×

বিশেষ সংখ্যা

সামরিক শাসন ও বঙ্গবন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৪৮ পিএম

সামরিক শাসন ও বঙ্গবন্ধু
সামরিক শাসন ও বঙ্গবন্ধু

একাত্তরের পনের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

১৯৫৮ সালে কেন্দ্রে এবং প্রদেশে যে সব ঘটনা ঘটেছে তা ন্যক্কারজনকও বলা যায়, অভ‚তপূর্বও বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনী রচনা করতে গেলে কেন্দ্র ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের কার্যকলাপ, তার অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা থাকা উচিত। কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে, রিপাবলিকান দলের ফিরোজ খান নুনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। নুনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করলেও সোহরাওয়ার্দী ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মির্জা যোগাযোগ রেখেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও রিপাবলিকান দলের শত্রু তে পরিণত হয়নি। কেন্দ্রে মুসলিম লীগ ও কেএসপি কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে এই অলিখিত আঁতাত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সমর্থন ছাড়া ফিরোজ খান নুনের টিকে থাকা মুশকিল ছিল। তাই মির্জা দু’পক্ষকে সমঝোতায় আনলেন। আওয়ামী লীগের সমর্থন [মন্ত্রিসভায় আওয়ামী মন্ত্রী নেয়া] নিয়ে ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফিরোজ খান নুন নতুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা করলেন। প্রদেশে মওলানা ভাসানী নতুন দল করেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের অনেকে ন্যাপে যোগ দিয়েছিলেন। মুজিব পদত্যাগ করেছিলেন কিন্তু আতাউর রহমান খান সরকার চালাচ্ছিলেন। মুজিবের চলে যাওয়া, দলে অন্তর্কলহ বৃদ্ধি, বিরোধী দল, সব মিলিয়ে আতাউর রহমান খানও স্বস্তিতে ছিলেন না। তার ওপর গভর্নর ফজলুল হক ছিলেন কেএসপির। তারাও সচেষ্ট ছিলেন খান সরকারের যাতে পতন হয়। বাজেট অধিবেশন চলার সময় ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগ সদস্য ও রসরাজ মÐলের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সদস্যবৃন্দ জানায়, আওয়ামী লীগের ওপর তাদের আস্থা নেই। মুখ্যমন্ত্রী গভর্নরকে জানান, কিছুদিনের জন্য অধিবেশন মুলতবি রাখতে। এ কে ফজলুল হক সে অনুরোধ তো রাখলেনই না বরং ৩১ মার্চ আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন এবং আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গড়ার আমন্ত্রণ জানান। সোহরাওয়ার্দী ফোন করেন নুনকে, গভর্নরকে অপসারণ করতে। ফলে ১ এপ্রিল নুন এ কে ফজলুল হককে অপসারণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলীকে অস্থায়ী গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয। নতুন গভর্নর আতাউর রহমান খানকে পুনর্বহাল করেন। আস্থা ভোটে আওয়ামী লীগ জিতে যায়। ১৮ জুন খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে ভোটাভুটি হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ১২ ভোটে হেরে যায়। ন্যাপ ভোটদানে বিরত ছিল। ১৯ জুন আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। ২০ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ তখন ন্যাপের সঙ্গে সমঝোতা করে যার ভিত্তি ছিল নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট সমর্থন। ফলে আবার আস্থাভোট হয়। এবার আবু হোসেন সরকার ১৬ ভোটে পরাজিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। [২৫.৬.১৯৫৮]। ২৫ আগস্ট আতাউর খানের নেতৃত্বে আবার আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। মার্চ, ১৯৫৪ থেকে আগস্ট ১৯৫৮ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে তিনবার গভর্নরের শাসন ও সাতটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে বাজেট পাস তখনও সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বাজেট পাস সম্ভব হয়নি। ২৫ সেপ্টেম্বর কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে পার্লামেন্টে। সেটির বিস্তারিত বিবরণ দিলে ঐ সময়ের রাজনীতির ধরনটি বোঝা যাবে। ১৯৫৮ সালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে জমির সিলিং নিয়ে। আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করেছিল ১০০ বিঘার বেশি কেউ জমি রাখতে পারবে না। উত্তরবঙ্গের কয়েকজন সদস্য এই বিধান পরিবর্তন করতে চাইলে সরকার রাজি হলেন না। ফলে তারা বললেন, সরকারকে সমর্থন করবেন না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, “অপরদিকে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের সভ্যদের মধ্যে এক পারিবারিক সংগ্রাম শুরু