×

জাতীয়

হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র উন্মোচনের তাগিদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:২২ পিএম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বীজ বপন হয়েছিল একাত্তর সালেই। তবে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও জনরোষের ভয়ে তাকে হত্যার সাহস পায়নি পাকিস্তানিরা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন নতুন ষড়যন্ত্রের বীজ বুনে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য ঘাতকের দল বন্দুকের নল তাক করে জাতির পিতার দিকে। ষড়যন্ত্র সফল করতে মরিয়া দেশি-বিদেশি শক্তি। আর সেই ষড়যন্ত্রের পথ ধরেই কিলিং মিশনে অংশ নেয় খুনিরা। বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় ৬ ফুটের হিমালয়সম দেহ। রক্তাক্ত সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত বাংলাদেশ। ধানমন্ডি ৩২ থেকে সেই রক্তের ধারা প্লাবিত করে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল।

পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২১ বছর পর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের জঘন্যতম ওই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে মদদদাতা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র এখনো অজানা।

গবেষকদের মতে, হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটচালের রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আংশিক বিচার হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠন করে শে^তপত্র প্রকাশের দাবি জাতির। গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর নেই। রহস্য উদ্ঘাটনে উত্তরগুলো জানা প্রয়োজন। সুষ্ঠু-নির্মোহ তদন্ত হলে চিত্রনাট্যে কি পরিকল্পনা হয়েছে, অঙ্ক-দৃশ্য কেমন ছিল- সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

ঘরের শত্রু বিভীষণ : সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় যুক্তরাজ্যে, ১৯৮০ সালে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইডসহ ৪ ব্রিটিশ আইনবিদ এ কমিশন গঠন করেছিলেন। তবে অনুসন্ধানের কাজে কমিশনকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে জিয়াউর রহমানের সরকার। কমিশনের ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি’ প্রতিবেদনে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া লে. কর্নেল আজিজ পাশা, মেজর মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মেজর শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিশমত হোসেন, লেফটেন্যান্ট এম খায়রুজ্জামান এবং লেফটেন্যান্ট আবদুল মাজেদ জড়িত।

পঁচাত্তরে ব্যাংককে এক সভায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং জেলহত্যার কথা স্বীকার করে আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক।  ছিয়াত্তরের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমসে এবং ২ আগস্ট লন্ডনে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারেও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ফারুক। হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়ে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে কর্নেল রশিদ বলে, মেজর জেনারেল জিয়া আমাদের বলেন, আমাকে সরাসরি না জড়িয়ে তোমরা জুনিয়ররা যা পার তা করে ফেল। পনেরো আগস্ট বিকালেই সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য বঙ্গভবনে আমার কাছে ঘুর ঘুর করছিল। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবরে শাফায়াত জামিলকে জিয়া বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট যদি না বেঁচে থাকেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট তো রয়েছেন। তোমরা হেড কোয়ার্টারে যাও এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো। প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, সেনাবাহিনীর মধ্যস্তরের অফিসারদের একাংশ একটা রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে- বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূত বায়েজিদের এমন তথ্য আমি মুজিব ভাইকে জানিয়েছিলাম।

তিনি খবরটা শুনে বললেন, আমার বুকে অস্ত্র তাক করতে মেজর ডালিম, রশিদ ও ফারুকদের কি হাত কাঁপবে না? সাবেক সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, নথিপত্রও প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র উন্মোচনের জন্য তদন্ত কমিশন প্রয়োজন। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডের সঠিক ইতিহাসের জন্য খুনি, খুনের পরিকল্পনা প্রকাশের জন্যই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন হওয়া প্রয়োজন। তখন আর ওমুক তমুক জড়িত- এ ব্যাপারটি থাকবে না।

ষড়যন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান! বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থান বিষয়ে ১৯৭৪ সালে থেকেই বিভিন্ন বার্তা চালাচালি করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ঢাকা, দিল্লি ও ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস। মার্কিন সিক্রেট বার্তা থেকে দেখা যায়, চুয়াত্তরের ৩ এপ্রিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো মুজিবের সেনা মোতায়েন শিরোনামে বার্তার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের বেসামরিক যোগাযোগ, দুর্নীতি, ভিন্নমতাবলম্বী উপদল, সেনা মোতায়েন। ২ আগস্ট ঢাকা থেকে পাঠানো আরেক সিক্রেট বার্তার শিরোনাম ছিল ‘সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে আরো বিস্তারিত’। ২৯ আগস্ট তারবার্তার শিরোনাম ছিল, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের অনুরোধ’। ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো আরেকটি গোপন বার্তার শিরোনাম ‘অস্থিরতার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন।’ পঁচাত্তরের ২৯ জুলাই পাঠানো হয় ‘মিসেস গান্ধী এবং সিআইএ’ শিরোনামে আরেকটি বার্তা।

ঊনআশির পনেরো আগস্ট লন্ডনের গার্ডিয়ানে লরেন্স লিফসুলজ ‘মুজিব হত্যার আড়ালে লুকায়িত নেপথ্য’ কাহিনি তুলে ধরেন, মোশতাক গংরা ১ বছরের বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানত। অন্তত ৬ মাস আগে থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বৈঠক চলছিল। মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ প্রধান ফিলিপ চেরিও জানতেন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের খবর সর্বপ্রথম আমেরিকাই পেয়েছিল।

এদিকে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোও ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’কে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি ইসলামি ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেও অনুরূপ স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানায় এবং মোশতাক সরকারের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ ৫০ হাজার টন চাল এবং দেড় কোটি গজ কাপড় উপহার পাঠায়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন জানানো চীন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তারা।

অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাউকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন তিনি। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এবং বুলগেরিয়া বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গ্রাহ্য করেননি।পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা একক দেশীয় ষড়যন্ত্র ছিল না। সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার মিলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা করে বিষয়টি মোটেই এত সরল নয়। ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশ মিলে। আমেরিকা, চীন বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিশ্বজুড়ে চলমান স্নায়ুযদ্ধের ভিকটিম হলেন বঙ্গবন্ধু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেছন থেকে সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের উসকে দিয়েছে। এছাড়া সর্বহারা পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, তোহা আব্দুল হক, টিপু বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের নকশাল পার্টি মুজিব সরকারকে ভারতের পাপেট সরকার ভাবত। ভাসানীর ‘হক কথা’য় মুজিব ও ভারতের বিরুদ্ধে লেখা হতো। জাসদের জন্ম না হলে পনের আগস্টের পটভূমি এত সহজ হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তদন্তে কমিশন গঠন প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের কমিশন গঠনের পরিবেশ রয়েছে কিনা, দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র প্রকাশের পর আমরা সামাল দিতে পারব কিনা তা ভাবনায় রাখতে হবে। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যতে হয়ত কমিশন হবে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের শে^তপত্র উন্মোচিত হবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে টাইমফ্রেম হয়নি বলে জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App