×

জাতীয়

বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, বাংলাদেশকে দেখেছি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২০, ১২:৫৬ এএম

আমার জন্ম বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আমার বেড়ে ওঠা। পাঠ্যপুস্তকে তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। ছিলেন না পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়। একেবারে ঘরোয়াভাবে বাবার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতাম। বাবা সৌভাগ্যবানদের একজন। যিনি বঙ্গবন্ধুর মতো হিমালয়সম মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কবি আব্দুল হাকিম (হাকিম ভাই নামে যিনি খ্যাত ছিলেন) একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বাবাও হাকিম ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন। এর আগেও আরেকবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছিল বরিশালে, মুক্তিযুদ্ধের আগে। একেবারে বঙ্গবন্ধুর পাশে বসেছিলেন। এজন্য বাবা গর্ববোধ করেন। নৌকার সমর্থক তিনি। আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন। বলা যায়, ব্লাইন্ড সাপোর্টার। এই ভেবে আমি গর্বিত, ইতিহাস তো আমার ঘরেই। বাবার বয়স এখন ১০০ ছুঁই ছুঁই। এখনো সেইসব দিনের কথা মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। আমার ইতিহাস শেখার শুরুটা ঘর থেকে, বাবার কাছ থেকে। স্কুল জীবনে ছুটে চলার দুরন্ত সময়ে বন্ধু-বান্ধব যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে বেড়ে উঠেছি, তাদের বেশির ভাগই পারিবারিক কারণে বঙ্গবন্ধুকে খুব একটা পছন্দ করতো না। বরং কটাক্ষ করতো। একটু বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের এলাকাটি বিএনপি-জামাত প্রভাবিত। ঢাকার যতগুলো এলাকা বিএনপি-জামাতের কব্জায় খিলগাঁও তিলপাপাড়া তার একটি। এখন অবশ্য সময় বদলেছে, চিত্র পাল্টেছে। একটি জেনারেশন প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে সঠিক ইতিহাসের পক্ষে। যা হোক, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন ধরণের টিপ্পনিও কাটতো বন্ধুদের অনেকে। ১৫ আগস্টকে নিয়ে ওরা উপহাস করতো। মনটা খুব খারাপ হয়ে যেত। ভাবতাম, এ কোন দেশে বাস করছি? যেখানে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দেশপ্রেমিক নেতার কথা জোর গলায় বলা যায় না। মনে আছে, তিলপাপাড়ায় ওই সময় আলাউদ্দিন নামে একজন বঙ্গবন্ধু ভক্ত ছিলেন, যিনি ৭ মার্চ সারাদিন মাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দেশাত্মবোধক গান বাজাতেন। ১৫ আগস্ট খিচুড়ি খাওয়াতেন গরীবদের। বলা যায়, রিকশা ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন ও তার মতো নিঃস্বার্থ কিছু মানুষ তখন তিলপাপাড়ায় বঙ্গবন্ধুকে মানুষের মনে জাগিয়ে রেখেছিলেন। এজন্য অবশ্য তাদের মূল্যও দিতে হয়েছে। আরেকজন ছিলেন যুবলীগ নেতা শফিক। আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য তাকে একবার শিবির কর্মিরা পায়ের রগ কেটে দিয়েছিল। কোনো জ্যান্ত মানুষের পায়ের রগ কাটা যেতে পারে ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম শুনেছিলাম। এছাড়া, আবু সাঈদ, কালা মান্নান, আলম, যুগুসহ অনেকে বঙ্গবন্ধু স্মরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তাই স্বৈরাচারবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলোতে মনে হতো মুক্তিযুদ্ধে আছি। ভেতরে সেকি উত্তেজনা! ৯১’এর নির্বাচনের সময় বাবা বাঁশ দিয়ে নিজের হাতে বিরাট এক নৌকা তৈরি করেছিলেন। পরে বাসার টিনের চালের উপর সেটি বসিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপিপন্থিরা আমাদের টিনের ঘরের চালে অবিরাম ঢিল মেরেছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ভাবলাম, রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্ন্ই থেকে গেল। বরং বিএনপি-জামাত মিলে আরো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও হতাশার জন্ম দিল। এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মান্নানের দৈনিক ইনকিলাব বিএনপি আমলেও বেশ রমরমা ছিল। ১৫ আগস্ট ভেতরের পাতায় এক কলামে তারা ছাপতো ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী আজ’। এমন হেয় করার আরো অনেক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেয় পত্রিকাটি। তাই যুদ্ধাপরাধীদের মুখপত্র ইনকিলাবকে বর্জনের করার আহবান জানিয়ে ১৯৯৭ এর ১৩ এপ্রিল বিবৃতি দেন কবি সুফিয়া কামাল, প্রফেসর শওকত ওসমান, প্রফেসর কবীর চৌধুরী এবং কবি শামসুর রাহমান। সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পিতৃতুল্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উপহাস করে বলতেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব’, ‘আমার কম্বলটি কোথায়!’ আরো অনেক শ্লেষাত্মক বাক্য তিনি উচ্চারণ করতেন সভা, সংসদে। শুধু তাই নয়। ১৫ আগস্টে খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিন পালনের রেওয়াজও চালু হয় এক সময়। শোক দিবসে ঘটা করে চলে কেক কাটার অনুষ্ঠান। মজার বিষয় হল, গত বছর ১৫ আগস্ট বিএনপি ওই জন্মদিনে কোনো কর্মসূচি রাখেনি। এ বছরও তারা বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন করবে না। এটাই সত্য, বাস্তবতা। মানুষ মেনে নেয়নি ওই ভুয়া জন্মদিন। তাই শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে প্রতিবছর ১৫ আগস্ট কালো ব্যানারে ছেয়ে যেতে একটি দাবি, ‘জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চায়’। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আসামিপক্ষের ১৫ জন উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পান। ওই আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং তিনজনকে খালাস দেয়া হয়। তবে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৮ সালের আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সেই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর করা শুরু করে। বাবার চোখে সেদিন আনন্দ অশ্রু দেখেছিলাম। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তার সেই ইচ্ছেটি পূরণ হয়েছে। যারা রাজপথে মার খেয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন আজ বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের অকুতোভয় সেইসব সৈনিকদের স্যালুট জানাই। আজ যেসব কিশোর, তরুণরা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ার সুযোগ পাচ্ছে তারা কতই না সৌভাগ্যবান! এটাই ইতিহাসের নিয়ম। সত্যকে কখনো ঢেকে রাখা যায় না। মেঘে আড়ালে ঢাকা পড়া সূর্য উঁকি দেবেই। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু ছিলেন, বঙ্গবন্ধু থাকবেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে। তাইতো এতোদিন পরেও কোটি কোটি তরুণ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- ‘মোরা বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি দু’চোখে বাংলাদেশকে দেখিছি, তার শ্যামল প্রান্তরে কৃষকের হাসিতে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি।’ লেখক: সাংবাদিক ও সংগীতশিল্পী

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App