হয়। মূলতঃ ইহা শুধু অর্থমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে কাজ করিতেছিল। ন্যাপ দলের মধ্যেও এই মন্ত্রিমণ্ডলীর বিরুদ্ধে মনোভাব জাগিয়া ওঠে। [বিস্তারিত, আত্মকথা] স্পিকার জনাব আবদুল হাকিম সাহেব মন্ত্রিমণ্ডলীর বিরুদ্ধে কাজ করিতেছিলেন। কারণ, তিনি কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি ও সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাঁহার নিজ কর্তৃত্ব বৃদ্ধির এক আইন প্রণয়ন করিতে চাহিয়াছিলেন।” [ঐ, পৃ. ১২২] সব মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এমন সময় এক ডিমান্ড প্রস্তাব পাস করতে না পেরে সরকারের পতন ঘটে। স্পিকারের সঙ্গে সরকারের বিরোধ চলছিল। দ্বিতীয়বার আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। ধীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, স্পিকার বাজেট উত্থাপন করতে দেবেন না। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী আগে কেএসপির সদস্য ছিলেন। তিনি বললেন, “নীতি ও আইনের বশবর্তী হইয়া বাজেট উপস্থিত করিলে তিনি বাধা প্রদান করিবেন না। এ পরিস্থিতিতে ঠিক হয় সেপ্টেম্বরে বাজেট পেশ করা হবে। স্পিকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ও সে বিষয়ে আলোচনার দিনও স্থির হয়েছিল। সেদিন স্পিকার আইনতঃ উপস্থিত থাকতে পারেন না।” এরপর ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের জবানীতেÑ “স্পিকার সাহেব যদিও আইনগত স্পিকারের কাজ করিতে পারেন না, তবুও তাঁহার চেয়ারে উপবেশনের চেষ্টা করিলেন। আইনসভার অধিকাংশ সভ্যের প্রতিবাদে তিনি সরিয়া যাইতে বাধ্য হন। ডেপুটি স্পিকার মরহুম শাহেদ আলী সাহেব আইনসভার সহিত কর্তব্য বোধে প্রণোদিত হইয়া আসনে উপবেশন করিলেন। তখন কৃষক শ্রমিক দলের সভ্যগণ যদিও তাঁহারা সংখ্যা অতি সামান্য, এবং নেজামে ইসলাম দলের সভ্যগণ, তাঁহারাও সংখ্যা খুব কম, কলরব করিতে লাগিলেন। ইহার ভিতর বাজেট উপস্থাপিত হয়। ডেপুটি স্পিকার সাহসিকতার সহিত কাজ করিতে থাকেন। কিন্তু ইহা দুঃখের বিষয় কৃষক শ্রমিক দলের সভ্যরা ও নেজামে ইসলামের সভ্যগণ ডেপুটি স্পিকারের দিকে চেয়ার ছুঁড়িতে থাকেন। ইহা এত অপ্রত্যাশিত ও অভাবনীয় কাজ যে, তাহা বুঝিয়া উঠিবার আগেই ডেপুটি স্পিকার গুরুতরভাবে আহত হইলেন। তাঁহার শরীরের নানাস্থান দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। ...ডেপুটি স্পিকার সাহেবকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে তাঁহার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কলিকাতা হইতে সার্জন আনা হইয়াছিল।” আক্ষেপ করে তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তান ইহার জন্য দণ্ড ভোগ করিয়াছে, আর এই দণ্ড ভোগ কবে শেষ হইবে তাহা জানি না।” [বিস্তারিত, ঐ] শাহেদ আলীকে হত্যার জন্য অনেকে আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছেন এমন কী শেখ মুজিবকেও। এমনও বলতে শুনেছি, শাহেদ আলীকে তিনিই চেয়ার ছুড়েছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আওয়ামী লীগ করতেন না, সৎ ও ধীরস্থির মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন পরিচিত। তাঁর বর্ণনায় কোথাও আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের নাম নেই। আবুল মনসুর আহমদ দুঃখ করে লিখেছেন, “দেহরক্ষীরা চেয়ারের পাহাড় না তুলিলে তিনি ঐ উপরই মরিয়া একদম চ্যাপ্টা হইয়া যাইতেন। পরের দিন হাসপাতালে তিনি সত্য সত্যই মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডের আদালতী বিচার হয় নাই। ভালোই হইয়াছে। বিচার হইলে অনেক মিয়ারই শাস্তি হইত। দেশের মুখ কানা হইত। কিন্তু আদালতী বিচার না হইয়া গায়েবী বিচার হইয়াছে। তাতে দেশের মুখ কানা হইল কিনা পরে বুঝা যাইবে; কিন্তু দেশের অন্তর যে কানা হইয়াছে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গিয়াছে। শাহেদ আলীর অপমৃত্যুকে মার্শাল ’ল প্রবর্তনের অন্যতম কারণ বলা হইল। অর্থাৎ পরের ঘটনার জন্যই আগেরটা ঘটিয়াছিল বা ঘটান হইয়াছিল। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিতে গিয়া শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপজিশনের ঢিল-পাটকেলে। অথচ পূর্ববাংলার মুসলমানরা তখনও বলিলেন এবং আজও বলেন : আওয়ামী লীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে। কোন পাপে এ মিথ্যা তহমত!” [২০ বছর, পৃ. ৫৬০-৬১] পরবর্তী সময়ে দেখি শেখ মুজিব শাহেদ আলী দিবস পালন করছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করা হয়েছিল এবং এই হট্টগোলের মধ্যেই বাজেট পাস হয়েছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর শাহেদ আলী মারা যান। অক্টোবর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। মির্জা তখনও