীর ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠিত ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। প্রথম ব্যাচের শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র আমিনুল ইসলামই তাঁর সাধনায় নিরীক্ষানিষ্ঠ থেকেছেন। তবে বশীরের সহপাঠীদের মধ্যে অনেকেই আমাদের দেশের বিখ্যাত শিল্পী। কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ বশীরের সতীর্থ। ছবি-আঁকার শুরু থেকেই বশীর পথবাসী মানুষের জীবন বিশেষ স্বচ্ছতায় আঁকতে শুরু করেন। প্রত্যক্ষভাবে জীবন পর্যবেক্ষণ করে বিরামহীন চর্চার ফলে তাঁর কব্জিতে যুক্ত হয় বিশেষ দক্ষতা এবং রেখাধর্মী কাজে তাঁর পারমিতা বিশেষভাবে দেখার বিষয় হয়ে ওঠে। শুধু রেখায় নয়, বর্ণযোজনাতেও ছেঁড়া-খোড়া, কালি-ঝুলিমাখা হতদরিদ্রই ছিল তাঁর ছবির বিষয়। শিল্পী মুর্তজা বশীর যদি এই রেখাধর্মী কাজ এবং রেনেসাঁপ্রসূত ব্যাকরণ অনুসরণে বাস্তববাদী শৈলীতে চিত্র রচনায় সাধনামগ্ন থাকতেন তাহলেও তিনি এ দেশের প্রথম সারির শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকতেন। কিন্তু বশীর তাতে তুষ্ট থাকলেন না। যদিও তিনি ’৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছেন, সহযোদ্ধা শহীদ বরকতের গুলিবিদ্ধ লাশ বহনকারীদের সঙ্গে ছিলেন, তবুও তিনি স্বপ্ন দেখলেন ইউরোপে গিয়ে আধুনিকতার নিরীক্ষায় মনোনিবেশের। ইতালির ফ্লোরেন্সে এবং পরে ফ্রান্সের প্যারিসে তিনি দুটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন। ফ্লোরেন্সের জীবনে বশীরের চেতনার রূপান্তর ঘটে। তিনি ইতালিতে থাকা সত্তে¡ও আর রেনেসাঁর আদর্শ ধরে আর ছবি আঁকলেন না। এখানে তিনি মানুষের দেহের নগ্নরূপ পাঠ করার সুযোগ পান। এই সুযোগে তিনি অধীত ড্রইংদক্ষতা নতুন করে কাজে লাগান। ললিত রেখায় তিনি নারীকে আঁকেন, আঁকেন পুরুষের দৃঢ়তর সুঠাম দেহও। আর ছবি যে পরিণামে আকারেরই বিচিত্র তা তিনি জ্যামিতিক হিসেবে বুঝতে চাইলেন। স্পেস ভাগ করলেন নতুন ছকে। দ্বিমাত্রিক পটে কোনো ত্রিমাত্রিকতার বিভ্রম সৃষ্টি না করেই তিনি তলের সঙ্গে তলের সংযোগে আঁকলেন ইতালির মানুষের জীবন। মাতিসের ডিজাইন-রীতি নয়, এমনকি প্রাচ্যের দ্বিমাত্রিক পটচিত্রের ভাষাও নয়, শিল্পী বশীর উদ্ভাবন করলেন নতুন রীতি। ’৫০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ষাটের গোড়ার দিকের কয়েক বছর পর্যন্ত শিল্পী এ ভাষাতে আশ্চর্য ফসল ফালিয়েছেন। বশীর যদি এ পথেই আমৃত্যু পরিশ্রুত হয়ে চলতে থাকতেন তাহলেও তিনি এ দেশের সর্বাগ্রণ্য শিল্পীদের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। কিন্তু এক নৈঃসঙ্গ চেতনায় কাতর হলো শিল্পীর হৃদয়। তিনি আর তাঁর সামনে শুধু দেয়াল, কী এক স্বেচ্ছাবন্দিত্ব তাঁকে আক্রান্ত করল যেন। তিনি আত্মদর্শন করলেন পলেস্তারা-খসে-যাওয়া, নোনা-ধরা দেয়ালের ফাটলে। তাঁর ‘দেয়াল’ সিরিজে অস্তিত্ববাদী বোধের সংক্রমণ আছে; তবে এই নিরীক্ষার শেষের দিকে তিনি আবার সংগঠিত হন এবং আমরা দেখতে পাই দেয়ালে ইটের গাঁথুনি সুসহিত সুন্দর হয়ে উঠেছে। ওই দেয়াল সিরিজ আঁকতে গিয়ে বশীর আণুবীক্ষণিক হলেন। আতশকাচের ভেতর দিয়ে বস্তুর গভীরের আন্তর-রূপ তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। এই নিরীক্ষণের ফলে বিপ্লবী বশীর ক্রমান্বয়ে মরমীভুবনের বাসিন্দা হলেন। চিত্রিত করলেন তিনি ’৭১-এর শহীদদের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ। পাথরের ভেতরে যে সংগুপ্ত রয়েছে অচেনা রূপ ও রেখার বিন্যাস তা-ই তিনি ছবিতে তুলে ধরলেন। নাম দিলেন ‘এপিটাফ’। কোনো চোখচেনা রূপ নেই এ পর্বের ছবিতে। তাই শিল্পবোদ্ধারা এ ধারার ছবিকে যখন বিমূর্ত রীতি বলে আখ্যায়িত করলেন, শিল্পীর কাছে তা গ্রাহ্য হলো না। তিনি বললেন যে এটা তো একান্তই বাস্তব। তিনি শুধু আতশকাচের ভেতর দিয়ে পাথরের রূপ অবলোকন করার অভিজ্ঞতাকে শিল্পের পরিমার্জনা দিয়েছেন। তারপর মসজিদের স্থাপত্যের নকশা, কলেমা তাইয়্যেবা সিরিজ, রঙিন প্রজাপতির ডানা- এমনই নিরীক্ষায় নিবিষ্ট রইলের শিল্পী বশীর। ওই আতশকাচেই তিনি পাঠ করলেন হাবসী সুলতানদের মুদ্রা এবং রচনা করলেন ইতিহাসের তথ্য প্রকীর্ণ প্রবন্ধ। ভ্রমণ তাঁর অব্যাহত রইল ইতিহাসের পথে। বাংলার টেরাকোটা শিল্প হলো তাঁর গবেষণার বিষয়। পোড়ামাটি শিল্পেই তো বাংলার সভ্যতার সবচে’ মর্মস্পর্শী শৈল্পিক সাক্ষ্য। শিল্পী মুর্তজা বশীর এক অভিনব যাত্রিক। তিনি বারবার নিজের শিল্পভাষার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন নতুন সোধের উন্মীলনের তাগিদে। প্রেমে পড়েছেন নানা মাধ্যমের। ছবি আঁকা শুধু নয়, নয় শুধু মুদ্রা-গবেষণা বা টেরাকোটার একনিষ্ঠ সভ্যতার সূত্র অন্বেষণ, তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, শিল্পনির্দেশনাও দিয়েছেন। মুর্তজা বশীর একাই অজস্র রঙের শিল্পকুসুমের বাগান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App