×

জাতীয়

প্রদীপের লালসার শিকার বহু তরুণী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২০, ১১:১০ এএম

প্রদীপের লালসার শিকার বহু তরুণী

ছবি: ভোরের কাগজ

টেকনাফের বিতর্কিত ওসি প্রদীপ কুমার দাসের অপকর্মের শেষ নেই। নিরীহ লোকজনকে হয়রানি ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য ছাড়াও নারী কেলেঙ্কারির ঘটনাও রয়েছে লোকমুখে। টেকনাফের নাজিরাপাড়ার একটি প্রাসাদোপম অট্টালিকা টানা দেড়বছর দখলে রেখে পুলিশ ক্যাম্পের নামে তিনি সেখানে গড়ে তোলেন রঙমহল। তরুণীদের ধরে নিয়ে রাতে নির্যাতন, উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে উল্লাস, মদ পান ও ইয়াবা সেবন ছিল ওই মহলের প্রতিরাতের ঘটনা। সন্ধ্যার পর জমে উঠত আসর। প্রায় রাতে প্রদীপ থানার গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়ে অবস্থান করতেন। থাকতেন গভীর রাত পর্যন্ত। অনেক রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে সেখানে নির্যাতন করে আদায় করা হতো টাকা। স্থানীয় এজাহার মিয়ার ওই বাড়িটি এতদিন পুলিশের কব্জায় থাকলেও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর পালিয়ে গেছে সব পুলিশ। বাড়িতে ফিরেছেন এজাহার মিয়ার স্ত্রী ও সন্তানরা। তবে এর আগে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এজাহার মিয়ার বড় ছেলে নূর মোহাম্মদ নিহত হয়েছেন। পুত্র শোকের পর বাড়ি হারিয়ে হৃদরোগে আত্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এজাহার মিয়া। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আবুল ফয়সল জানান, নূর মোহাম্মদ ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর নাজিরপাড়ার দোতলা ওই বাড়িসহ জিয়াউর রহমান নামে আরেক ব্যক্তির বাড়িও আদালত পুলিশের জিম্মায় ব্যবহারের জন্য দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। এসব বিষয়ে পুলিশ সুপার অফিসকে চিঠি দিয়ে জানানো হবে বলেও জানান তিনি। এদিকে নূর মোহাম্মদের বৃদ্ধা মা আবেদা খাতুন জানান, ওসি প্রদীপ তাকে মারধর করে সন্তান ও নাতি-নাতনিসহ বের করে দেন। তার ছেলে লবণ ব্যবসা করত। পুলিশ তাকে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করে বাড়ি দখল করে নিয়েছিল। ছেলের শোকে তার স্বামী মারা গেছেন দাবি করে আবেদা বলেন, তারা পাশেই তার মেয়ের বাসায় ওঠেন। তাদের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে পুলিশ আশপাশের নারীদের নিয়মিত উত্ত্যক্ত করত। নূর মোহাম্মদের ছোটভাই নূর ইসলাম জনান, গত বছরের ১৯ মার্চ টেকনাফ কৃষি অফিস থেকে পুলিশ তার ভাইকে ধরে নিয়ে ২২ মার্চ মেরিন ড্রাইভ এলাকায় ক্রসফায়ার নাটক সাজায়। এর দেড়মাস পর (২৬ রমজান, শবেকদরের রাতে) পুলিশ ওই বাড়ি দখল করে নেয়। সেখানে ৯ এপিবিএন, চট্টগ্রামের ক্যাম্প অফিস খুলে ১৮টি কক্ষে থাকত ২৫ পুলিশ সদস্য। সন্ধ্যার পর ওসি প্রদীপ সেখানে যেতেন। এলাকার অনেক স্থান থেকে ও আশপাশের তরুণীদের নিয়ে যাওয়া হতো সেখানে। সাউন্ড বক্স বাজিয়ে গান, মদ পান ও অসামাজিক কাজ চলত গভীর রাত পর্যন্ত। আশপাশের বাসিন্দারা এসবের শব্দ পেলেও ভয়ে থাতেন তটস্থ। বিশেষ করে লোকজনকে নির্যাতনের সময় কান্না, আহাজারী ও আর্তনাদে ভেঙে যেত রাতের নিস্তব্ধতা। স্থানীদের কাছে পুলিশের বাড়ি বা বিকল্প থানা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই বাড়ি এখনো সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ৩১ জুলাই সিনহা হত্যাকাণ্ডের একদিন পর (ঈদের পর দিন) সকালে টেকনাফ থানার এস আই সঞ্জীব সখানে গিয়ে সবাইকে দ্রুত বের হয়ে যেতে বলেন। তাড়াহুড়া করে পুলিশ সদস্যরা বাড়ি ছাড়লেও এখনো সেখানে পুলিশের অপকীর্তির অনেক আলামত রয়ে গেছে। পড়ে আছে পুলিশের পোশাক, খালি মদের বোতল, ইয়াবা সেবনের রাং, ফুয়েল পেপার, তরুণীদের ছেড়া জামা কাপড়সহ অনেক কিছু। ২৮ শতাংশ জমির ভেতরে বাউন্ডারি করা বাড়িটির ১৮টি কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুলিশের গোপন নথি, জিডি বইসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু। নূর মেহাম্মদের ছোট বোন শামসুন্নাহার জানান, পুলিশ বাড়ি দখলে নেয়ার পর তারা বাড়ির ৩টি বিদ্যুতের মিটার সরিয়ে নিতে আবেদন করেন। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন মিটার খুলতে গেলেও পুলিশ বাধা দেয়। এরপর দুটি মিটার সরানো হলেও একটার সংযোগ রেখে দেয় পুলিশ। ১০ মাস ব্যবহারের পর ওই মিটারের বকেয়া বিল ৫৩ হাজার টাকা পুলিশ তাদের দিতে বলে। শামসুন্নাহার আরো বলেন, প্রদীপ থানায় যোগদানের দুদিন পর তার ভাগনে কামাল জালিয়াপাড়ার হাসান আলিকে আটক করে মেরিন ড্রাইভে প্রথম ক্রসফায়ার নাটক সাজায়। এরপর টাকা হাতানোর জন্য টার্গেট করা হয় নূর মোহাম্মদকে। নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম জানান, প্রদীপ বাড়িটি দখল করে ব্যবহারের জন্য তার স্বামীকে ক্রসফায়ার নাটকে হত্যা করে ৩ মেয়েসহ তাকে বিধবা করেছেন। তিনি এর বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করবেন বলে জানান। পুলিশ তাদের বাড়ি জব্দের কথা বললেও এর কোনো কাগজ ছিল না বলে দাবি করেন লায়লা বেগম। কথিত ক্রসফায়ারে নিহত কামালে মা নুরুন্নাহার জানান, দোতলা বাড়িতে পুলিশ প্রতিরাতে যা করত একজন নারী হিসেবে তা বলা লজ্জাকর। স্কুল-কলেজ পড়–য়া আশপাশের অনেক তরুণীকে পুলিশ ধরে নিয়ে বেইজ্জত করেছে বলেও দাবি করেন তিনি। স্থানীয় মোহাম্মদ রফিক জানান, ওই বাড়িতে পুলিশ থার্টি ফাস্টনাইট উদযাপন করেছে। মদ, নারী ছিল তাাদের প্রতিরাতের সঙ্গী। আরেক বাসিন্দা জাকির হোসাইন জানান, বাইরে থেকে অনেককিছুর শব্দ শোনা গেলেও প্রদীপের ভয়ে সবার মুখ বন্ধ ছিল। তরুণী মেয়েদের নিয়ে এলাকার সবাই ভয়ে থাকতেন সবসময়। টেকনাফ পুলিশের একটি সূত্র জানায়, প্রদীপের স্ত্রী চুমকি দাস কখনো চট্টগ্রাম কখনো টেকনাফ থাকতেন। প্রদীপ একটি রিসোর্টে রাত কাটাতেন। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর প্রদীপ গ্রেপ্তার হলে চুমকি গোপনে টেকনাফ ছাড়েন। প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শ্যামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৫ আগস্ট ওসি প্রদীপ ও দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ ৯ জনকে আসামি করে সিনহার বোন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ৭ পুলিশ সদস্যকেই বরখাস্ত করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫। ওই মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৩ জনকে ৭ দিনের রিমান্ড ও অন্য আসামিদের দুদিন করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন আদালত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App