প্রেসিডেন্ট। ২৭ অক্টোবর তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী, ২৮ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট। সেই থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানে সামরিক শাসন যাকে বলা হয় জংলি শাসন। ১৩ অক্টোবর জাকির হোসেন হলেন পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর। ১৯৫৮ সালের শুরু থেকে এই পর্যন্ত শেখ মুজিব পার্টির কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দীসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছেন। ১২ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সিভিল অফিসারদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবও। ১৩ অক্টোবর পত্রিকার খবর অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে তাঁদের গ্রেফতার করা হয় “১৯৫৭ সালের দুর্নীতি দমন আইন এবং ১৯৫৮ সালের ৭২নং অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদ, জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, জনাব আবদুল খালেক, শেখ মুজিবুর রহমান, অধুনা বিলুপ্ত প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যও মেসার্স গ্রীন অ্যান্ড হোয়াইট লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জনাব নুরুদ্দিন আহমদ, প্রাক্তন পরিষদ সদস্য জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী, প্রাক্তন পরিষদ সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন অতিরিক্ত চীপ হুইপ জনাব কোরবান আলী, শিল্পোন্নয়ন কমিশনার ও পদাধিকার বলে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প বিভাগের সেক্রেটারি জনাব আসগর আলী শাহ সিএসপি, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পূর্ত বিভাগের চীফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব এম এ জব্বার এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য শ্রম ও শিল্প বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জনাব আমিনুল এসলাম চৌধুরী সিএসপিকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।” [আজাদ, ১৩.১০.১৯৫৮; সংবাদপত্র] লক্ষ করলে দেখা যাবে গ্রেফতারকৃত রাজনীতিবিদরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের এবং সরকারি কর্মচারী যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁরা কাজ করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। অর্থাৎ শুরু থেকে সামরিক বাহিনীর টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব। দুই এক বছর জেলে ছিলেন শেখ মুজিব। স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশ্যে তাঁর কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। এই সময় কয়েকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাঁর সম্পর্কে একটি ধারণা করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ তাঁর নামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বিশেষভাবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ৩১টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে তারা গুরুত্ব দিয়েছে ভাষা আন্দোলন ও বৈষম্য ও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের নিয়ে তাঁর বক্তব্যকে। যেমন ১. মর্নিং নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ৫.৬.১৯৫৮ সালে জানান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা প্রেসিডেন্ট মির্জা। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ২. আমার যদি যথেষ্ট টাকা থাকত তাহলে আপনাদের আমি করাচি নিয়ে যেতাম। দেখাতাম পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব দিয়ে করাচিতে কত শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে অথচ পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবকিছুর ৫০% চাই। ৩. ২৪.৭.১৯৫৮ মর্নিং নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারে যারা আছে তারা যদি ভাবে, তারা আমাদের প্রভু তাহলে বলব তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমি জানি না, করাচির এই চক্র কতদিন পূর্ব পাকিস্তানীদের নিয়ে খেলবে? তিনি আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন চায় শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হতে। একনায়কত্বে নয়। ৪. ‘শাহেদ আলী দিবস’ পালন উপলক্ষে ২৬.৯.১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জে এক সভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ করাচির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে মুসলিম লীগ ও কেএসপি যাতে করাচি পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের সুবিধা দেবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে শোষণ করা যায়। ৫. জানা গেছে, ১২.