×

জাতীয়

দেশে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি দুরাস্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২০, ০৮:৩৭ এএম

অদৃশ্য করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে মরিয়া পুরো বিশ্ব। করোনা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে ভ্যাকসিনের চলমান গবেষণা, উৎপাদন ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। বাংলাদেশ সবার আগে ভ্যাকসিন পাবে- বিভিন্ন সময় এমন দাবি করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বলছেন ভ্যাকসিন সবার আগে যেন বাংলাদেশ পায় সেটি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই কথাবার্তা আর মিটিংয়ের মধ্যেই আটকে আছে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির বিষয়টি। সেই সঙ্গে ঝুলে আছে দেশে চীনের উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ৩য় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়টিও।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হিসাব অনুসারে, এ পর্যন্ত ২০২টি ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২৭টি ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে আছে। এর মধ্যে রাশিয়া প্রথম ভ্যাকসিন প্রয়োগের ঘোষণা দেয়ায় বিশ^জুড়ে হইচই পড়ে গেছে। যদিও এ নিয়ে দেশটির মধ্যেই রয়েছে বিতর্ক। এর বাইরে ভ্যাকসিন তৈরির কাজে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে ব্রিটেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ৩ দেশের ভ্যাকসিনই পরীক্ষামূলক প্রয়োগের তৃতীয় পর্যায়ে আছে। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সময় সংক্ষেপ করে তাদের ভ্যাকসিন বাজারে আনতে চাইছে। এর মধ্যেই জানা যায় চীনের ভ্যাকসিনের পেটেন্ট করার অনুমোদন দেয় বেইজিং।

অনলাইনে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে বুধবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনার ভ্যাকসিন ট্রায়ালে থাকা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে অনেক দেশ। কিন্তু এই ভ্যাকসিন বুকিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। টিকা সংগ্রহে অর্থ বরাদ্দে কোনো সংকট হবে না বলেও জানান তিনি। আর বাংলাদেশের জন্য ভ্যাকসিন পেতে এরই মধ্যে রাশিয়াসহ ৪টি দেশের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠানো হচ্ছে বলে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

জানা যায়, ভ্যাকসিন সংক্রান্ত বিভিন্ন বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, বিষয়টি তার হাতে নেই। উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তের পরই এই বিষয়ে ফয়সালা হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানাসহ অন্য ভ্যাকসিন উদ্ভাবক কোম্পানিগুলো তাদের ভ্যাকসিন সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এসব ভ্যাকসিনের জন্য যে দেশ আগে থেকে অ্যাডভান্স করে রাখছে, তাদের আগে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে কোম্পানিগুলো। আমরাও এসব কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা কিংবা অ্যাডভান্স দেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এই বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই বৈঠকের বিষয়ে জানা যায়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিন উদ্ভাবক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো শুরুতে বিভিন্ন দেশের ৩ শতাংশ মানুষকে টিকা সরবরাহ করা এবং আগামী মার্চে তারা ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা সরবরাহের উদ্দেশ্যে কাজ করছে। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও।

এদিকে আগস্টের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন (টিকা) জোট গ্যাভি, বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ভারতের টিকা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও নোভাভ্যাক্সের করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ার পর সেগুলোর ১০ কোটি ডোজ তৈরি করে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশে সরবরাহ করা হবে। এই সরবরাহের দায়িত্বে থাকবে সিরাম ইনস্টিটিউট। সে জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার তহবিল দেবে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ডোজ ভ্যাকসিনের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ৩ ডলার এবং বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ২৫৪ টাকা।

আর চীনের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়ে যদি সিদ্ধান্ত হয়- এক্ষেত্রেও আগে থেকে কর্মপরিকল্পনা করে রাখা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন প্রাপ্তি এবং এর প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। সে জন্যই কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে কত মানুষের ওপর চীনের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে, এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশকে কত টাকা দেবে, পরীক্ষা হলে চীন কী শর্তে ভ্যাকসিন দেবে- সেসব নিয়ে সিদ্ধান্তের পর চীনকে পরীক্ষা করতে দেয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন পেলে কাদের ওপর তা প্রয়োগ করা হবে, ভ্যাকসিনের স্টোরেজ, ট্রান্সপোর্ট, কোন সিরিঞ্জের মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে- এসব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। সেসবের জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বিষয়টি টেকনিক্যাল। কিন্তু নাম না প্রকাশ করার শর্তে করোনার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কমিটির এক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা এসব বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু কাজ খুব বেশি এগোয়নি। চীনের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এটিও অনাকাক্সিক্ষত। কারণ এটি হলে ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে আমরা এগিয়ে থাকতাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সাইদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদনের পর একটা বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য আগাম বুকিং দিয়ে রাখছে। যা সমভাবে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের এক অধ্যাপক ভোরের কাগজকে বলেন, ভ্যাকসিনের আবিষ্কার, উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতির অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়ার আগেই ধনী দেশগুলো যেভাবে তাদের চাহিদা দিয়ে রাখছে; তা উৎপাদন করতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে। তাদের চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর চাহিদা মেটাতে সময় লাগবে আরো দেড় দুই বছর। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের আগে হয়তো এর সুফল পাওয়া যাবে না। ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য শক্তিশালী যে লবিং দরকার তা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি। করোনা সামাল দিতে প্রতি ক্ষেত্রেই আমরা ট্রেন মিস করেছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App