×

মুক্তচিন্তা

নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী এবং আলোহীন প্রদীপেরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২০, ০৬:৪৫ পিএম

প্রদীপ বাংলাদেশের অপরাধ কিংবা অপরাধীদের একটা সিম্বল মাত্র। এ রকম প্রদীপ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই আছেন। সুতরাং কার ক্যাডার এটা কোনো বড় বিষয় নয়। কীভাবে কার ছত্রছায়ায় এই প্রদীপরা বেড়ে উঠছে, জেলায়-উপজেলায়, তা-ই ভাবার বিষয়। দেশ আর জাতিকে যারা নিরাপত্তা দেবে, তারা নাগরিকদের হত্যাকারী হতে পারে না।

আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে আমার উপজেলায় একটা অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানটা যারা আয়োজন করেছিলেন, তারা উপজেলার সব প্রতিনিধিত্বশীল মানুষকে আমন্ত্রণ জানান। অনুষ্ঠানে দেখলাম, থানার ওসিও এসেছেন। শুধু তাই নয়, আলোচনায় তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতাও দিলেন। অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, ছিলেন সিলেট শিক্ষা বিভাগের প্রধান। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ ওসি, তিনি অবশ্যই সম্মান পাবেন, এতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা না। কিন্তু এ রকম অনুষ্ঠানে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, পৌর মেয়র, সাংবাদিক, শিক্ষক, স্থানীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মানুষসহ সবারই একটা ভিন্ন সমীহের সুর দেখেছি সে সময়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ রকম অনুষ্ঠানে কি ওসিকে অতিথি না করলে হয় না। বরং তারা কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, উপজেলার কোনো ভালো অনুষ্ঠানই তাকে বাদ দিয়ে হয় না। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোর নিউজ দেখতাম, এখনো দেখি। তিন বছর আগে আয়োজকদের সেই কথাগুলোকে ফেলে দেয়া যায় না। এখন বাস্তবতা হলো, জেলা পর্যায়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, এসপি-এএসপি এদের একই মঞ্চে দেখা যায়। যুগ পাল্টেছে। সময়ের সঙ্গে ক্ষমতা কিংবা প্রশাসনেরও রকমফের হয়েছে, এটাই ধরে নিচ্ছি আমরা। স্থানীয় নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান হলে অবশ্যই এখানে নিরাপত্তার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তারা আসবেন, তারা বলবেনও, নির্দেশনাও দেবেন। কিন্তু মিডিয়া-শিক্ষা-স্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানে কি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোর আলোচনা খুব একটা জরুরি? নিশ্চয়ই নয়। তবুও তারা আসছেন এবং দাপটের সঙ্গেই বিভিন্ন সময় বাণীও দিচ্ছেন। প্রসঙ্গটা টেনে আনলাম কারণ একজন ওসি একটা থানার আইনশৃঙ্খলা দেখার দায়িত্বে থাকেন, অন্য কিছুতে নন। অন্য দায়িত্বগুলো তাকে দেয়া হয় না। এবং ওসি হয়তো নিজে এই দায়িত্বটুকু কাঁধে তোলে নেন না। তাকে তোলে দেয়া হয়। এর কারণইবা কী? এমনিতেই পুলিশ বিভাগের চাকরি এখন একটা আকর্ষণীয় জব। যদি এই বিভাগের স্লোগান কিংবা উদ্দেশ্যের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যায় দেশ সেবাটাই তরুণদের উদ্দীপ্ত করে এ রকমের চৌকস চাকরিতে। কিছু