১০.১৯৫৮ সালে গ্রেফতারের আগে শেখ মুজিব তাঁর বিশ্বাসভাজনদের নির্দেশ দিয়ে গেছেন সামরিক শাসনের সময় যেন তারা নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্তু একটি ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’ চালায় এ বলে যে * পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবি শাসনের শুরুর পর্ব হচ্ছে সামরিক শাসন। বাংলা ভাষার আর কোনো আশা নেই। * পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি হবে পূর্ব পাকিস্তান। * চিরদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান শেষ হয়ে গেল। সবশেষে তারা মন্তব্য করেছে * মুজিব আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় সদস্য এবং একজন ভালো সংগঠক। তিনি উচ্চাকাক্সক্ষী জানা গেছে, তাঁর উচ্চাকাক্সক্ষা ও আমিত্ব এর কারণে সংগঠনের ভেতরে বাইরে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। [প্রতিবেদন/৫, বিস্তারিত] ২৮ নভেম্বর বেগম ফজিলাতুন নেছা দেখা করেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে। তিনি জানান, সিদ্ধেশ্বরীতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কারণ জায়গাটা জলা জঙ্গলে ভরা এবং পানির খুব অভাব। তিনি বাড়ির দালালদের বলেছেন, একটি বাড়ি খুঁজে দিতে কিন্তু শেখ মুজিবের নাম শুনলে কেউ আর বাড়িভাড়া দিতে রাজি হয় না। উত্তরে শেখ মুজিব জানান, যদি তারা বাড়ি ভাড়া না পান তাহলে ছেলেমেয়েদের সমাপনী পরীক্ষা শেষে যেন তারা বাড়ি চলে যান। বেগম মুজিব জিজ্ঞেস করেন তাঁর পিস্তল ও বন্দুকের লাইসেন্সের কী হবে। তিনি জানান, তাঁর পিএ আবুল হুসাইনকে যেন থানায় পাঠান আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে। থানায় তারা এটি নিরাপদ হেফাজতে রেখে দেবে। এবং থানায় থাকলে লাইসেন্স লাগবে কিনা তা যেন জিজ্ঞেস করে। যদি থানা এতে রাজি না হয় তাহলে যে কিনতে চায় তাকেই যেন আগ্নেয়াস্ত্র দু’টি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ধানমণ্ডির প্লটের কিস্তি পরিশোধের কী হবে? মুজিব পিএকে জানান, সরকারের কাছে একটি আবেদন করতে কিস্তি পরিশোধের জন্য সময় দিতে। পিএ জানান, তাঁকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ প্লট সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে গেছে। সুতরাং দরখাস্ত করবেন কীভাবে? মুজিব বলেন, থানায় যোগাযোগ করতে রেফারেন্স নাম্বারের জন্য। [ঐ] ১৫ ডিসেম্বর ডিবির পরিদর্শক বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারের যে প্রতিবেদন পাঠিয়ে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক তা খুব কৌত‚হলোদ্দীপক। শেখ মুজিব জানান, তাঁর গ্রেফতারে তিনি স্তম্ভিত। তবে খুশিও হয়েছেন। কারণ, মানুষ শীঘ্রই জানবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি মিথ্যা ও বানানো। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পস্থাপন ও তার মানুষের জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই যদি দুর্নীতি হয় তাহলে তাঁর বলার কিছু নেই। তিনিই এখানে কুটির শিল্প ও ফিল্ম কর্পোরেশন স্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয় কেন্দ্র থেকে কোটি কোটি টাকা এনেছেন। মুজিব বলেন, দেশ ভুল পথে চলছে এবং মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন। তাকে যে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এই খবরে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। কথা বলার সময় মুজিব ভাবপ্রবণ হয়ে ওঠেন ও জিজ্ঞেস করেন যে, তাঁকে ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। মুজিব আরো বলেন, দেশের বেশ কিছু রাজনীতিবিদ দেশে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এবং এজন্য তারা নিয়মিত মির্জা থেকে টাকা পেতেন। এরা হলো কেএসপি ও নেজামই ইসলামী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে একটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছিল তারা ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। অনেক রাজনীতিবিদ সরকারে অথবা বাইরে পদ চাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ঢাকা দৌড়াচ্ছিল। আরো দু’বছর এরকম চললে মুসলিম লীগের যা হয়েছে আওয়ামী লীগেরও তা হতো এবং দেশটা সত্যিই ধ্বংস হয়ে যেত। জনাব সোহরাওয়ার্দী ব্যাপারটা জানতেন কিন্তু কিছু করতে পারেননি। প্রশাসনিক শৈথিল্য ছিল, শ্রমিক ফ্রন্টে স্ট্রাইক চলছিল। