×

সারাদেশ

রাজাকারের বাবার নামে বাজারের নামকরণে প্রশাসন!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২০, ০৫:১৬ পিএম

রাজাকারের বাবার নামে বাজারের নামকরণে প্রশাসন!

ছবি: প্রতিনিধি

যশোরের চৌগাছার সদর ইউনিয়নে রাজাকারের পিতা ও স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে পরিচিত আহমদ আলীর নিয়ে একটি বাজারের ( প্রকৃত নাম কড়ইতলা বাজার। সাইন বোর্ডে আহমদ নগর বাজার) নামফলকে “বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসন” লেখা দেখে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বুধবার (১৯ আগস্ট) বিভিন্ন সংবাদপত্রে রাজাকারের পিতা ও পিস কমিটির সদস্যের নামে বাজারের নামকরণের ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে মানববন্ধনের সংবাদ প্রকাশিত হলে এদিন সকালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাজারটি পরিদর্শন করেন। সেখানে তারা সাইনবোর্ডের লেখা দেখে ক্ষুদ্ধ হন।

এ বিষয়ে চৌগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার ৭১’র বীর সম্মুখযোদ্ধা ডা. নুর হোসেন বলেন, আহমদ আলী ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী একজন মুসলিম লীগের লোক। ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পিস কমিটির সদস্য। তার ছেলে এম মুজাহিদ আলী ওরফে চেন্টু ছিল একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী রাজাকার। উপজেলার রাজাকারের তালিকায় সে ৮ নম্বরে আছে। খুলনায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজাকার মুজাহিদ স্বাধীনতার পরে (সম্ভবত ১৯৭২ সাল) জেল খেটেছেন। তার পিতা এবং তার পরিবার স্বাধীনতা বিরোধী হয়েও কীভাবে সেই স্বাধীনতা বিরোধীর নামে একটি বাজারের নামকরণ হয় সেটি আমি বুঝলাম না।

৭১’র বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, মুজাহিদ আলী একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতকৃত তালিকায় ৮ নম্বরে থাকা এই রাজাকারের পরিবার স্বাধীনতা বিরোধী। তার নামে কীভাবে বাজারের নামকরণ হলো বুঝতে পারলাম না।

৭১’র মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) লিডার, রণাঙ্গনের সন্মুখযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জেল হোসেন রাগান্বিত কন্ঠে বলেন, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ চৌগাছা বাজার স্বাধীন করে (বর্তমান তহসিল অফিস) কালিতলায় বিকাল ৩টার সময় আমিই প্রথম আমার সঙ্গী যোদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করি। আমার আধা ঘন্টা পরে যশোরের সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুল মালেক মুজিব বাহিনীর আজিজকে নিয়ে চৌগাছা ডাক বাংলোতে পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। মুজাহিদ সম্বন্ধে জানতে চাইলেও তিনি বলেন, সে আমার স্কুল বন্ধু (ক্লাসফ্রেন্ড)। মুজাহিদ ছিল ট্রেনিংপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী রাজাকার। তার পিতা আহমদ আলী ছিলেন মুসলিম লীগার। সে সময় মুসলিম লীগাররা প্রায় সবাই ছিল পিস কমিটির সদস্য। আর এই পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন চৌগাছা উপজেলার কয়ারপাড়া গ্রামের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। সেই রাজাকারের বাপ, স্বাধীনতা বিরোধী একজন ব্যক্তির নামে কীভাবে একটি বাজারের নামকরণ হয়?

রণাঙ্গনের আর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামকে ফোন করলে উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, মুজাহিদ আমাদের তালিকায় একজন সশস্ত্র রাজাকার। তার পরিবারের কোনো লোক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। জিয়াউর রহমান যখন ছাত্রদলের কমিটি করেন, তখন মুজাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। মুজাহিদ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। সূর্যসেন হলে থাকাবস্থায় এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতা হওয়ায় সে তার আপন বড় ভাই শওকত আলীকে জিয়াউর রহমানের দিয়ে বিশেষ সুপারিশ করিয়ে স্কলারশিপে বিদেশে লেখাপড়া করতে পাঠায়। আর এই আহমদ আলী সাহিত্যরত্ন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল না। বরং তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে ছিলেন। পিস কমিটির সদস্যের নাম ঠিকানা আমাদের কাছে না থাকলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে তার গভীর আঁতাত ছিল।

আজ পর্যন্ত তাদের পরিবারের কোনো লোক স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। স্থানীয় মানুষজন ওই বাজারকে মুক্তিযোদ্ধা নগর বলে ঘোষণার সঙ্গে আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) একাত্মা ঘোষণা করছি। এই সত্য সংবাদ যেসব গণমাধ্যম কর্মীরা প্রকাশ করেছেন আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরো চৌগাছাতে কোনো মুক্তিযোদ্ধার নামে কোনো সড়ক বা বাজার বা কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকলেও একজন রাজাকারের পিতা যে কিনা নিজেই স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন তার নামে বাজারের নামকরণ হয় কীভাবে? সেই সাইন বোর্ডে আবার বাস্তবায়নের উপজেলা প্রশাসন লেখা তার মানে কি? তিনি বলেন, এই জন্যে কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম ? এই দিন দেখার জন্যে কি ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন ?

এ বিষয়ে উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম হাবিবুর রহমান ও আব্দুস সালাম চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী এনামুল হকের সঙ্গে কথা বলে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম।

মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী এনামুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি, তাতে অফিসিয়ালি এমন কোনো দলিল আমি পাইনি। সরকারি নির্দেশনা ছাড়া কোনো কিছুর নামকরণ করার এখতিয়ার কারো নেই। উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা এসেছিলেন। আমি তাদেরকে বলেছি, এ রকম কোনো সরকারি দলিল এখনও আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে কীভাবে উপজেলা প্রশাসনের কথা সাইন বোর্ডে লেখা হলো সেটি তদন্ত করে দেখছি। আগামীকাল সরজমিনে তদন্তে যাবেন বলেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং গনমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী এনামুল হক।

একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী রাজাকারের পিতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী একজন ব্যক্তিকে বিভিন্নভাবে বিষেশায়িত করে তার নামে বাজারের নামকরণের পক্ষে স্থানীয় কিছু গনমাধ্যম কর্মীদের কয়েকটি সংবাদকে ঘিরে উপজেলাতে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। হাসতে হাসতে অনেকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওই গনমাধ্যম কর্মীরা তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেও বেশি জানেন। না হলে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অস্ত্রধারী রাজাকারের পিতা ও স্বাধীনতা বিরোধী, কুখ্যাত পিস কমিটির একজন সদস্যের পক্ষে এভাবে সংবাদ প্রকাশ কেনো??

বাজারটির নাম “কড়ইতলা মুক্তিযোদ্ধা নগর” করার দাবিতে গ্রামবাসীর সঙ্গে উপজেলার সব মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App