কিশোরীদের ফুটবল খেলা ও প্রগতির ভাবনা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২০, ০৮:১২ পিএম
ফাইল ছবি
ক্ষুদে খেলোয়াড়দের হাতে পুরুস্কার তুলে দেন আয়োজকরা। ফাইল ছবি
ফাইল ছবি
ফুটবলে মেয়েদেরও অবদান কম নয়।
জয়ের সাফল্যে হাসছে তারা।
নারীকে নারী হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত আমাদের সমাজ। যদিও সমাজ কোনো একক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরিচালিত হয় না, বরং সমাজ হচ্ছে সমষ্টিগত মানুষের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। মেয়ে বা নারীরা ফুটবল খেলবে, সেটি এক সময় চিন্তাও করা যেত না। আমাদের অভিভাবক বা সমাজ ব্যবস্থা ছেলে হলে খেলনা হিসেবে হাতে তুলে দেয় পিস্তল, গাড়ি জাতীয় খেলনা, আর মেয়ে হলে তুলে দেয় রান্না করার তৈজসপত্র, পুতুল জাতীয় খেলনা। আমরা আসলে এটাকে নিয়ম হিসেবে দেখেই অনেকটা অভ্যস্ত। কিন্তু কখনো কি প্রশ্ন করেছি, কেন একটা মেয়ে, ছেলেরা খেলে অভ্যস্ত খেলাগুলো খেলতে পারবে না? এতে কি তার শারিরীক সক্ষমতা নেই, নাকি অন্য কোনো সমস্যা?
জানতে চাই না, কারণ আমরা এভাবেই দেখেই অভ্যস্ত! আমরা নারীকে সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে দেখতেই বোধ হয় বেশি অভ্যস্ত! একজন মেয়েকে ছেলের সমকক্ষ হিসেবে দেখার পরিপূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজে এখনো তৈরি হয় নি। আসলে ছোট বেলা থেকেই মেয়েদেরকে এমন সব খেলায় অভ্যস্ত করা হয়, যেগুলোতে মেয়েদের শারীরিক শক্তির প্রয়োগ কম হয়, আর দিনের পর দিন শারীরিক ও পেশী শক্তির খেলায় অনভ্যস্থতার ফলে তারা একসময় নিজেরাই নিজেদেরকে দুর্বল ভাবতে শুরু করে।
[caption id="attachment_237527" align="aligncenter" width="1280"] ফাইল ছবি[/caption]সম্প্রতি ১২ আগষ্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষ্যে বান্দরবানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ শীর্ষক প্রকল্পের উদ্যোগে চিম্বুক জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয় এক প্রীতি ফুটবল খেলার। নির্ধারিত সময়ের খেলায় নীল দল কমলা দল কে ১-০ গোলে পরাজিত করেন। প্রতিটি দলে ১০ করে খেলোয়ার ছিলেন। খেলা শেষে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা যু্ব উন্নয়ন কর্মকর্তা নু প্রু চিং মারমা।
আমরা সবাই জানি, খেলাধুলা মনের ও শারীরিক বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবু বিশেষ কিছু খেলায় কিশোরী বা নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির এখনো পরিবর্তন হয়নি। ফুটবল খেলায় দেশে-বিদেশে আমাদের মুখ উজ্বল করা মেয়েদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের বাসিন্দা। সেখানকার এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় গ্রামের স্কুলটি হয়ে উঠেছে নারী ফুটবলার তৈরির আতুড়ঘর। কলসিন্দুর এখন বাংলাদেশের মধ্যে এক পরিচিত নাম। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৬ ফুটবল দলের বেশিরভাগ মেয়েই কলসিন্দুর স্কুলের ছাত্রী। বাংলাদেশের জাতীয় স্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে কলসিন্দুর স্কুল সবার নজর কাড়ে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ফুটবলে তাদের নজর কাড়া সাফল্যের পর স্কুলের ফুটবলাররা প্রায় তারকা খ্যাতি পেয়েছে।
[caption id="attachment_237530" align="aligncenter" width="1280"] ফুটবলে মেয়েদেরও অবদান কম নয়।[/caption]বাংলাদেশের কিশোরী ফুটবল দলের এই সাফল্যের সূচনা হয় গারো পাহাড়ের কাছে কলসিন্দুর নামের গ্রামে। গ্রামের ছোট্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রাণী আর ক্রীড়া শিক্ষক মফিজ স্যার এই সাফল্যের ছোট্ট পিদিমটি জ্বালেন। গ্রামের মেয়ে ফুটবল খেলবে- এই অবিশ্বাস্য চিন্তাকে সমাজ ও মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন তারা। আর এটিই এখন সারা বাংলাদেশের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের কলসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যদি এমন একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে গিয়ে দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে ফুটবল খেলে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারে, তাহলে বান্দরবানের লাইমীপাড়ার প্রকৃতি আর পাহাড়ি পরিবেশে বড় হওয়া ছোট ছোট কিশোরীরা কেন নিজেদের কে কলসিন্দুরের মেয়েদের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে না। তবে এর জন্য একজন কে পিদিমটা নিশ্চয়ই ধরে রাখতে হবে। স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে উদ্দীপ্ত হবার মন্ত্রগুলো।
[caption id="attachment_237534" align="aligncenter" width="1280"] জয়ের সাফল্যে হাসছে তারা।[/caption]খেলাধুলা করার জন্য শরীরে যে শক্তির দরকার সে রকম ক্যালরিযুক্ত খাবার যোগানের সামর্থ্য কলসিন্দুরের ফুটবল খেলোয়ার এই কিশোরী ফুটবলারদের অভিভাবকদের ছিলো না। কারণ ক্যালরি ফুরিয়ে যায় সর্বগ্রাসী দারিদ্র আর নারীর প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে। তবুও থেমে থাকেনি কলসিন্দুরের কিশোরীদের বিজয় যাত্রা। ইচ্ছাশক্তি যে কোনো পরাজয় মানতে চায় না, কলসিন্দুর গ্রামের এই কন্যাশিশুদের সাফল্য তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এটি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সব কন্যা শিশুদের জন্য জীবন জয়ের প্রেরণাদায়ী উপাখ্যান। বান্দরবানের লাইমিপাড়ার কিশোরী মেয়েরাও বেড়ে উঠুক এমন সম্ভাবনাময় হয়ে, আর সেই সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। আর হয়তো এই কিশোরীরাও একদিন বান্দরবান তথা বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে প্রত্যাশিত সাফল্য ও সুনাম।
সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক, (বেসরকারি অধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা)।