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। কারণ তাহলে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন আসত। সামরিক কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নেয়ায় এখন মানুষ বুঝতে পারছে। এটা তাদের প্রাপ্য। আসল গণতন্ত্রের জন্য এরা উপযুক্ত নয়। এমনকী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে ভারসাম্য রাখতে পারেননি। নিজের সম্পর্কে জানান, গত কুড়ি বছর তিনি রাজনীতি করছেন এবং এই সময়টা দেশের মঙ্গলের জন্য সব দিয়েছেন। ছেলেমেয়ে পরিবারকে অবহেলা করেছেন। এর বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন দুর্নীতির মামলা। রাজনীতি নিয়ে তিনি বিরক্ত। মুক্তি পেলে কোনো চাকরির চেষ্টা করবেন। মানিক মিয়াকেও তিনি বলবেন ইত্তেফাকের ম্যানেজারি ছেড়ে দিতে। বার এট ল করতে তিনি ইংল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টা করবেন। যদি দুটোর কোনোটিই যদি সম্ভব না হয় তাহলে ব্যবসার চেষ্টা করবেন। চায়ের দোকানও সই। তিনি আর রাজনীতিতে জড়াবেন না। জনাব সোহরাওয়ার্দীও রাজনীতি ছেড়ে করাচি বারে প্র্যাকটিস করছেন। সামরিক শাসন সম্পর্কে তাঁর মতামত, মানুষের এটাই প্রাপ্য। তিনি খুশি যে, ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েছেন। দেশে সত্যিকারের সংসদীয় গণতন্ত্র আসবে না যা আসবে তাহলো নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার হবে। নির্বাচিত হবে না, হবে রেফারেন্ডাম। মানুষ শুধু ‘হা বা ‘না’ বলতে পারবে। তিনি জানান, জেনারেল আইয়ুবকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। এবং তিনি যদি কোনো সহায়তা বা সহযোগিতা চান তবে তিনি তা করবেন। পরিদর্শক মন্তব্য করেছেন, সাক্ষাৎকারের সময় শেখ মুজিবকে খুব অস্থির লাগছিল এবং জেল থেকে বেরুনোর ইচ্ছাটা প্রকাশ পাচ্ছিল। সাক্ষাৎকারের সময় তিন চারবার তিনি মুক্তির কথা বলছিলেন। [ঐ] এই সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সরকার ও দলীয় নেতাকর্মীদের সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা অনেকটা সত্য। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ বা অলি আহাদ এ প্রসঙ্গটি আলোচনা করেছেন। আতাউর রহমান, অলি আহাদ সরাসরি এর জন্য মুজিবকে দায়ী করেছেন। তবে আবুল মনসুর এও বলেছেন, “বিবাদে অশান্তি আমাদের পাইয়া বসিয়াছিল। আতাউর রহমান সাহেব ও মুজিবুর রহমান সাহেবের মধ্যে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নামিয়া পড়িয়াছিল। দুইজনই আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক। দুই-এর দক্ষ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা এক বছরে অনেক ভালো কাজ করিয়াছে। ... এই বিরোধের সবটুকুই ব্যক্তিগত ছিল না। অনেকটাই ছিল নীতিগত। ...১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়কে নষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্য অনেকেই দায়ী ছিলেন।” [বিস্তারিত, ৫০ বছর] মুজিব রাজনীতি করবেন না এটি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কখনও বিশ্বাস করেনি। সামরিক শাসন সম্পর্কে যা বলেছেন তা হতাশা থেকে যা আমরাও অনেক সময় বলেছি। আইয়ুব খানকে সাহায্য সহযোগিতার কথা বলেছেন সেটি যে কথার কথা, সেটা পুলিশও জানত। বেগম মুজিবও নাকি বলছিলেন, জেল থেকে ছাড়া পেলে তাঁর স্বামী আর রাজনীতি করবেন না। গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও তা উল্লেখ করা হয়েছিল। এবং বলা হয়েছিল but how far he is genuine or honest in his desire is diffecult to asses as he might have expressed the desire only to set the release for which he is very anxious” তবে শেষে তিনি যে সব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সেগুলি আশ্চর্যরকমভাবে ফলে গিয়েছিল। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী কোনো রাজনীতিবিদ করতে পারেননি। এদিক থেকে বিচার করলে তাঁর দূরদর্শিতার অবশ্যই প্রশংসা করতে হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি অনেকবার আলোচিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বন্ড দিয়েও তিনি ছাড়া পেতে রাজি তবে এই বন্ডটা হবে অন্যরকম। তিনি উল্লেখ করবেন যে রাষ্ট্র বিরোধী কাজে তিনি জড়াবেন না কারণ আগেও তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করেননি। উল্লেখ্য, রাজনীতি করবেন না একথা বন্ডে লিখবেন না। কিন্তু আবার বলছেন, রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। এও যোগ করছেন, তিনি সরকারকে যে কোনো কাজে সহায়তা করবেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি পরিবারের ব্যাপারে উতালা, তাই তিনি মুক্তি চান। [ঐ, পৃ. ২৫৮] এই সব প্রতিবেদন পড়ে ডিআইজি মন্তব্য করেছিলেন, যেহেতু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদল হচ্ছে সেহেতু তাঁকে আরও তিনমাসের আটকাদেশ দেয়া হোক। [caption id="attachment_237128" align="aligncenter" width="700"] একাত্তরের