×

মুক্তচিন্তা

শোক হোক শক্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ০৮:৪৫ পিএম

শোক হোক শক্তি

সেলিম জাহান

আজ ১৫ আগস্ট- জাতীয় শোক দিবস। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে এই দিনে আমাদের জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে- যে নৃশংসতার কোনো তুলনা নেই। বাঙালি জাতির জন্য ১৫ আগস্ট তাই একটি শোকাবহ দিন। সেই শোক আমাদের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে, জনক হারানোর সে আর্তি আমাদের মথিত করে এবং সে শোক প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। কিন্তু শোক মানুষকে এক ধরনের শক্তিও দেয়- মানুষ শোককে রূপান্তরিত করতে পারে শক্তিতে। শোক যদি শক্তিতে রূপান্তরিত না হয়, তাহলে তা শুধু মাতমই থেকে যায়, শক্তি যদি শোক থেকে কিছু না নিতে পারে, তাহলে সেটা আবেগহীন হয়ে পড়ে। তাই জাতির পিতাকে হারানোর এই দিনে আমাদের শোককে যদি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয়, তাহলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার কাছে, তাঁর দূরদৃষ্টির কাছে, তাঁর দিক-নির্দেশনার কাছে। সেই প্রেক্ষিতে পাঁচটি জিনিস আমাকে সদাই আকৃষ্ট করে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষ লাইনটি, যেখানে তিনি আমাদের সংগ্রামকে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ও ‘মুক্তির সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ হয়তো নিছকই স্বাভাবিক শব্দচয়ন। কিন্তু আমার মনে হয়, তা কিন্তু নয়- অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের অন্তর্নিহিত অর্থ মনে রেখে। ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন। স্বাধীনতা এলেই মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তাকে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে, কারণ স্বাধীনতা মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। দ্বিতীয়ত, শোষণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন। সারাটি জীবন তিনি শোষণের বিরুদ্ধে বলেছেন, বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষকদের বিরুদ্ধে। শোষণকে তিনি দেখেছেন বঞ্চনার একটি শক্তিশালী খুঁটি হিসেবে, সাম্যের পরিপন্থি হিসেবে এবং মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হিসেবে। সেই প্রেক্ষিত থেকেই তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ব আজ দুটো শিবিরে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ তৃতীয়ত, সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক-শর্ত হিসেবে দেখেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটিকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার এক একটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তর দশকের প্রথমদিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও, এ বিষয় দুটিতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ। ‘গণতন্ত্রকে’ তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি, ভেবেছেন, ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্রকেও’ একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি, দেখেছেন ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে। এবং এ দুটিকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে। চতুর্থত, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটা বিশেষ স্থান ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি ‘চরম জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন বাঙালি জাতির আত্মসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে। তেমনিভাবে বারবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্ব›দ্ব না থাকে আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্ব›দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই- বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে। পঞ্চমত, মনে-প্রাণে বাঙালি হয়েও বঙ্গবন্ধুর ছিলেন একটি বিস্তৃত বৈশ্বিক মানসিকতা। এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। তাই তিনি শুধু বাঙালির নেতা ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বনেতা। বৈশ্বিক অঙ্গনে তিনি যূথবদ্ধতার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু স্বার্থ জোটবদ্ধতার পক্ষে নয়। তাই তাঁকে দেখা গেছে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে- টিটো, ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে একই কাতারে। বিশ্বশান্তির সপক্ষে তাঁর জোরালো বাণী, বিশ্ব শান্তি কাউন্সিলের প্রতি তাঁর সমর্থন ও মানবতাবাদী বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা তাঁকে এক বিশ্ববরেণ্য নেতায় পরিণত করেছিল। তাই তিনি শুধু ‘বঙ্গবন্ধুই’ নন, ‘বিশ্ববন্ধুও’ বটে। যেসব আদর্শিক মূল্যবোধগুলোর ওপরে ভিত্তি করেই বাংলাদেশের জন্ম ও পথচলার শুরু, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁর নিকটজনকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রযন্ত্র এসব মূল্যবোধকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, ইতিহাসের বহু নিষ্পত্তিকৃত সত্যকে খুঁচিয়ে অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে, আমাদের নতুন প্রজন্মের বেপথু করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এসব কিছুর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে স্বদেশে। এক. যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আদর্শিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনি এবং এর বিরোধিতা করেছে, তাদের অবস্থান আরো সংহত হয়েছে স্বদেশে। দুই. আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম, তাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ নামটি, তার মুক্তিযুদ্ধ, তার আদর্শিক মূল্যবোধ দ্বারা সর্বদা সার্বক্ষণিকভাবে উদ্বেলিত হয়েছি, তেমনি আমাদের প্রজন্মের আরেকটি অংশ তো সবকিছু শুধু বিস্মৃতই হইনি, বেপথুও তো হয়েছি। তিন. জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আদর্শিক মূল্যবোধ হয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গেছে নয় বিকৃত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ত্রিধারার অস্তিত্ব স্বদেশের মতো বিদেশেও তো আমরা প্রত্যক্ষ করি। সত্যি কথা বলতে, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু এর বিরোধিতাই করেনি, বরং মানবতাবিরোধী গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনে অংশ নিয়েছিল, তাদের অনেকেই আজ বিদেশে বসবাস করছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র এবং তৎপরতা সমানে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যারা প্রত্যক্ষ করেছে তাদের মধ্যে যারা অনাবাসী, তাদের মধ্যেও তো দুটি ধারা রয়েছে- যারা হৃদয়ে এক টুকরো বাংলাদেশ বয়ে বেড়ায়, আর যারা কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর হচ্ছে বিদেশে নতুন প্রজন্মকে তাদের শেকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া- আমাদের দেশ, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। আজ জাতীয় শোক দিবসে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : এক. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুত্থান শুধু কথায় নয়, কাজে। এসব চেতনা প্রবিষ্ট করাতে হবে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে, প্রতিফলিত করতে হবে আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এবং অন্তর্ভুক্ত করতে হবে আমাদের জাতীয় নীতিমালায়। এটা দলীয় কোনো বিষয় নয়, এটা জাতীয় আকাক্সক্ষা। দুই. বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জন্মের পরে যেসব মৌলিক নীতিমালার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায্যতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ভিন্ন আমাদের মুক্তি নেই- যে মুক্তির কথা বঙ্গবন্ধু বলেছেন। আমাদের আজকের নানা জাজীয় সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি ওখানেই নিহিত। তিন. বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসরণ। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, অসমতা দূর এবং একটি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বিশ্বের বিভক্তি তাঁর জানা ছিল এবং তিনি ছিলেন ‘শোষিতের পক্ষে’। শেষের কথা বলি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের পরে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। আমার আর হিমালয় দেখার প্রয়োজন নেই।’ আমাদের অনেকেই হয়তো হিমালয় দেখেছি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। কিন্তু তাতে কি? হিমালয়ের বিস্তার থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর বিশালতা বুঝতে পারি, তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে পাই এক স্থির দিক-নির্দেশনা, তাঁর স্মৃতি থেকে পাই এক অনন্য প্রেরণা। প্রাপ্তি আমাদেরই বা কম কিসে? চেতনার সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পথচলা অক্ষয় হোক।

সেলিম জাহান : ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App