×

জাতীয়

গণশুনানিতে সিনহা হত্যার বর্ণনা দিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২০, ০৯:৫৭ এএম

স্থান শামলাপুর পুলিশ চেক পয়েন্ট। তারিখ গত ৩১ জুলাই, সময় রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টা। ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচে দেখলাম সাদা রংয়ের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আর সেদিকে পিস্তল তাক করে আছেন এক পুলিশ। একটু পর দুহাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে এলেন এক ভদ্রলোক। এক পর্যায়ে পিস্তল তাক করা পুলিশ সদস্য ওই ভদ্রলোককে মাটিতে ‘হাঁটু গেঁড়ে’ বসার নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো ওই ভদ্রলোক মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে পরপর ৩টি গুলি করল উদ্যত পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ। মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ওই ভদ্রলোক।

গতকাল রবিবার সকাল ১০টায় শামলাপুর পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জের অফিসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সামনে গণশুনানিতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেদিন রাতের ঘটনার এই বিবরণ দেন স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে আসা আবদুল হামিদ, সরওয়ার কামাল ও জাকির হোসেন। তারা বলেন, চোখের সামনে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। তখনো আমরা জানি না, কে গুলি চালালেন, কেন গুলি চালানো হলো, কিংবা গুলি চালানো হলো কার ওপর। টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গতকাল তদন্ত কমিটির সামনে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেন আরো ১১ জন। এরা হলেন- আবদুল হামিদ (৩৫), মো. হামিদ (৩০), সরোয়ার কামাল (৪০), আমিন হোসেন (৩৭), নুরুল আমিন (৩০), সাইফুল আফছার (৩২) জাকির হোসেন (৩০), রশিদ আহমদ (৩২), বশির আহমদ (৪০), ফরিদ আলম (৩৫) ও আনসারুল আলম (৩৩)। শুনানি শেষে তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেকনাফ থানার পুলিশ, ফাঁড়ির পুলিশ, তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ, আর্মড ব্যাটালিয়ন সদস্য, প্রত্যক্ষদর্শী, সংশ্লিষ্ট গাড়িচালক, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার এবং সুরতহাল তৈরিকারী পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি আমরা। বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি। সংশ্লিষ্টদের সবার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করছি। প্রত্যক্ষদর্শীরা যেন কেউ বাদ না পড়ে যায়, সে জন্য ঘটনাস্থলের পাশেই গণশুনানির আয়োজন করেছি। তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। আশা করছি ২৩ আগস্টের মধ্যেই প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সরকারের কাছে জমা দিতে পারব। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাক্ষীরা কী বলছে তার সত্যতা নির্ধারণ তদন্তের বিষয়। এটি সরকারকে জানানো হবে। এই তদন্তে ভবিষ্যতে সাক্ষীরা যাতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মুখে না পড়েন, সে বিষয়টিও প্রতিবেদনে আনা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরকার ৭ কর্মদিবস সময় বেঁধে দিয়েছে। এর আগে গত ৩ আগস্ট থেকে কাজ শুরু করে এ পর্যন্ত এসেছি আমরা। শুরু থেকে কাজ শুরু করে এ পর্যন্ত যেখানে যেখানে যাওয়া দরকার সেসব জায়গায় গিয়েছি। আমরা মানচিত্র তৈরি করেছি। ঘটনাস্থল ৩ বার পরিদর্শন করেছি। এসব জায়গারও মানচিত্র তৈরি করেছি। আজ সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছে। এর মধ্যে দুজন সাক্ষীর বয়ানে সামঞ্জস্য না থাকায় তা বাতিল করা হয়। শুনানিতে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের বক্তব্য শোনেন তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের এডিসি (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান, সদস্য চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মোহা. শাজাহান আলী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ। চেক পয়েন্টের কাছে বায়তুন নুর জামে মসজিদে ঈদুল আজহার আগের রাতে ঈদের নামাজের সময় জানতে মসজিদের ছাদে উঠেছিল রহমানিয়া তালিমুল কুরআন নুরানী মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানার ছাত্র মো. আবদুল আজিজ, মো. হাসান, সাজ্জাদ হোসেন, রিদুয়ান, সাইফুল ইসলাম, সেফায়াত, মিজবাহ ও তারেক। এ সময় পুলিশ তল্লাশি চৌকির দিক থেকে হঠাৎ ‘থাম, থাম!’ আওয়াজ শুনে ওরা সেদিকে তাকায়। আমরা সবাই লাইট পোস্টের আলোয় সুস্পষ্ট দেখতে পাই, একটি সাদা গাড়ি থেকে আর্মি পোশাক পরা একজন লোক হাত উপরে তুলে নামছে। হঠাৎ পুলিশ তাকে গুলি করে,’ জানায় এই ছাত্ররা। এদিকে গণশুনানি শুরু হওয়ার খবরে শামলাপুর এলাকাসহ টেকনাফ উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষ শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প (২৩) ইনচার্জ কার্যালয়ের সামনে ভিড় জমায়। এ সময় শামলাপুর এলাকার দেলোয়ার, রুবেল, আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত উৎসুক জনতা সদ্য বরখাস্ত হওয়া টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের শাস্তি কামনা করে বলেন, মাদকের তকমা লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রেখেছিল ওসি। তার বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিরাও ভয়ে কথা বলতে চাইত না। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে সাবেক এই ওসি। বাহারছড়া ইউনিয়নের উত্তর শীলখালীর হাফেজা খাতুন (৩৫) বলেন, গত ১১ মাস পূর্বে আমার স্বামী আবদুল আমিনকে শামলাপুর তদন্ত ফাঁড়ির পুলিশ রাতের বেলায় ঘর থেকে তুলে নিয়ে যায়। সঙ্গে আমাকেও আটক করে। পরে আমাদের কাছ ৫ লাখ টাকা দাবি করে। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় আমাদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে রাতের আঁধারে মেরিন ড্রাইভ সড়কে ক্রসফায়ারের নাম দিয়ে আমার স্বামীকে হত্যা করে পুলিশ। এখন ৪ ছেলেমেয়ে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের মুখে খাবার জোগান দিচ্ছি। টাকার অভাবে বাচ্চাদের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার স্বামীর কোনো অপরাধ ছিল না। তিনি সমুদ্র্রে মাছ শিকার, দিনমজুর ও মানুষের ক্ষেতখামারে কাজ করে পরিবার চালাতেন। স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি আজিজ উল্লাহ নামের এক লোকের ইশারায় তাকে ‘মাদকের সঙ্গে জড়িত’ বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং ক্রসফায়ারের নাম দিয়ে হত্যা করে। আমি মানুষের কাছ থেকে গণশুনানির খবর পেয়ে স্বেচ্ছায় তদন্ত টিমের কাছে আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার চাইতে এসেছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App