পনের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ[/caption] দুর্নীতি দমন বিভাগ তাঁর সম্পত্তির বিবরণ চেয়েছিল। তিনি জেলে বসে তা দিয়েছিলেন স্থাবর সম্পত্তি ১. ১৯৫৭ সালে বোধহয় আমার নামে ধানমণ্ডিতে একটি প্লট বরাদ্দ হয় যার দাম প্রায় ৮০০০ টাকা। একটি কিস্তি দেয়া হয়েছে (কাগজপত্র দুর্নীতি দমন বিভাগ সিজ করেছে)। ২. ফরিদপুরে আমার স্ত্রী তার দাদা থেকে পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছে যা দক্ষিণ টুঙ্গিপাড়াতে আমার বাবার কাছে আছে। অস্থাবর সম্পত্তি ১. একটি জিপ যা সোহরাওয়ার্দী সাহেব উপহার দিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে আমি তা পেয়েছি যা এখন ঢাকায়। ২. একটি রেফ্রিজেরেটর ও একটি রেডিয়ো গ্রামোফোন আমেরিকায়, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে কেনা। দাম মনে নেই। রশিদ বাসায়। অফিসাররা ইতিমধ্যে যা দেখেছে। ৩. ২০০০ টাকা ও একটি টেপ রেকর্ডার গ্রেফতারের সময় দুর্নীতি দমন বিভাগের অফিসাররা তা বাজেয়াপ্ত করেছে। ৪. দু’টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। জমা টাকা প্রায় ৩০০০। অফিসাররা তা বাজেয়াপ্ত করেছে। ৫. প্রভিনশিয়াল এসুরেন্সে একটি ২০,০০০ টাকার বীমা। দু’টি কিস্তি দেয়া হয়েছিল। এখন ল্যাপসড্। ৬. গৃহস্থালি জিনিসপত্র প্রায় এক হাজার টাকার। ৭. আমার স্ত্রীর উপহার পাওয়া গহনা যার মূল্য হবে প্রায় ২৫০০ টাকা। [ঐ, পৃ. ২৬৯-২৭০] শাহেদ আলীর মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার বাতিল হলেও তদন্ত চলছিল। তদন্তের নাম ছিল ‘ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি ইনসিডেন্ট ইনকেয়ারি কমিশন’। কমিশনের বৈঠক বসত ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে। সেখানে ৫ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯) তারিখে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসা হলো সাক্ষী দিতে। বারান্দায় বসে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমন সময় নান্না মিয়া এসে কুশল বিনিময় করলেন। মুজিব বললেন, তাঁর শরীর ভালো না, পেটের গোলমালে ভুগছেন। নান্না মিয়াকে বললেন, তাঁর হয়ে যেন তিনি ফজলুল হকের কাছে ক্ষমা চান কারণ তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অনেক কটু কথা বলেছেন। নান্না মিয়া বললেন, ফজলুল হকের ওগুলি কিছু মনে নেই। অ্যাসেম্বলিতে যা ঘটছে তা খুবই লজ্জাজনক, তারাই গণতন্ত্রটাকে ধ্বংস করল। এরপর এ কে জহিরুদ্দীন এলেন। দু’জনে কোলাকুলি করলেন। সরকার যে কারণে তাঁকে গ্রেফতার করেছে তা তিনি দেখেছেন। নিজের সরকারকে তিনি উৎখাত করতে চেয়েছেন এ কারণে তিনি বিস্মিত। জহিরুদ্দীন যেন জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করে দ্রুত, হাইকোর্টে তিনি রীট করবেন। সাক্ষী দেওয়ার সময় মুজিব জানিয়েছিলেন, অধিবেশনের আগে ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি লিখিত চুক্তি হয়েছিল এ বলে যে, দু’টি দল একত্রে কাজ করবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিব ও ন্যাপের পক্ষ থেকে দেওয়ান মাহবুব আলী সই করেছিলেন চুক্তিতে। সাক্ষ্যদান শেষে জহিরুদ্দীন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মিয়া আবদুল হাফিজসহ ক্যান্টিনে চা খেলেন। অন্যদের প্রশ্নের জবাবে আবারও বললেন, তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কষ্ট একা থাকা। আবুল মনসুর আহমদ বা আবদুল খালেকের সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারছেন না। অথচ, কমিউনিস্টরা সবাই একসঙ্গে থাকছে। মুজিব জানালেন, ছাড়া পেলে তিনি বার এট ’ল পড়তে লন্ডন যাবেন। এ প্রসঙ্গে জহিরুদ্দীন বললেন, তাঁর যাওয়া উচিত এবং বস (সোহরাওয়ার্দী) এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন। [ঐ] ৬ ফেব্রুয়ারির পর ১০ ফেব্রুয়ারি আবার গেলেন কমিশনে। নান্না মিয়ার সঙ্গে ফের দেখা। হঠাৎ নান্না মিয়াকে বললেন, তাঁর জন্য একটি বাড়ি কেনার বন্দোবস্ত করে দিতে কারণ যে বাড়িতে তাঁর পরিবার এখন থাকে তার ভাড়া তারা দিতে পারছেন না। নান্না মিয়া বললেন, ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। ঐ দিন তার সঙ্গে দেখা আতাউর রহমান খান ও মানিক মিয়ার। দুইজনই সেখানে এসেছিলেন। রীট নিয়ে কথাবার্তা শেষে দুই জনকেই তিনি জানালেন, মুক্তি পাবার পর তাঁরা যেন তাঁকে কোন একটা চাকরি জুটিয়ে দেন বা তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করেন আইন পড়বার জন্য। কথা বললে বলতে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বলেন, আগে তিনি বুঝতে পারেননি অশিক্ষিত লোকদের নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে, সারাজীবন তাদের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জীবনটা