কিছু পুলিশ অফিসার করোনাকালে জনগণের সেবা করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু একটা বিষয় দেখা যায়, বিশেষত ওসিতে পদায়ন হওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ এই স্মার্ট অফিসারদের জীবন বদলে যায় আলাদিনের চেরাগের মতো। এই আলাদিনের চেরাগ পাওয়া বাংলাদেশের অনেক অনেক পুলিশ অফিসারদের একজন হলেন প্রদীপ। হালে এ নাম বহু উচ্চারিত। এর আগেও তিনি যে অনুচ্চারিত ছিলেন, তা নয়। মিথ হয়ে গেছেন তিনি; টেকনাফে তার কথা শোনলে নাকি ক্রন্দনরত শিশুরা কান্না থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। ডানপিটে ছেলেটি এই নাম শোনলে সুবোধ বালক হয়ে যেত। নির্বিকারভাবে মানুষ খুন করার সাহস যার আছে, তার ললাটে এ রকম তিলক পড়তেই পারে। প্রদীপ ইয়াবা নির্মূল করতে চেয়েছিলেন, আর সেজন্য তিনি সরকারের ভালো উদ্যোগের যে মিশন, সেই মিশনে সফলতা আনতে টেকনাফে প্রতিরাতেই যেন নতুন নতুন গল্প রচনা করতেন। মাদকের স্বর্গরাজ্যের একটা টেকনাফ প্রদীপকেও যেন আসক্ত করে তোলেছিল। তিনি বের হতেন মাদক নির্মূলে। মাদকের করাল গ্রাস থেকে সমুদ্র উপক‚লবর্তী মানুষদের রক্ষা করতে গিয়ে তার হাতে দিনে-রাতে রচিত হতে থাকে নতুন নতুন উপাখ্যান। মাদক নির্মূলের নামে নিশ্চয়ই তিনি হত্যা করেছেন কিছু চিহ্নিত অপরাধী, তা অস্বীকার করা যাবে না। সরকার কিংবা এলাকার মানুষ ওই চিহ্নিত অপরাধীদের নিহত হওয়া দেখে আশান্বিত যে হয়নি তাও নয়। কিন্তু তার ধরা পড়ার পর সেই ইতিহাসের পাতা একটা পর একটা উল্টানো হচ্ছে, আর বেরিয়ে আসছে টেকনাফ কিংবা কক্সবাজারে মৃত্যুপুরী বানানোর এককেকটা অধ্যায়। মানুষকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় তার নেশা হয়ে গিয়েছিল। খবর বেরিয়েছে, একটা জায়গা থেকে ৭৭ লাখ টাকা নেয়ার পরও প্রদীপ ওই মানুষটাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছেন। টেকনাফে তিনি মানুষ হত্যা করেছেন দেড় শতাধিক। এই শতাধিক হত্যায় হয়তো কিছুই হতো না, হয়ওনি তার। কিন্তু বিধি তার বাম। তাই তো ভুল জায়গাটায়ই হাত দিয়েছিলেন তিনি। সিনহাকে হত্যা করে তিনি শেষ পর্যন্ত ফেঁসে গেলেন। ওসি প্রদীপ আটকের মধ্য দিয়ে শুধুই যে একজন মহাপরাক্রমশালী অপরাধী লোকচক্ষুতে ভেসে উঠেছেন, তা তো নয়। উঠে এসেছে টেকনাফ নামক জায়গা কিংবা নয়নাভিরাম কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যটন ঘিরে কীভাবে কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন একেকজন মানুষ। ইয়াবা আর মাদকের রাজ্যে কীভাবে জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছেন। ক্রসফায়ার থেকে বাঁচার জন্য একেকজন মানুষ কি অবলীলায় লাখ লাখ টাকা বের করে দিয়েছেন তাকে, কিংবা কারো বাড়ি থেকে ৫০ লাখ টাকা উদ্ধার এসব কিছুই তো আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। ওসি চাইলে সেখানে অপরাধ দমন করতে পারতেন। