×

সাহিত্য

গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:৩৪ এএম

গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ

শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সারাদেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। কারফিউ জারি করেছিল সামরিক জান্তারা। বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল ঘাতকচক্র ও তৎকালীন সামরিক সরকার। ফলে সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে হতবিহ্বল মানুষ শোক প্রকাশ করতেও ভয় পেত। প্রতিবাদ করতে ভয় পেত। কিন্তু খুনিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন অনেকেই। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে খুব করে একটি প্রপাগাণ্ডা চালানো হয় যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। উল্টো নাকি খুশিতে কেউ কেউ মিছিল করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্য হলো এই- দেশের নানা প্রান্তের সাহসী কবি, লেখক, সাহিত্যিক, ছড়াকার, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা সেই কঠিন দুঃসময়েও তাদের রচনায় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা। তারই এক ঐতিহাসিক উদাহরণ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। গ্রন্থ আকারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঐতিহাসিক ওই সংকলনটি প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। গ্রন্থটির সম্পাদক ছিলেন কবি মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী। খুনিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিভাবে এমন একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রন্থটির সম্পাদক কবি ও বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরে আমি ছিলাম ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধে যেতে পারিনি। এই কষ্টবোধ ছিল মনে। দেশ স্বাধীনের সাড়ে ৩ বছরের মাথায় যখন রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, তখন ক্রোধে টগবগ করে ফুটছিলাম। সে সময় আমি ম্যাট্রিক পাস করে ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করছি। অস্ত্র হাতে খুনিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মতো অবস্থা ছিল না। সেই অসহায়ত্বের ভার খানিকটা মুক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে আমরা কলমকেই হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলাম। তখন অনেকে সাহস করেননি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে। আমরা অনেক দিন ধরে বলে কয়ে অনেককে দিয়ে লিখিয়েছিলাম। সংকলনে দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের রচনা গ্রন্থভূক্ত করেছিলাম। স্মৃতিচারণ করে মিনার মনসুর বলেন,  বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত এ-গ্রন্থটি ছিল পঁচাত্তরপরবর্তী সময়ে জাতির পিতাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রথম স্মারকগ্রন্থ। অফসেটে মুদ্রিত প্রথম প্রচ্ছদে লালের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলাদেশের গোটা মানচিত্র জুড়ে ছিল বিশাল একটি কালো শিলাখণ্ড। সেই পাথরটি তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসম্পর্কিত পেপারকাটিং দিয়ে। সেই প্রস্তর ফুঁড়ে মাথা তুলেছিল একটি গোলাপ। সেটি ছিল শোককে শক্তিতে পরিণত করার আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী অভিযাত্রার প্রতীক। 'শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ'-এর সম্পাদকীয়তেও তার সুস্পষ্ট প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছিল দ্বিধাহীনভাবে। শেষ প্রচ্ছদে ছিল সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত বঙ্গবন্ধুর একটি সৌম্যদর্শন ছবি-যা প্রথম দর্শনে আমাদের মনে একটি শ্বেত পায়রার প্রশান্তি এনে দেয়। ৩২ নম্বর বাড়ির চত্বরে পাইপ হাতে বসে আছেন তিনি। হত্যা ও বর্বরতার বিপরীতে এ ছবিটি হয়ে উঠেছিল শান্তির এক শাশ্বত বিজ্ঞাপন-যাকে তিনি আমৃত্যু শিরোধার্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ঘাতকচক্রের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমি ও আমার অগ্রজ রাশেদ মনোয়ার। এ অপরাধে তারা আমাদের বাসায় বহুবার হামলা চালিয়েছিল। আমার বাবাকে নাজেহাল করেছিল। তবে গায়ে হাত তোলার সাহস তাদের ছিল না। রাতের অন্ধকারে অগ্রজ রাশেদ মনোয়ারকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। আমাকে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল। সেই সময় রাতের পর রাত ঘরে থাকতে পারিনি। প্রায় দেড় বছর আমি ক্যাম্পাসবাসী ছিলাম। একদিকে ছিল সরকারি বাহিনীর তাড়া, অন্যদিকে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী শক্তি। তাদের কাছে তখন চরম হয়রানির শিকার হতে হয়।  এছাড়া আমাদের বাড়ির পাশে ছিল একটা অবাঙালি পরিবারের বসবাস। ওরা একাত্তরে লুটপাট করে স্বাধীনতার পর পালিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আবার ফিরে আসে। তারা আমাদের বাসায় বহুবার হামলা চালিয়েছিল। তারপরও জীবনের পরোয়া করিনি। মূল কথা হলো আমরা ভয় পাইনি। থেমে যাইনি। ভয়কে জয় করেছিলাম। ভয়কে জয় করার একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শত প্রকাশনার একটি হিসেবে গ্রন্থটি অবিকল পুনর্মুদ্রণের জন্যে। হোক না ৪০ বছরের ব্যবধান, তবু আমাদের জীবদ্দশায় সত্য স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে-এও কি কম প্রাপ্তি? মিনার মনসুর জানান, দীর্ঘদিন লেখকদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করে লেখা এনেছিলেন। ওই ঐতিহাসিক গ্রন্থে লিখেছিলেন- মযহারুল ইসলাম, ড. আবদুল মতিন চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, ইসমাইল মোহাম্মদ, সন্তোষ গুপ্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, জাহিদুল হক, ওমর আলী, শাহাদাত বুলবুল, ফজলুল হক সরকার, শামসুল আলম সাঈদ, খালিদ আহসান, কামাল চৌধুরী, মিনার মনসুর, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবসার হাবীব, জাফর ওয়াজেদ, দিলওয়ার চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, হারুন রশিদ, নাজিম হাসান, সুজাউদ্দিন কায়সার, বিনতা শাহীন, সনজীব বড়ুয়া, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইকবাল করিম, স্বপন দত্ত, শিশির দত্ত, খোরশেদ আলম সুজন, ইসরাইল খান ও জমীর চৌধুরী। প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী ও কবি খালিদ আহসান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App