তাঁর ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আর রাজনীতি করবেন না। মানিক মিয়াকেও তিনি অনুরোধ করেন তাঁর স্ত্রীর জন্য একটি বাড়ি কেনার বন্দোবস্ত করে দিতে। [ঐ] এ সময় তাঁর স্ত্রীও দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। জানান, বাড়ির খোঁজ পাচ্ছেন না। মুজিব জানান, আরো খোঁজ করতে এবং কম ভাড়ায়। খরচ কমাতে হবে, কারণ, তাঁকে হয় দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হবে। জিপটা বিক্রি করে দিতে বললেন। [ঐ] বাড়ি সম্পর্কে বলি, সেগুনবাগিচার বাড়ি থেকে তিনি গ্রেফতার হন। সেখান থেকে যখন শান্তিনগরের এক বাসায়, বঙ্গবন্ধুর খালাতে ভাই মমিনুল হক খোকা তখন পরিবারের দেখাশোনা করেন। সেগুনবাগিচাতেই আবার একটি বাসার সন্ধান পেলেন। অবসরপ্রাপ্ত এক জজের বাসা। তিনি বললেন, মুজিব যেহেতু জেলে ভাড়া নিয়মিত দিতে পারবেন কিনা। তখন [ব্যবসায়ী] জহিরুল ইসলাম এগিয়ে এসে বলেন, “নিয়মিত ভাড়া দেয়া হবে, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।” তাতেও রাজি নন জজ। তখন খোকা নান্না মিয়ার কাছে গিয়ে সব বললেন, তিনি এসে প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে বাড়ি ভাড়া দিলেন [৭৬, সেগুনবাগিচা] আমি, পৃ. ৬৪] গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলি পড়লে মনে হবে, মুজিব মরিয়া হয়ে উঠছেন মুক্তির জন্য। আসলে মনে হয় তাঁর মনে ক্ষোভ জন্মেছিল। কুড়ি বছর রাজনীতি করছেন, পয়সার মুখ দেখেননি কখনও। পার্টিতে গণ্ডগোল, যে পার্টি নিজে গড়েছেন তাঁর নেতাদের সঙ্গে মনোমালিন্য, তার ওপর দুর্নীতির মামলা, পরিবারের অসহায় অবস্থা, সাহায্য করার কেউ নেই। শরীরও খারাপ। তিনি বোধহয় মুক্তি নিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ নেবেন বলে ভাবছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপে তাই মনে হয়। যিনি কিশোর বয়স থেকে রাজনীতিতে জড়িত তিনি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাজনীতি ছেড়ে দেবেন এটিও বিশ্বাস করা কষ্টকর। পুলিশও বিশ্বাস করেনি। মুজিবকে বারবার ডিটেনশন দেওয়া হচ্ছিল। এর জন্য পুলিশের মতামত চাওয়া হচ্ছিল। ৭.৪.১৯৫৯ সালে ডিআইবি’র অ্যাডিশনাল সুপারিনটেন্ডেন্ট এ খালেক তার রিপোর্ট পাঠান স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট এম.বি. করিমের কাছে। দু’জনই বাঙালি। দেখুন বাঙালি খালেক কী লিখছেন তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, নতুন কিছুই তিনি বলেননি। বন্ড দিতে রাজি। কিন্তু বন্ডে লেখা থাকবে তিনি কোন রাষ্ট্রবিরোধী ও সাবভার্সিভ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না, ভবিষ্যতেও থাকবেন না। খালেক যা লিখছেন এ পরিপ্রেক্ষিতে সেটি ইংরেজিতেই তুলে দিচ্ছি, অনুবাদে অফিসারের রূঢ়তাটা বোঝা যাবে না “ÒThe subject is more a notorious agitator and a trouble monger than a politician. He does not stick to any principle and he may come down to any level for the furtherance his own selfish motives and that of his party members quite detrimental to the interest of the State. So he can hardly be relied on that he would ever show any respect the terms of his Bond if executed. His potentialities to commit mischief of the state are of very high degree and his release at this stage may also hamper the smooth investigation of cases of corruption pending against him......’ এসপি লিখলেন, আই এগ্রি’। সুতরাং ডিটেনশন বাড়ল আরো ছয় মাস। [ঐ] এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখে চিফ সেক্রেটারিকে একটি আবেদন পাঠান বঙ্গবন্ধু। লেখেন, ঢাকা জেলে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে তিনি আছেন, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কর্তৃপক্ষ তাকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখছে। “কতোদিন আমাকে এভাবে রাখা হবে আমি জানি না। কোন অপরাধ ছাড়া একজনকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা প্রতিহিংসামূলক, আপনাদের সরকার যদি আমাকে পাগল বানাতে চায় তাহলে অন্য কথা। অনুগ্রহ করে বিষযটি বিবেচনা করবেন এবং জেল কর্তৃপক্ষকে বলবেন অন্যান্য নিরাপত্তা বন্দীদের সঙ্গে আমাকে রাখতে। আমি বেশ কষ্টে আছি কারণ এখানে কোনো পাখা নেই। মাঝে মাঝে সারারাত জেগে থাকি। ইতোমধ্যে নানা রোগে ভুগছিযার মধ্যে পেটের সমস্যা অব্যাহত। আপনি জানেন সেলবন্দী করার সময় সূর্যাস্ত। ছোট একটা ঘরে আমাকে সারারাত কাটাতে হয়। খুব খুশি হবো যদি জেল কর্তৃপক্ষকে বলেন আমার জন্য একটি পাখার বন্দোবস্ত করতে। আমি যেহেতু এখন রাজনীতিতে নেই সে কারণে আমার মুক্তি দেয়া বিবেচনা