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, কিংবা হত্যা করেছেন তাদের অনেকেই হয়তো বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে জড়িত এবং একজন প্রদীপের মধ্য দিয়ে সে এলাকাটা অন্তত অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খোঁজে পেত, একটা স্বস্তির জনপদ হয়ে ওঠার কথা ছিল প্রদীপের কারণে। প্রদীপ আটকের পর অনেক কিছুই বেরিয়ে আসছে। মুখ খুলছেন অনেকেই, তার ফোনালাপ প্রকাশিত হচ্ছে। একটা ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছে। ফোনে সিনহা হত্যার পর তিনি আইনি সহযোগিতা নিচ্ছেন, ‘স্যার স্যার’ সম্বোধন করে এ হত্যার আইনি সংকট সমাধানের পথ খোঁজছেন টেলিফোনে। যেহেতু সিনহা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, সেজন্য এটা কোনো ব্যাপার নয়, ওই সহযোগিতাকারী তাও ফোনালাপে ওসি প্রদীপকে আশ্বস্ত করছেন। এ রকম সহযোগিতা প্রদীপ পেয়েছেন এবং সেজন্যই তিনি নিজেকে এভাবে বেপরোয়া মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এভাবেই প্রদীপদের জাল বিস্তৃত থাকে। অবৈধ অর্থের একটা অংশ প্রদীপরা জায়গামতো দিয়ে রাখেন, এই-ই হলো অপরাধের চেইন। এই চেইনটারও একটা রুট বা গোড়া থাকে। মাত্র ক’দিন থেকে সাহেদ-সাবরিনা-জিকে শামীম-সম্রাট-নুরজাহানসহ শত শত নাম দেশব্যাপী উচ্চারিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। নতুন নতুন অপরাধীরা আসছে আর দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। অপরাধের যজ্ঞ তৈরি করেছে তারা। প্রদীপ আটক হওয়ার পর থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সামনে আসছে কিছু ব্যাপার। একটা গোষ্ঠী বারবার দেখাতে উঠেপড়ে লেগেছে, প্রদীপের অন্ধকার দিকের জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ সে সময়ও তিনি খালেদা জিয়ার কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছেন। আরেকটা গ্রুপ তাকে হিন্দু হিসেবে উল্লেখ করে ভারতের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে উঠে-পড়ে লেগেছে, অন্যদিকে আরেকটা ক্ষুদ্র অংশ প্রদীপের অপরাধকে গৌণ দেখে তার হেনস্থার পেছনে হিন্দুত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছেন। ওই যে তিনটা গোষ্ঠী, তারা সবাই-ই মূলত এ কাজগুলো করে জনসম্মুখে প্রদীপের অপরাধকে চিহ্নিত করতে পারছেন না। বরং তাদের কারো কাছে তার ভারত প্রীতি, কারো কাছে খালেদা জিয়ার সময়কালীন ছাত্রদলের ক্যাডার, কারো কাছে হিন্দু- এসব প্রচার করে মূলত তার পক্ষই অবলম্বন করছেন। তার পাহাড় সমান অপরাধ তাদের এই গছিপের কারণে কম উচ্চারিত হচ্ছে। প্রদীপ বাংলাদেশের অপরাধ কিংবা অপরাধীদের একটা সিম্বল মাত্র। এ রকম প্রদীপ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই আছেন। সুতরাং কার ক্যাডার এটা কোনো বড় বিষয় নয়। কীভাবে কার ছত্রছায়ায় এই প্রদীপরা বেড়ে উঠছে, জেলায়-উপজেলায়, তা-ই ভাবার বিষয়। দেশ আর জাতিকে যারা নিরাপত্তা দেবে, তারা নাগরিকদের হত্যাকারী হতে পারে না। আবার তারা কাউকে অপরাধ করার সুযোগও তৈরি করে দিতে পারে না। এই জায়গাটাতেই তাদের অবস্থান সুনিশ্চিত হওয়া উচিত। নিরাপত্তা বাহিনী দেশের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরীই হবে। তারা জনগণের নেতার কাতারে এসে দাঁড়িয়ে গেলে তাদের অনৈতিক ক্ষমতা বাড়বেই। কারণ তখন তারা জনপ্রতিনিধিদের কাতারেও থাকে, আবার তাদের থাকে শাসন করার নির্বাহী অধিকার। এই দুইয়ে মিলে প্রশাসনের সব জায়গায়ই প্রদীপরা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এই প্রদীপরা দেশটাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App