করা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত যে আপনি জানেন, আমি একজন কমিউনিস্ট নই, পাকিস্তান বিরোধীও নই।” [ঐ] চিফ সেক্রেটারি তাঁর ফ্যানের বন্দোবস্ত করেছিলেন এবং নিয়মিত যেন তিনি বইপত্র পান সে ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একটি তালিকা দাখিল করেছিল যা কৌত‚হলোদ্দীপক। ১. নিউমার্কেটের সামনে যে সিনেমা হলটি নির্মিত হচ্ছে (বলাকার) যা ঠিকাদার নবী হাদী থেকে কিনেছেন নূরুদ্দীন ও তার অংশীদাররা। জানা গেছে সেখানে বেনামে তাঁর শেয়ার আছে। ২. আবদুল গনি রোডের উত্তর পশ্চিমে এবং মন্ত্রী থাকার সময় তিনি যে বিল্ডিংয়ে থাকতেন তার পশ্চিমে এক টুকরো জমি তার নামে ‘ধপয়ঁরৎবফ’ করা হয়েছে। ৩. নুরুদ্দীনের কয়লার ব্যবসা আছে এবং তার কোম্পানির নাম ‘গ্রীন অ্যান্ড হোয়াইট প্রোপার্টিজ লিমিটেড’। শেখ মুজিবের সেখানে একটি শেয়ার আছে। মনে হয়, শেখ মুজিব যখন চীনে গেছিলেন তখন চীন থেকে এই কোম্পানির মাধ্যমে কয়লা আমদানীর ব্যবস্থা করেছিলেন। ৪. জাফর সিদ্দিকী তাঁর স্ত্রীর মামা। নারায়ণগঞ্জে তার পাটের ব্যবসা আছে। উত্তর চাষাঢ়ায় তার একটি বিল্ডিং আছে। আসলে এটি শেখ মুজিবের। এটি নির্মাণের সময় তাঁর স্ত্রী এটির নির্মাণ কাজ তদারক করেছেন। ৫. জানা গেছে জাফর সাদেকের নামে মুজিবের স্ক্রু, নাট বল্টুর একটি কারখানা আছে। ৬. জানা গেছে উয়ারীতে তার এ ধরনের আরেকটি ফ্যাক্টরি আছে হয় তার ব্যক্তিগত সচিব আবুল হুসেনের নামে নয় আলতাফ হোসেন নামে একজন ঠিকাদারের নামে, যিনি উয়ারীতে থাকেন। তার ঠিকানা হয় ৪ হেয়ার স্ট্রিট অথবা র‌্যাংকিন স্ট্রিট। এ কারখানার লাইসেন্স জোগাড় করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। ৭. জানা গেছে, হেরাজতউল্লাহ বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তির মেয়েকে বিয়ে করেছেন তাঁর ছোট ভাই আবু নাসের। খুলনা শহরে তার নামে ‘হেরাজ মার্কেট’ তৈরি করা হয়েছে এবং সেটি নির্মাণের জন্য প্রচুর এসএম রড ও সিমেন্ট সরবরাহ করা হয়েছে মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। ৮. এই হেরাজতুউল্লাহ পাকিস্তান লেবার সাপ্লাই সিন্ডিকেটের মালিক। চালনা বন্দরে শ্রমিক সরবরাহের পুরো কনট্রাকট তাকে দেওয়া হয়েছে। ৯. সাপ্তাহিক নতুন দিন যা জুলফিকার নামে একজনের সম্পাদনায় প্রকাশিত তার মালিক শেখ মুজিবুর রহমান। ১০. ত্রিপুরা জেলায় একটি পাট কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছেন শেখ মুজিব যার বিস্তারিত তথ্য জোগাড় করা যায়নি। ১১. ১৪ বাংলা বাজারে নিগার ফার্মেসি যার মালিক তার খালাতো ভাই। সেখানে তার শেয়ার আছে এবং তাঁর প্রভাবেই এর ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। ১২. জানা গেছে সেগুনবাগিচায় তিনি যে বাসায় থাকতেন সেটির ভাড়া দিত টি বোর্ড। টি বোর্ডের আইন অনুসারে তা দেওয়া যায় না। ১৩. জানা গেছে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারক ও তার লাল জিপ গাড়ির ড্রাইভারের বেতন টি বোর্ড দেয়। ১৪. জানা গেছে ৩/১ পাটুয়াটুলি লেনের বেঙ্গল প্রিন্টিং প্রেসটি তিনি কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় এটি নিয়ে হৈ চৈ হওয়ায় তিনি তা কিনতে পারেননি। জানা গেছে, মুজিবুর রহমান নামকরা শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছেন। [প্রতিবেদন / ৫, পৃ. ৪৩-৪৫] এই রিপোর্টে দেখা যায়, ‘শোনা যায়’ ‘জানা গেছে’ এই সব শব্দ ব্যবহার করে একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। খুবই হাস্যকর এবং এখন পর্যন্ত এ ধরনের রিপোর্ট তৈরির মানসিকতা আমাদের আমলারা ত্যাগ করতে পারেননি। তিনি একটি প্রেস কিনবেন ঠিক করেছিলেন, এটিও দুর্নীতি। আর তিনি যদি কথিত সম্পত্তির মালিক হন তাতেই বা সমস্যা কোথায়? মুজিব নিজে সম্পত্তির যে তালিকা দিয়েছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। এই মামলা অবশ্য পরে টেকেনি। এ প্রসঙ্গে দু’টি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়ার সামরিক সরকার রটিয়ে দিল এবং পত্রপত্রিকায়ও এসেছিল, তিনি অনেক টাকার মালিক, অনেক কিছু পাওয়া গেছে তাঁর বাসায়। পরে দেখা গেল কিছুই পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর তৈরি হচ্ছে। আমি তাঁর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলাম। তখন, একদিন কলকাতা থেকে আমাদের এক অধ্যাপক বন্ধু এলেন। তাঁকে নিয়ে গেলাম ৩২ নম্বর। বাড়ি দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, এই বাড়িতে তিনি থাকতেন! তাঁর মনে হয়েছিল শেখ মুজিব, না জানি কতো জাঁকজমকপূর্ণভাবে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনেক সমালোচনা করতে পারি কিন্তু তিনি সৎ ছিলেন না একথা কেউ বলতে পারবেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App